মাইনাস তাপমাত্রায়, বরফের সময়তো কয়েকটি দেশেই গিয়েছিলাম – অষ্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা, সুইজারল্যান্ড।আর এখনতো বরফের দেশেই আছি, কানাডায়।আজ থেকে দশ বছর আগে আফগানিস্তান ভ্রমণ ছিল আমার জীবনের প্রথম মাইনাস তাপমাত্রার অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে যখন আফগানিস্তান যাই তখন সেখানকার তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ইলাভেন।প্রস্তুতির কমতি ছিল না সেজন্য।বাসায় শীতের কাপড় যা ছিল তাতো নিয়েই ছিলাম, সাথে যুক্ত হয়েছিল ওভারকোটসহ আরো কিছু নতুন শীতের কাপড়।ঢাকা থেকে নয়া দিল্লি হয়ে কাবুল। দিল্লিতে একদিনের যাত্রা বিরতি। তখন ঢাকা ও দিল্লিতে গরম। তাই ক্যাবিন ব্যাগের ভিতর নিয়েছিলাম শুধু একটা চাদর।চেকইন লাগেজে সব শীতের কাপড়।কাবুল বিমানবন্দরে নেমেইতো চেকইন লাগেজ পেয়ে যাব, তখন শীতের কাপড় গায়ে লাগিয়ে বিমান বন্দর থেকে বের হওয়া যাবে।তাই হালকা ধরণের কাপড় পরে ঢাকা থেকে বিমানে উঠলাম। দিল্লিতে কাটালাম এক রাত্রি।ব্যাগ যেভাবে গুছিয়ে ছিলাম সেভাবেই রেখে দিলাম। পরদিন রওনা হলাম কাবুলের উদ্দেশ্যে।
বিমান যখন কাবুলের মাটিতে স্থির হলো তখন দেখি এয়ারপোর্ট টার্মিনালের দূরত্ব কয়েকশ’ গজ এবং যাত্রীদেরকে এ দূরত্ব পাঁয়ে হেঁটে পারি দিতে হবে।ব্যাগ থেকে চাদরটা বের করে গাঁয়ে দিলাম।বিমান থেকে বের হয়ে সিঁড়িতে পা দিতেই মাইনাস ইলাভেনের ধাক্কা।বাতাস, হালকা বৃষ্টি ও ঠান্ডা; সব মিলিয়ে এক ভয়ংকর অবস্থা। কয়েকশ’ গজকে কয়েক মাইল মনে হলো। আমি কি আদৌ টার্মিনালে পৌঁছাতে পারবো?এদিক সেদিক তাকালাম।জাতিসংঘের উপস্থিতি টের পেলাম, ‘ইউ এন’ লেখা কয়েকটি বিশেষ বিমান চোখে পড়ল। নতুন দেশ, ভিন্ন আবহাওয়া, অন্যরকম অভিজ্ঞতা লাভের উত্তেজনায় টার্মিনালে পৌঁছে গেলাম।ইমিগ্রেশেন কাউন্টারের কাছে যেতেই চারদিক থেকে সিগারেটের গন্ধ আসতে লাগল। টার্মিনালের ভেতর কে সিগারেট খায়? কোন বিমান বন্দরেতো এমন অবস্থা দেখিনি। ইমিগ্রেশন অফিসারদের হাতেতো সিগারেট দেখছি না।আসে পাশে তাকিয়ে দেখলাম অনেক যাত্রীর হাতে, মুখে সিগারেট! আমার জানামতে এই একমাত্র বিমান বন্দর যেখানে যেকোন স্থানে সিগারেট খাওয়া যায়। কোন কোন বিমানবন্দরে ধুমপান নিষেধ, কোথাও কোথাও নির্ধারিত স্থানে ধুমপান করা যায়। আর কাবুলে?! পাসপোর্ট নিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসার যখন প্রয়োজনীয় তথ্য লিপিবদ্ধ করেন, যাত্রীরা তখন তাঁদের শরীরে দম দেন। নিশ্চয়ই ধুমপায়ীদের জন্য এটা এক বিশেষ সুবিধা! তবে বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা কেমন হবে এ থেকে কিছুটা হলেও আন্দাজ করা সম্ভব।যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশের বিমানবন্দর কতটা আর ভালো হবে? এখনকার অবস্থা অবশ্য জানি না। কাবুলে কর্মরত সহকর্মীদের কাছ থেকে জানতে হবে।
বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে আমাদের গাড়ি চলছে গেস্ট হাউজের দিকে। রাস্তার দু’ধারের বিল্ডিংগুলোও বিধ্বস্ত- দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে গুলির দাগ।হঠাৎ দেখি সারিবদ্ধভাবে স্কুলের ছেলে মেয়েরা একটা গাছের নিচে বসে খাতায় লিখছে।আফগানী সহকর্মীর কাছে জানতে চাইলাম।তিনি জানালেন যে, যুদ্ধে স্কুল ধ্বংস হয়ে গিয়েছে তাই মাঠে বসে পরীক্ষা দিচ্ছে।তিনি আরো জানালেন, কিছু দিন আগে তালেবান জঙ্গীরা একশনএইড-এর গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিল। গুলিতে গাড়ির ড্রাইভারসহ আমাদের তিন সহকর্মী মারা গিয়েছিলেন। এ সময়ে তিনি আমাদের সতর্ক করলেন যে, অফিসের অনুমতি ছাড়া অর্থাৎ নিরাপত্তার বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে কাবুলের কোথাও আমাদের যাওয়া নিষেধ।গেস্ট হাউজে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেল।বিশেষ ধরনের আফগানী রুটি আর গরুর মাংস দিয়ে কোনরকম রাতের খাবার শেষ করলাম – রুটি ও মাংস দু’টোই এত শক্ত ছিল যে গলাধকরণ করা অনেকটাই ছিল দুষ্কর।গেস্ট হাউজের কেয়ারটেকার এসে গ্যাসচালিত একটা রুম হিটারের কলা কৌশল শিখিয়ে গেলেন।কিছুক্ষণ পর রুম হিটার বন্ধ হয়ে গেল।আমি ও আমার সহকর্মী জাকী হাসান শতবার চেষ্টা করেও সেই রুম হিটার আর চালু করতে পারলাম না।কিছু ক্ষণের মধ্যেই রুম ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগল। রুম হিটার ছাড়া এত ঠান্ডায় রাত কাটাব কী করে? আমরা দু’জন কেয়ারটেকারের খোঁজে বের হলাম। নীচ তলার বিভিন্ন রুমে গিয়ে নক্ করলাম, ডাকাডাকি করলাম কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পেলাম না। রাত তখন কত হবে? খুউব বেশি হলে নয়টা বাজে।কাবুলের মানুষজন কি এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যায়?কেমন যেন ভুতুড়ে ভুতুড়ে লাগছিলো।কাউকে না পেয়ে আবার রুমে চলে আসলাম।আরেক দফা চেষ্টা করেও রুম হিটার আর চালু করতে পারলাম না। নিশ্চিত হলাম যে গ্যাস ফুরিয়ে গিয়েছে তাই চালু হচ্ছে না।রুম হিটার চলছে না কিন্তু রুমের ভেতরতো এতো ঠান্ডা লাগার কথা না। কি আর করা?শীতের কাপড় যা ছিল সব পরে, একটা কম্বল উপরে দিয়ে ঘুমাতে গেলাম।সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করলাম যে জানালার একটা অংশ খোলা। ডিশ এর লাইন টানার কারণে জানালা পুরোপুরি বন্ধ করা হয়নি তবে চেষ্টা করলে ভালোভাবে আটকানো সম্ভব ছিল।এখন বুঝতে পারছি রাতে কেন এত ঠান্ডা লাগছিলো।একেতো মাইনাস ইলাভেন, তার উপর রুম হিটার ছিল না, জানালা খোলা ছিল।মাইনাস তাপমাত্রার প্রথমদিনের অভিজ্ঞতাটা তাই একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল।
