নরওয়ে থেকে:-

ছবিটা চাচাতো ভাই নাবিলের হলেও আমাদের বাড়ির ছোট  বড়ো প্রায় সব ছেলেমেয়েরই ছায়া এই ছবিটার মাঝে লেগে আছে , বাড়ির রাস্তার সাথে লাগানো গোরস্তানের পাঁচিলটার মাঝে লেপ্টে আছে বাড়ির সব ছেলেমেয়েদের দেখা আগামীর স্বপ্নগুলো। আর তাইতো কালকে হটাৎ করে ছবিটা দেখে সামান্য কিছু লেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। নাবিল যে পাঁচিলটার উপরে বসে আছে সেটা আমাদের বাড়ির গোরস্তানের পাঁচিল। বাড়ির যে তেরোটা ঘর আছে সে ঘর গুলোর বিগত প্রজন্মের সবাই পাঁচিলটার ভেতরের গোরস্তানে চির নিদ্রায় ঘুমিয়ে আছেন। আমাদের দাদার দাদা থেকে শুরু করে সর্বশেষ আমারদের প্রিয় আব্বাও অনেক যত্নে ওখানে শুয়ে আছেন উনার বাবা দাদাদের পাশে।পাঁচিলটার এক প্রান্ত লেগে আছে সরকারি রাস্তার সাথে অন্য প্রান্তে আমাদের স্মৃতিঘেরা সপ্নীল বাড়ি। সামনে বিস্তৃত মায়াবতী বনুয়ার বিল, বর্ষা আর শরৎ এর দিনে যে বিল জুড়ে সৃষ্টি হয় অপরূপ মায়ার খেলা। আনন্দ অথবা দুঃখের দিন হোক , আমরা বাড়ির ছেলেরা সব সময় এখানে এসে জমায়েত হতাম , আলোচনা করতাম ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক সহ জীবনের সব কিছু নিয়ে। এখনো মনে আছে, বিশেষ দিনগুলোতে আব্বা আম্মা সহ বাড়ির নিকট জনেরা সব সময় বাড়ির রাস্তার শেষ প্রান্তে ওখানেই আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গাড়িতে তুলে দিতেন। বাড়ির কারো কিছু হলে ওখানে দাঁড়িয়েই মর্মাহত হৃদয়ে অপেক্ষা করতাম উনার ফিরে আসবার।প্রতি জুম্মাবারে নামাজ শেষে ঘরে ফেরবার আগে ওই পাঁচিলটার পাশে দাড়িয়েই দাদা, দাদি আব্বা চাচাদের সহ গোরস্তানে শুয়ে থাকা বাড়ির আর সবার জন্য আবেগ, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা ভরে দু হাত তুলে দোয়া করতাম। ছোট দাদার মৃত্যুতে আব্বাকে ঠিক ওখানটাতেই মর্মাহত ভাবে বসে থাকতে দেখেছিলাম।


গ্রামের ছোট, বড় সবাই যখন আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে স্কুল কলেজ কিংবা বাজারে যেতেন, তাদের সবার সাথে কুশল বিনিময় এখানে দাঁড়িয়েই হতো। সেই ২০০১ সালে কলেজ পাশ করে বের হবার পর থেকে লন্ডনে পড়ালেখা করতে যাবার জন্য এ পাঁচিলে বসেই কতজনের সাথে যে ইংলিশ কথা বলা চর্চা করেছি। ২০০৫ সালে ব্রিটিশ এম্বেসীতে ইন্টারভিউ দিয়ে আসবার পর ভিসা কবে হবে সে অপেক্ষায় কতদিন, কত সন্ধ্যা যে ওখানে পার করেছি। ২০১০ সালে নরওয়েতে আসবার আগে ৪ টা মাস কাটিয়ে দিয়েছি ওখানটায় বসে বসে ফিরে গিয়ে নরওয়েতে ফেলে আসা আমার মেয়ের মুখটা দেখার অপেক্ষায় । আমি জানি ঠিক আমার মতো আমার ভাই ও চাচাতো ভাইদের যারাই ইংল্যান্ড আমেরিকায় আছে সবাই ওখানে বসেই স্বপ্ন সাজিয়েছে, পরিশ্রম করেছে এবং স্বপ্নকে সফল করে নিজের গন্তব্যে পৌঁছেছে। আর এখনো যারা বাড়িতে আছে , পড়ালেখা করছে , নিজেকে প্রস্তুত করছে আর স্বপ্ন সাজাচ্ছে , তারাও আমাদের দেখান পথ ধরে আগামীতে কোনো একদিন তাদের গন্তব্যে পৌঁছাবে।
সবুজে ঘেরা লক্ষীর মতো আমাদের গ্রাম, বাড়ির সামনের রূপসী বনুয়ার বিল, ফেলে আসা শৈশব সবই যেন বেঁচেরয়, শত শতাব্দী ধরে ঠিকে থাকে যেন স্বপ্ন আর শৈশবের সাথে লেপ্টে থাকা গোরস্তানের  এই পাঁচিলটা, যেখানে স্বপ্নরা শুরু হয়েছিল, একদিন যেন সেখানেই শেষ হয় জীবনের শেষ দিনগুলো।

ভালোবাসি বাংলাদেশ, স্মৃতির সিলেট শহর, মনোরমা বনুয়ার বিল আর ভালোবাসি স্বপ্নঘেরা ওই পাঁচিলটাকে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন