নিউ ইয়র্ক থেকে:-
দার্জিলিংয়ের খাবার!
আমরা হোটেলে ফিরলাম বিকেল পাঁচটায়।সূর্য্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে। কখনো বা চলে যাচ্ছে বড় পাহাড়ের পেছনে আবার দেখা দিচ্ছে ছোট পাহাড়ের চূড়ায়।কখনোবা পাহাড়ের ডানে আবার কখনো বা বামে।পাহাড় ও সূর্য্যের এই নিঃশব্দ লুকোচুড়ির ফাঁকেই আমরা ঢুঁকে পড়লাম হোটেলে।
সিডিতে দেখা হলো ম্যানেজার ও বাবুরচীর সাথে।কুশলাদি বিনিময়ের পর বাবুরচীকে জিজ্ঞেস করলাম,’রাতের খাবার কি’?
বাবুরচী বললো,’গতরাতে বলেছিলেন মুরগীর ভুনা আর আলু দিয়ে ডিমের ঝোল খেতে চান।তাই পাক করেছি’!
আমি বললাম,’খাবারটা কি রুমে পাঠানো যায়’?
ম্যানেজার বললেল,’অবশ্যই’!
আমরা রুমে এসে গোসল করে যখন ফ্রেশ হয়েছি ততক্ষনে খাবারও রেডী।
বিশাল গোলাকার কাঁসার থালায় গরম গরম লুচি আর ধূমায়িত ভাত।ভাত আর লুচির চারপাশে বৃত্তাকারে সাজানো ছোট ছোট আরো চারটি কাঁসার পাত্র।ওগুলোর একটিতে মুরগী ভুনা,একটিতে আলু দিয়ে ডিমের ঝোল।অন্য দুটোর একটিতে ভূনো ডাল আরেকটিতে সবজি!এরকম দু’টো কাঁসার থালা দেওয়া হয়েছে আমাদেরকে।একটি মা’র আরেকটি আমার।
প্রথমেই আমরা ডাল আর সবজি দিয়ে লুচি খেলাম।তারপর ডিমের ঝোল দিয়ে ভাত আর মুরগী ভুনা!এযেন খাবার নয়,অমৃত!
আমি বললাম,’দার্জিলিংয়ের খাবার খুবই ভাল,তাইনা মা’!
মা আমাকে বললেল,’শুধু যে খাবার ভাল তা নয়,দার্জিলিংয়ের হাওয়াতে কি যেন আছে একটা!আমি তোকে আগেও বলেছি:বার বার শুধু ক্ষুধা লাগে’!
দু’টো ব্যাপারেই মা’র সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত।আমারো ক্ষিদে ও রুচি বেডেছে দ্বিগুন বা তিন গুন!
কাঠমুনডু বা শান্তিনিকেতনের খাবার এত মজার ছিল না! সকালে নাস্তা,দুপুরের খাবার ও রাতের খাবার এত মনযোগ সহকারে আগে খাইনি কখনোই!
রাতের খাবারের পর মা ঘুমুতে গেলেন রাত সাডে ন’টার দিকে।আমিও ঘুমুতে গেলাম দশটার দিকে।দার্জিলিংয়ে রাত দশটা মানে অনেক রাত!এখানে সন্ধার পরেই চারদিক নিঝুম পুরী।বিচিত্র কারনে আমার ঘুম আসছিলোনা।ভাবলাম বেলকনিতে গিয়ে বসি।গায়ে একটা চাদর জডিয়ে চলে এলাম বেলকনিতে।
আবারো নৈঃশব্দের কথোপকথন!
আমার সামনে সারি সারি পাহাড়।উঁচু-নীচু,ছোট-বড।কত পদের পাহাড়। ওই পাহাড়ে হেলান দিয়ে ঘুমুচছে মেঘের দল!ক্ষয়া চাঁদের ক্ষয়া জোছনা ছডিয়ে পডছে ওই মেঘে।কি যে অপূর্ব সেই দৃশ্য!একবার মনে হলো হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেই!পরখ করে দেখি ওই মেঘের হিম! ওই মেঘের পেলবতা!কিনতু সব হিম সব পেলবতা কি ছোঁয়া যায়! কিছু কিছু হিম,কিছু কিছু পেলবতা থাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে!ওকে শুধু অনুভব করা যায়।আমিও তাই করলাম!
