আলেক মিনাসিয়ান, বয়স ২৫। সম্প্রতি কানাডার টরেন্টো শহরে পথচারীর উপর গাড়ি চালিয়ে হত্যা করে ১০ জন মানুষকে, আহত ১৫। নিহতদের মধ্যে নারী আর শিশুর সংখ্যাই বেশী। সুখবর এই যে, সে মুসলিম নয় এবং ঝড়ে বক ফেলা কেরামত ISIS তাৎক্ষণিক ভাবে এর দায় স্বীকার করে নি, যা কানাডা আমেরিকা প্রবাসী নিরিহ মুসলিমদের জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস।
কেন এই হত্যাযজ্ঞ? এএফপি ও নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, আলেক মিনাসিয়ান একজন ” ইনসেল”।
কি এই ” ইনসেল”? ইনসেল শব্দটি আসলে,” ইনভলান্টারি সেলিবেটস”-এর এর সংক্ষিপ্ত রূপ। যার বাংলা অর্থ হলো, ” অনিচ্ছাকৃত কুমার”। এরা পছন্দের নারীর কাছে ভালবাসা প্রস্তাব রেখে, প্রত্যাখ্যাত হয়ে হতাশ হয়ে পড়ে এবং নিজেকে নিঃসঙ্গ করে ফেলে। এই নিঃসঙ্গতা তাকে নারী বিদ্বেষী করে তোলে। একসময় যা সুস্থ সমাজের জন্য দুঃখজনক ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
লিঙ্গ বিদ্বেষ নিয়ে গবেষণায় রত, সাদার্ন প্রভার্টি ল’সেন্টার বলছে, বিশ্ব ব্যাপী প্রায় ৪০ হাজার সদস্য নিয়ে ইনসেল অন লাইন গ্রুপ রয়েছে এবং তাদের সাংকেতিক ভাষা রয়েছে।এই ঘটনা ঘটানোর আগে আলেক তার ফেবুতে সাংকেতিক ভাষায় পোষ্ট দেয়। প্রতি উত্তরে মন্তব্য কলামে অন্য একজন ইনসেল লেখে যে,” ইনসেল বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে”।
প্রসঙ্গক্রমে একটা “মিথ”-কে সংক্ষেপে তুলে ধরবো। ইহুদী ধর্ম গ্রন্থ” বুক অব জেনেসিস” বলছে, ইভ স্রষ্টার সৃষ্টির প্রথম মানবী নয়। প্রথম মানবী হলো,” লিলিথ”। এ্যাডাম এবং লিলিথ, দুজনকেই মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়। এ্যাডাম চাইতেন তিনি পুরুষ, তাই লিলিথ-কে তার ইচ্ছে মত চলতে হবে। লিলিথ এর কথা হলো, তুুমি আমি দুজনেই মাটির তৈরি, আমি তোমার আজ্ঞাবহ কেন হবো? কলহ চরমে উঠলে স্রষ্টা লিলিথ এবং এ্যাডাম-কে সমঝোতার হুকুম দেন। কিন্তু লিলিথ অস্বীকার করলে লিলিথকে ধংস করে দিয়ে এ্যাডামের পাঁজরের হাড় থেকে ইভ-কে তৈরী করা হয়, যাতে ইভ আর এ্যাডাম সমঝোতায় চলতে পারে।
সম্মানীত বন্ধুগণ, আসুন এখন আমরা নিজেদের দিকে তাকাই। অপ্রিয় সত্য যে, পরিবার সমাজ ধর্ম, সবক্ষেত্রেই অধিকার প্রশ্নে নারী পুরুষ পরস্পর বিদ্বেষী হয়ে উঠছে। নারীবাদ পুরুষবাদ নিয়ে আমরা মেতে উঠেছি। পরস্পর পরিপূরক সম্পর্ক- কে নিক্তিতে মাপার উন্মাদনায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি। একে অপরকে দোষারোপ করছি, একের পর এক দুঃখজনক ঘটনার জন্ম হচ্ছে।
অথচ পৃথিবী সুন্দর, জীবন সুন্দর। শুধু প্রয়োজন একটু সমঝোতার।
আমরা আলেক মিনাসিয়ান হতে চাই না, লিলিথ হতে চাই না। সমঝোতায় মিলে মিশে “মানুষ” হয়ে বাঁচতে চাই।
লিলিথ : আদি-মাতা ও প্রথম বিদ্রোহী – রোখসানা চৌধুরী