দুপুরে একশনএইড অফিসে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো।খাবারের ম্যানুতে ভাত আছে শুনে একটু খুশি হলাম। রাতে খেতে পারিনি, আসলে গত দুই দিন ভাত খায়নি- দিল্লিতে একদিন আর কাবুলের প্রথম দিন।বলাবাহুল্য, ‘মাছে ভাতে বাঙ্গালি’ প্রবাদটি আমার ক্ষেত্রে শতভাগ প্রযোজ্য।দেশের বাইরে যাতবার গিয়েছি, ততবার আমি ভাতের কষ্টে ভোগেছি।লাঞ্চের সময় হলো, আমার প্লেটে ভাত দেয়া হলো।ভাত দেখেই আমার মুখ শুকিয়ে গেল।এটাকে ভাতের প্লেট না বলে কিছমিছের প্লেট বলাই শ্রেয়।ভাত আর কিছমিছের পরিমান প্রায় সমান।কিছমিছ আলাদা করবো না কি ভাত খাব? আমার এ করুন অবস্থা আফগান অফিসে কর্মরত বাংলাদেশি সহকর্মী ইমরান ভাই অবলোকন করলেন।ইমরান ভাই সপরিবারে তখন আফগানিস্তানে থাকতেন, সাথে তাঁর ছোট ভাই রিয়াজও থাকত।ইমরান ভাই বললেন, খাওয়া নিয়ে চিন্তা করবেন না; যে ক’দিন কাবুলে আছেন ততদিন আপনাদের ভাবী বাসা থেকে গেষ্ট হাউজে খাবার পাঠিয়ে দেবে।যেই কথা সেই কাজ, খাবারের আর সমস্যা হলো না। ভাবী ও ইমরান ভাইকে অনেক ধন্যবাদ, ধন্যবাদ রিয়াজ ভাইকে যিনি নিয়মিত খাবার দিয়ে যেতেন [ইস্ যেসব দেশে যেতে হয়েছিল সেসব দেশে যদি একজন করে ইমরান ভাই ও ভাবী থাকত!]।
আমরা কাবুল গিয়েছিলাম সেখানকার সহকর্মীদের এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে।প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে কাবুলের নারী ও পুরুষ গ্রুপ (রিফ্লেক্ট গ্রুপ)ভিসিট করার কথা ছিল।আফগান সহকর্মীরা জানালেন যে পুরুষ হওয়ার কারণে আমরা নারীদের গ্রুপে যেতে পারব না।অংশগ্রহণকারীসহ আমরা দু’টো ভাগে ভাগ হলাম।সিদ্ধান্ত হলো আমরা পুরুষরা যাব পুরুষদের গ্রুপে আর নারী অংশগ্রহণকারীরা যাবেন নারীদের গ্রুপে। আমাদেরকে একটা মাটির তৈরি দু’তলা ঘরের উপরতলায় নিয়ে যাওয়া হলো।মাটির ঘর হলেও মেঝেতে বিছানো ছিল অনেক সুন্দর ও দামী কাপের্ট।আমরা সবাই কার্পেটের উপরই বসলাম। আমাদের সামনে ছিল কিছু নীচু টেবিল। আমরা যে বাড়িতে গিয়েছিলাম সেই বাড়ির মালিক একজন স্থানীয় নেতা। আপ্যায়ন শুরু হলো দুধ ও চকলেট দিয়ে।তাঁদের আতিথেয়তায় সত্যি মুগ্ধ হয়েছিলাম।আলাপ আলোচনা শেষে যখন মূল সড়কের দিকে আসছিলাম তখন চোখে পড়ল পাহাড় বেয়ে নিচের দিকে নেমে পড়েছে পানির নহর, আস্তে আস্তে পানি পড়ছে সেই নহর থেকে। ছোট শিশুরা এসেছে পানি সংগ্রহ করতে। সেটাই নাকি ঐ পাড়ায় খাবার পানির একমাত্র উৎস!গ্রামের রাস্তা দিয়ে ছুটে যেতে দেখলাম মার্সিডিজ গাড়ি।শুনেছি গ্রামে যাঁরা একটু বিত্তশালি তাঁদেরই নাকি গাড়ি আছে!আমাদের গাড়ি ততক্ষণে মূল সড়কে উঠে গিয়েছে, গন্তব্য এখন কাবুল।
পরের দিন প্রশিক্ষণ শেষে, কাবুল থেকে কিছু স্যুভেনির কেনার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম সহকর্মীদের কাছে।বিকেলের দিকে যখন একটি নির্দিষ্ট এলাকার শপিং সেন্টারের দিকে যাওয়ার জন্য মনস্থির করলাম, তখনই সহকর্মীরা তথ্য দিলেন যে কিছুক্ষণ আগে সেখানে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে তাই সেদিকে যাওয়া যাবে না।কাবুলে থাকার সময়ও প্রায় শেষের দিকে। পরে আর সময় পাব না। তাই শহরের অন্যদিকে গেলাম, কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে একটা সুন্দর ফ্লাওয়ার ভাস কিনলাম যেটা আমার সাথে সঙ্গী হয়ে আছে আজও।