মন দিয়ে যখন পাহাড়,মেঘ আর চাঁদের খেলা দেখছিলাম তখনই উত্তর থেকে ভেসে এলো হিমালয়ী বাতাস।ওই বাতাসে কেঁপে উঠলো পাহাড়-চুঁডো,কেঁপে উঠলো মেঘের দল।কিছু কিছু মেঘ দলছুট হয়ে রওয়ানা দিল দক্ষিনের পাহাড়ে। ওই মেঘ দিয়ে আকাশে তৈরি হলো বিচিত্র সব অবয়ব।মেঘ দিয়ে তৈরি হলো দানব!দানব থেকে মানব!মানব থেকে নৌকো,নৌকো থেকে পরিপূর্ন এক নারী!নি:শব্দে ঘঠে চলেছে দৃশ্যপটের পরিবর্তন!সাক্ষী শুধু আমি।
আমি ফিরে গেলাম আমার কৈশরের দিনগুলোতে।কৈশরে আমি আর আমার বনধু অয়ন কতদিন শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে বসে থেকেছি!আমদের দৃষ্টি থাকতো শীতলক্ষ্যার উপরে ভেসে বেডানো শত শত নৌকো আর লঞ্চ-এর উপরে।ঐ নৌকোগুলোর কোনটায় পাট, কোনটায় আলু আবার কোনটায় থাকতো ইট বা বালু।
নৌকোগুলোর কোনটা পালতোলা, কোনটা গুনটানা, কোনটা বিশাল, কোনটা ক্ষুদ্র! পালগুলোও ছিল বিভিন্ন আকারের,বিভিন্ন বর্নের!
কোন কোন দিন বাতাসের বেগ থাকতো, ঝড়ো হাওয়া থাকতো, পালগুলো ফুলে ফেপে উঠতো বোয়াল মাছের পেটের মত!
ঐ দৃশ্য দেখে আমাদের সেকি উচ্ছাস!
সেকি আনন্দ!
আমাদের মনে হতো ঐ নদীটা আমাদের!
নদীর উপরে ঘুরে বেড়ানো নৌকোগুলোও আমাদের!
নদীর উপরে ঝুকে পড়া বিশাল আকাশ।ঐ আকাশে ছেঁডা ছেঁডা মেঘ। মেঘ দিয়ে তৈরি হতে কত শত নকশা! কখনো নৌকা, কখনো জাহাজ, কখনো জীব-জন্তু, কখনোবা বিশাল বিশাল দানব! ওরা যেন পাল্লা দিতো নদীতে বয়ে যাওয়া ঐ নৌকোগুলোর সাথে।পাল্লা দিতে দিতে হারিয়ে যেতো ওই আকাশেই! আমরা অবাক হয়ে দেখতাম সেইসব দৃশ্য!
আমার বনধু অয়ন বলতো,’আমি বড হয়ে বিশাল একটা নৌকো বানাবো! একদিন তুই আর আমি ঐ নৌকো করে চলে যাবো’!
আমি বলতাম, ‘কোথায় যাবি,অয়ন’?
অয়ন বলতো, ‘দূর অজানার দেশে! যেখানে কেউ যায় নি কখনো’!
দেখতে দেখতে সেই অয়ন আসলেই একদিন অজানার দেশে চলে গেল!যে দেশ থেকে কেউ ফেরত আসেনা!
দার্জিলিংয়ে মেঘের খেলা দেখতে দেখতেই এত বছর পরেও আমার স্পষ্ট মনে পডে অয়নের কথা!মনে পড়ে আরেক জনের কথা।তার নাম বাসনতী।
বাসনতীকে আমরা প্রথম দেখেছিলাম পূজার বেদীতে।কুমারী পূজোর দেবী হিসেবে।আহা! ওইটুকুন একটা মেয়ে!কত আর বয়স হবে? আট বা নয়!কি অদ্ভুত সুন্দরই না ছিল!