লিলিথ উপাখ্যানের উৎপত্তি হয়েছিল যিশু খ্রিস্টের জন্মের তিন হাজার বছর আগে। প্রাচীন সুমেরীয় রূপকথায়, তাকে বলা হত ‘অন্ধকারের নারী’ বা ডাইনী। লিলিথের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর একটি খোদাই করা সিরীয় লিপিতে, যেখানে লেখা ছিল, ‘হে অন্ধকারের উড়ন্ত অশুভ আত্মা, দূর হয়ে যা এই মুহূর্তে, হে লিলিথ!’ লিলিথ নামটি একই সাথে বিতর্ক, রহস্যময়তা, আধিপত্যের ইতিহাস, শোষক ও শোষিত শ্রেণির আদিরূপে মিলেমিশে রয়েছে।
এক অর্থে লিলিথই আমাদের আদি-মাতা। যদিও আধিপত্যবাদের করাল হস্তপেক্ষে চিরকালের জন্য সেই ইতিহাস আজ লুপ্তপ্রায়।
ধর্মগ্রন্থ অনুসারে বলা যায়, ইসলাম ও খ্রিস্ট ধর্মে যদিও আদম-হাওয়া কিংবা এডাম-ঈভের কথা বলা হয়েছে কিন্তু এই দুটি ধর্মেরই আদিরূপ হল ইহুদী ধর্ম। সেই ইহুদী ধর্মের ধর্মগ্রন্থ ‘বুক অব জেনেসিসে’ বলা হচ্ছে প্রথম মানবী ইভেরও আগে আরেক নারীর অস্তিত্বের কথা যিনি আদমের মতোই মাটির তৈরি। আদমের পাঁজরের হাড় থেকে প্রস্তুত নয়।
লিলিথ নিজেকে শ্রেষ্ঠ নয়, কেবল সমতার দাবিতেই ধিকৃত, অভিযুক্ত, বিতাড়িত হতে হতে খোদ ধর্ম গ্রন্থের ইতিহাস থেকেই ক্রমে বিলুপ্ত; যদিও তথ্য উপাত্ত বলে লিলিথই আসলে নারীর পূর্বসূরী, আদি-মাতা। আর নারীর জন্য ডাইনী আখ্যায়িত হওয়াটা রীতিমত ঐতিহাসিক ব্যাপার। মজার বিষয় হল, ‘ডাইনি’ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘উইচ’ (Witch) এসেছে গ্রীক ‘উইক্কা’ থেকে যার অর্থ বুদ্ধিমান নারী। এইসব বুদ্ধিমান নারীদের বিদ্যাবুদ্ধির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে এক জোট হয়ে পুরুষতন্ত্রের ধারকেরা একের পর এক ফাঁসি দিয়েছে তাদের।
বর্তমান পৃথিবীর দিকে তাকালে লিলিথের অশুভত্বের অপবাদ-আবিষ্ট নির্বাসিত জীবনের প্রতিফলন দেখতে পাই বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতাকামী নারীদের ভেতর। লিলিথের মতো আত্মমর্যদাকামী নারীদের একইভাবে সমাজ-বিচ্ছিন্ন করে ফেলার অপপ্রয়াস অব্যাহতভাবে বিদ্যমান। আজো শত-সহস্র বছর পরেও দেশে-দেশে নারী তার আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ব্যাপৃত। আজো সন্তান ও সম্পদের অধিকারের মতো মৌলিক বিষয়গুলোতে সাম্য প্রতিষ্ঠা পায়নি। সবচেয়ে বড় কথা, নারীর সম্মান অথবা অসম্মান এখনো তার কর্মপরিসর বা ব্যক্তিত্বের প্রভাব সঞ্চারণের উপর নির্ভর করে না। আজো সমাজ-পরিপার্শ্বের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে তুচ্ছাতিতুচ্ছ প্রপঞ্চে ঘুরপাক খাচ্ছে নারীর অবয়ব। স্বেচ্ছা নির্বাসিত মোহমুক্ত লিলিথের আত্মমর্যাদাবোধ তাই আজকের দ্বিধা বিভক্ত, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যহীন নারীবাদী ভাবনার যোগ্য আদর্শিক প্রতিমুর্তি হয়ে উঠতে পারে। তাই ‘লিলিথ’ বিষয়টিতে আরও অধিক গবেষণা, যথার্থ অনুসন্ধান ও পুনঃপাঠ হওয়া জরুরী।
(সংক্ষেপিত)
https://goo.gl/2YU517