নিশ্চিন্ত, নির্ঝঞ্জাট এবং সবাই মিলে হৈ-চৈয়ের কয়েকটি পরিপূর্ণ দিন।
কোথাও বেড়াতে যাওয়ার উদ্দেশ্য বিভিন্নজনের কাছে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। কেউ কেউ যান কোনো সুন্দর জায়গার শুধু সুন্দরের পরশ নিতে, সেক্ষেত্রে জায়গাটি কেমন সেটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা না হলে তাদের বেড়ানোটাই পন্ড, কিন্তু আমার তথা আমাদের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র সুন্দরের পরশ নেওয়া বা নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখা নয় , বরং এগুলি গৌণ, বিশেষ করে যখন পরিবার পরিজন নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো জায়গাটা যাই হোক, সবাই মিলে যেন একসাথে হৈ-চৈ করে কিছুটা নিশ্চিন্ত সময় কাটানো যায়। কারণ বর্তমানের এই ব্যস্ততম জীবনে আপনি একই ছাদের নিচে থেকেও আপনার পরিবার বা প্রিয়জনদের সাথে একসাথে মাত্র কয়েকঘন্টা decent কিছু সময় কাটানো বেশ কঠিন ব্যাপার। এর পর যদি এক এক জন থাকেন এক এক শহরে বা এক এক দেশে তাহলে তো কথাই নেই।
আমার দেশে থাকা ভাই-বোন বা ভাগ্নে ভাগ্নিদের সাথে দেখা হয় প্রায় দু বছর অন্তর, আর তাও মাত্র ৩/৪ সপ্তাহের জন্য। এর পর যদি বিশেষ কোনো কাজ নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে আপনার attention বা সময় ভাগা ভাগি হয়ে গেলো। তাই আমি সাধারণত দেশে গেলে চেষ্টা করি সপরিবারে কোথাও কিছুদিনের জন্য ঘুরে আসার। এতে করে হয়তো আরো অনেকের সাথে দেখা সাক্ষাৎ সব সময় সম্ভব হয় না, কিন্তু করার কি! আপনার নিজ পরিবারের priority তো আগে। বিগত ২/১ বার আমার বড়ো বোন রাজশাহীতে থাকায় সদলবলে তার বাসায় গিয়ে তারপর বের হতাম।
এবারের প্ল্যান অবশ্য আলাদা ছিলো। প্রায় ৬ মাস আগে থেকে প্ল্যান করা, কারণ হুট্ হাট করে কিছু করলে আরামে বা স্বাছন্দে ভ্রমণ করা যায় না। আমাদের প্রথম পরিকল্পনা ছিল দার্জিলিং অথবা আসামের মেঘালয় ভ্রমণ, কিন্তু ভারতে সম্প্রতি NRC আন্দোলনের কারণে আমরা সেই পরিকল্পনা বাদ দিয়ে সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার প্ল্যান করি। আমার প্ল্যান মোতাবেক আমার ভাগ্নে অনিক আমরা দেশে যাওয়ার আগে থেকেই সমস্ত টিকেট, হোটেল, রিসোর্ট, বোট, শিপ ইত্যাদি রিসার্ভ করে রাখে।
আমরা কোনো ট্যুর কোম্পানির সাথে যায়নি কারণ তাহলে আপনার কোনো ফ্রিডম থাকে না, অর্থাৎ যখন যা ইচ্ছা তা করতে পারেন না। সব সময় একটা তাড়ার মধ্যে থাকতে হয়। এবার সেন্ট মার্টিন ছাড়াও খুলনা, বরিশাল এবং সিলেটে যাওয়া হয়েছে, তবে signature টুর ছিল সেন্ট মার্টিন। আমি এবং আমার স্ত্ৰী সুদূর কানাডা থেকে যাওয়ার পরপরই সেন্ট মার্টিনে ভ্রমণ বেশ tiresome ছিল, কিন্তু সবাই মিলে হৈ হুল্লো করে যেতে যেতে সেটা আর অনুভব করি নাই। আর বিশেষ করে আমার ১১ বছরের বাবা হারা ভাগ্নের মুখের হৃদয়খোলা হাসি আর আনন্দ দেখে সব ক্লান্তি দূরে হয়ে গেছে। তার বাবাকে ফেরত দেওয়া যাবে না, কিন্তু সে যেন না ভাবতে পারে তার বাবা নেই তাই সে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত, এটাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। আমরা যাওয়ার এক মাস আগে থেকে সে এবং আমার আরেক ভাগ্নি দুজনে অ্যাডভান্স পড়াশুনা করে রাখে যাতে করে ওই সময় ছুটি কাটাতে পারে। তাদের শখ ছিল তারা ঢাকা-বরিশালের বড়ো বড়ো লঞ্চগুলির VIP কেবিনে করে ঢাকা যাবে। তাদের সেই শখ পূরণে আমরা গোপালগঞ্জ থেকে বরিশাল হয়ে ঢাকা যাই।