অয়ন আর আমি।আমি আর অয়ন!আমরা দু’জনেই ওর প্রেমে পডলাম! আমরা দু’জনেই তখন ক্লাস সিক্সে পডি!ওকে এক নজর দেখার জন্যে সেন বাডীর আশেপাশে আমি আর অয়ন কত ঘুর ঘুর করেছি!
কিনতু দেখা মিলতো না বাসন্তীর!বাসন্তীর দেখা মিলতো পুরো বছরে মাত্র একবার।শুধুই কুমারী পুজোর সময়ে!
পাহাড়ের দিকে চেয়ে চেয়ে আরেকদিনের কথা আমার বেশ মনে পডে।
হেমন্তের সকাল।ছুটির দিন।
খুব ভোরে অয়ন আর আমি যাচছিলাম অম্বিকাসার বাডী।ফুল সংগ্রহে।যাওয়ার পথে দেখি সেন বাড়ীর দরজাটা আধেকটা খোলা।ঐ আধেক খোলা দরজা দিয়েই আমরা ঢুকে পড়লাম সেন বাড়ীর ভেতরে।বিশাল উঠোন।উঠোনের এক প্রান্তে ইট দিয়ে বাঁধানো তুলসী তলা।তুলসী তলার পাশেই একটা শিউলি ফুলের গাছ।তুলসী তলা আর শিউলিতলা দুটোই ছেয়ে আছে ফুলে ফুলে।ফুলের গন্ধ ছডিয়ে পডেছে আশেপাশের বাতাসে।
ঐ গন্ধে মাদকতা ছিল, মুগ্ধতা ছিল!
মাদকতা আর মুগ্ধতা নিয়েই আমরা এগুলাম সামনে।চোখে পড়লো একটি চিলে কোঠা।চিলে কোঠায় ঠাকুর মূর্তি।
মূর্তির সামনে দাডিয়ে দুজন।
বাসন্তী ও তার মা!
দুজনেরই পরনে নীল শাডী।কপালে চন্দনের ফোটা।হাতে ছোট্ট ডালা।ঐ ডালায় গাঁদা,শেফালী আর রক্তজবা! ফুলের গন্ধ, চন্দনের গন্ধ আর সকালের হালকারোদ সবমিলিয়ে স্বপনপুরীর স্বপ্নদৃশ্য!
বাসন্তীকে ঐ আমাদের শেষ দেখা!শুনেছি হেমন্তের আরেক রোদেলা ভোরে ওরা চলে গেছে কোলকাতা।
আজ এতদিন পরে হঠাৎ করে অয়নের কথা মনে পডলো কেন? কেনইবা মনে পডলো বাসন্তীর কথা! আমি জানি না!
রাত আরো গভীর হয়েছে।থেমে গেছে উত্তরীয় হাওয়া।থেমে গেছে মেঘেদের উড়াউডি!তারপরেও আমি ঘোরের মধ্যে শুনতে পাই-
‘অতন্দ্রিলা
ঘুমোও নি জানি
তাই চুপিচুপি গাঢ় রাত্রে শুয়ে
বলি শোনো
সৌরতারা ছাওয়া এই বিছানায় সুক্ষজাল রাত্রির মশারী
কতদীর্ঘ দুজনার গেলো সারাদিন
আলাদা নিশ্বাসে-
এতক্ষণে ছায়া ছায়া পাশে ছুঁই
কি আশ্চর্য দুজনে দুজনার
অতন্দ্রিলা
হঠাৎ কখন শুভ্র বিছানায় পড়ে জোত্স্না
দেখি তুমি নেই’!
(রাত্রি ,অমিয়চক্রবর্তী)
মধ্য রাতের ঘোর কাটাতে আমি চলে আসলাম বিছানায়!কখন যে ঘুমিয়েছি জানি না।ঘুম ভাংলো খুব ভোরে।তখনো কে যেন কানে কানে বললো:
‘অতন্দ্রিলা
ঘুমোও নি জানি
তাই চুপিচুপি গাঢ় রাত্রে শুয়ে
বলি শোনো… …’
সিনহা মনসুর
চলবে… …