কাবুল বিমান বন্দর।প্রবেশ পথে যাত্রীদের ব্যাগ তল্লাশি চলছে।আশে পাশের কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে তল্লাশি ছাড়াই ঢুকে পড়ছে।আমার ব্যাগেতো এমন কিছু নেই যে টাকা দিয়ে পার হতে হবে, একটু না হয় ঝামেলা মনে হবে। তাতে কি? আমি কোন ঘুষ দিব না। আমার ব্যাগ তল্লাশি করা হলো।ইমিগ্র্যাশনের বৈতরণি পার হয়ে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে উঠলাম। বাংলাদেশে ফিরছি ভেবেই মন আনন্দে নেঁচে উঠলো।বিমানের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। এইতো এখনই প্লেন টেইক অফ করবে।কাবুল থেকে দিল্লি, তারপর কলকাতা হয়ে ঢাকায়।একদিন পরই বাংলাদেশে! আহা!কিন্তু নিরাপত্তাজনিত কারণে ফ্লাইট বাতিল করা হলো! সবাইকে নেমে গিয়ে এয়ার ইন্ডিয়ার কাউন্টারের সামনে যাওয়ার অনুরোধ করা হলো।সকল যাত্রীকে পরের দিন একই সময়ে বিমান বন্দরে আসার জন্য পরামর্শ দেয়া হলো।আমার বাংলাদেশে ফেরা একদিন পিছিয়ে গেল।তারচে’ বড় কথা আমার জন্য সামনে আরো অনেক ঝামেলা অপেক্ষা করছে – সব কানেক্টিং ফ্লাইট মিস করব, কোন এয়ারওয়েজের কখন ফ্লাইট কে জানে, ওদের সাথে যোগাযোগ করা, ফ্লাইট কনর্ফাম করা, আরো কত কি। আমার কপাল!
এয়ার ইন্ডিয়া অন্য অনেকের মতো আমাকেও নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কাবুলে থাকার জন্য অনুরোধ করলো। আমি সাফ সাফ জানিয়ে দিলাম যে এটা সম্ভব না। শেষ পর্যন্ত তাদের ব্যবস্থাপনায় কাবুলে আরো একটি রাত্র কাটালাম।ভাগ্য ভালো যে পরের দিন আর কাবুল থাকতে হয়নি। কিন্তু দিল্লি থেকে কলকাতা এসে ঠিকই পড়লাম বিপদে।পরিচিত বিমান বন্দর – দৌঁড়ে গিয়ে ইমিগ্র্যাশন লাইনের প্রথম স্থান দখল করলাম।অনেক রাত হয়ে গিয়েছে, তাড়াতাড়ি বের হতে হবে এখান থেকে, হোটেল খোঁজতে হবে। ইমিগ্র্যাশন কর্মকর্তা যখন জানলেন যে আমি আফগানিস্তান থেকে এসেছি, তিনি আমাকে পাশে একটি জায়গায় অপেক্ষা করতে বলে লাইনের দ্বিতীয় জনকে ঢাকলেন। আমার কাজ এখন লাইনের মানুষ গণনা করে শেষ মানুষটি পর্যন্ত অপেক্ষা করা।আর, কি কি প্রশ্ন করা হতে পারে সে বিষয়ে ভাবা।সময়তো আর বসে থাকে না।সময় চলে যায়।এক সময় আমার ডাক আসলো।কত রকমের প্রশ্ন যে আমাকে করা হলো, তার মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো আমি কেন আফগানিস্তান গিয়েছিলাম (আফগানিস্তান যাওয়ার পর আমি আর যতটা দেশে গিয়েছে প্রায় সবখানেই আমাকে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে)।বিমান বন্দরের বাইরে যখন এলাম তখন গভীর রাত। কলকাতার রাস্তায় কয়েক ঘন্টা টেক্সি করে ঘুরলাম একটা থাকার জায়গা বের করার জন্য। যাহোক, অনেক কষ্টে শেষ পর্যন্ত ঘুমানোর একটা জায়গা পেলাম।ঝক্কি ঝামেলার পালা শেষ।সকাল বেলা থেকেই মনটা খুউব খুশি খুশি। আজ বাংলাদেশে যাচ্ছি।প্রিয় বাংলাদেশ। জন্মভূমি বাংলাদেশ।
টরন্টো, কানাডা
১ মে ২০১৬