হাঁ, লঞ্চগুলি বেশ লাক্সারিয়াস, এবং বাংলাদেশের আঙ্গিকে অনেক comfortable . ওরা সারারাত ধরে অনেক মজা করেছে। তারপর ঢাকা থেকে আমরা গ্রীনলাইনের খুব সুন্দর এবং আরামদায়ক বাসে করে সরাসরি টেকনাফ যাই। একটা কথা বলতে হয়, বাংলাদেশের বাস পরিবহনের অনেক উন্নতি হয়েছে। ঐসব বাসগুলি এখানকার গ্রেহাউন্ড এর থেকে অনেক অনেক গুন্ ভালো। এমনকি বাংলাদেশের প্লেনের থেকেও অনেক ভালো। প্লেন শুধু আপনাকে সময় বাঁচাবে, তাছাড়া কোনো লাক্সারি নেই। যাহোক টেকনাফ থেকে একটি শিপে করে আমরা সেন্ট মার্টিন যাই। বাসের মধ্যেও ওরা অনেক মজা করছে। মাজে মাঝে বাসের যাত্রা বিরতি, এবং সেখানে খাওয়া দাওয়া ওদের অনেক ভালো লেগেছে।
সেন্ট মার্টিন ছোট একটি দ্বীপ, খুব অল্প সময়ে আপনি পুরো দ্বীপ ঘুরে কাবার করতে পারেন। দেখার মতো আহামরি খুব বেশি কিছু নেই। তবে পরিবার পরিজন নিয়ে কিছুটা নির্ঝঞ্জাট সময় কাটানোর ভালো জায়গা। ওখানকার Air এখনো বাংলাদেশের অন্য জায়গার মতো polluted না, পানি যথেষ্ট পরিষ্কার, কক্স বাজারের মতো অত ঘিঞ্জি আর dirty না। মোট কথা বাংলাদেশের একটি অংশ হলেও আপনার মনে হবে আপনি বাইরের কোনো একটি দেশের ছোটোখাটো রিসোর্টে গেছেন। যথেষ্ঠ safe and secured . আমরা যে হোটেল/রিসোর্টে ছিলাম সেটি যথেষ্ট পরিষ্কার এবং রুমগুলি বেশ ভালো। ওদের নিজেস্ব জেনারেটার থাকায় ২৪ঘন্টা বিদ্যুৎ ছিল।
সব মিলিয়ে আমাদের ছোট বড়ো সকল সদস্যদের খুব ভালো ৩টি দিন কেটেছে। সবাই আরো ২/১দিন বেশি থাকতে চেয়েছিলো কিন্ত আমাদের সময়তো হিসাব করা। এদেশে প্রফেশনাল চাকরির এই একটি draw back একবারে এক মাসের বেশি ছুটি পাওয়া যায় না। নন-প্রফেশনাল কাজ বা নিজের ব্যবসা করলে ২/৩ মাস থাকা যায়। যাহোক, আমার মতে বাংলাদেশ সরকারের পর্যটন কর্তৃপক্ষের উচিত ওখানে যাওয়ার এবং থাকার ব্যবস্থাটা আরো উন্নত করা তাহলে দেশি পর্যটক ছাড়াও অনেক অনেক বিদেশী পর্যটকের আগমন বাড়বে, এবং তাতে করে ওই ক্ষেত্রে আমাদের রেভিনিউ বাড়বে।
ওখানে থাকা অবস্থায়, বলতে গেলে আমরা দেশের বা পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে একেবারে বিছিন্ন ছিলাম। আমাদের কেউই শুধু মাত্র ছবি তোলা ছাড়া তাদের সেল ফোন বেবহার তেমন করেনি। অনেক ফ্রেশ মাছ এবং ডাব খাওয়া হয়েছে, এবং সাথে বোনাস হিসাবে দ্বীপের ফ্রেশ বাতাস। আমার বেক্তিগত প্রিয় জিনিসটি ছিল সকালবেলা ফজরের নামাজ পড়ে সমুদ্রের পাড় ধরে মৃদু বাতাস খেতে খেতে হাঁটা, আর জেলেদের মাছ ধরা দেখা। আলহ্তালাকে ধন্যবাদ আমাদেরকে ওই সময়টুকু উপভোগ করার তৌফিক দেওয়ার জন্য। আপনি নিজে নিজে সব কিছু করলে খরচ খুব বেশি না। আপনি জন প্রতি ৬/৭ হাজারেও ঘুরে আস্তে পারেন, আর যদি জন প্রতি ১০/১২ হাজার খরচ করেন তাহলে মুটামুটি লাক্সারিয়াস ভাবেই ঘুরে আসতে পারেন। আমরা যারা কানাডাতে থাকি তাদের জন্য ধরুন $১৬০/৭০ ডলারের মতো। টরন্টো-মন্ট্রিল যেতে আসতেই তো এমন খরচ হয়।
ধন্যবাদ।
মুকুল
টরন্টো