হাই স্কুলের হেড মাস্টার ইয়াকুব স্যার। ইংরেজীর ক্লাস নিতেন। প্রশাসনিক ভাবে ভীষণ কড়া। এমনকি স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার আগে সবার শরীর চেক করিয়ে পরীক্ষার হলে ঢুকতে দিতেন। যাতে করে নকলের কোন চোতা নিয়ে কেউ পরীক্ষায় বসতে না পারে। স্কুল হোস্টেলে আমার চার রুমমেটের একজন মোস্তফা। মাস তিনেক ধরে কি একটা কবিতার (সম্ভবত প্যাটরিয়ট বা এমনই কিছু একটা) তুমুল প্রস্তুতি নিলো। বিশেষ করে কবিতার সারমর্ম টা। আমার কাছ থেকেও কয়েকবার বিষয়টা বুঝে নিলো। যদিও তার প্রশ্নগুলো অনেকটাই মূল বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কহীন। এটা তাহলে এভাবে কেন হলোনা? ওটা কেন ওভাবে লিখলো? এইসব আর কি। আমার আর এক রুমমেট জাকির ব্যাপারি (ওর ক্লাসমেট) এমন অনুসন্ধিৎসু চরিত্রের জন্যে মোস্তফা কে নিয়ে প্রায়শঃই তাই মজার মজার কটাক্ষ করতো।
ছাত্র জীবনের সবচেয়ে বড়ো যম কে? বাবা? না পরীক্ষার ক্ষণ? আমার কাছে দ্বিতীয় টি নিঃসন্দেহে। সমস্যা হলো আমি তা বুঝলেও সময়ের তো সে বুঝ নেই। সে তার নিয়মেই এই যমটিকে নিয়মিত বিরতিতে জীবনের দুয়ারে এনে হাজির করে। মোস্তফার ক্ষেত্রেও তো তার কোন ব্যতিক্রম ছিলো না। কিন্তু বিভ্রাট টা ঘটলো অন্যখানে। পরীক্ষা শেষে রুমে ফিরে দেখি মোস্তফা গোমড়া মুখো হয়ে বসে আছে। কারন কি? জাকির ব্যাপারিই ঘটনাটা রসিয়ে বললো। যে কবিতাটার আদ্যপান্ত গত তিনমাস ধরে মোস্তফা পড়ে এসেছে সেটির সারাংশের চোতাই সে গাঁটে গুঁজে পরীক্ষা হলে ঢুকতে গিয়ে ধরা খেয়ে পরীক্ষা শুরুর আগেই বহিষ্কৃত!? শুধু বিস্মিতই নয়, বেশ খানিকটা রেগে গিয়ে বলেছিলাম তোর মাথা যে কিভাবে কাজ করে সেটাই আমার মাথায় ঢুকছে না। এ কবিতা বুঝাতে আমার যে সময় নষ্ট হয়েছে এখন সেটাও তুই ফিরিয়ে দিবি। মোস্তফার কথায় আসলে আমার আর একটি দিনের কথাও বেশ মনে পড়ে। তখনকার প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আমাদের স্কুল দর্শনে আসবেন। তাকে স্বাগতম জানানোর জন্যে অনেক উদ্যোগ, অনেক আয়োজন। আগমন নিয়েও অনেক গল্প কথা। স্কুলের সামনে দিয়ে বহমান পানগুছি নদীতে হেলিকপ্টার দিয়ে নামবেন। তাই যুগ যুগান্তর ধরে অচ্ছুত অব্যাবস্হায় পড়ে থাকে নদী ঘাটটা যেন হঠাৎ তার সেই হারানো নূতন যৌবনের চেয়েও অধিক কিছু ফিরে পেতে লাগলো। ঘাটের শুরুতে স্হানীয় হোমরা চোমরারা, পড়ে শিক্ষকেরা, তারপরে স্কুলের সিনিয়র ছাত্র, এভাবেই মানব অর্কেডে নদীঘাট থেকে দুই কৃষ্ণচূঁড়ার মাঝে সুদৃশ্য স্কুলের গেট অবধি তাকে অভিবাধন জানিয়ে স্কুল প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা হবে। মোস্তফা ও সেই লাইনের শেষ প্রান্তে কোথাও একটু জায়গা করে নিয়েছিলো। ধুন্ধুমার অনুষ্ঠান শেষে রুমে ফিরে দেখি মোস্তফা খুশিতে চৌদ্দ টুকরা হয়ে নাচছে। কারন জিজ্ঞেস করতে সে জানালো ‘জিয়াউর রহমানের সাথে সে হ্যান্ডশেক করতে পেরেছে। জীবনে তার আর কোন চাওয়া নেই’। শুনে আমি বললাম জীবনের কাছে যেহেতু তোর আর কোন চাওয়া নেই তাহলে তুই আর একটি মাত্র কাজ করতে পারিস। কৌতুহলী দৃষ্টিতে সে জানতে চাইলো কি? আমি বললাম এবার গিয়ে সুন্দর করে একটা আত্মহত্যা কর।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে কিছু স্মৃতি ভর করে নীমিলিত চোখের পাতায়। কিছু মানুষ, কিছু বন্ধু হেঁটে বেঁড়ায় মনের ডেরায়। কিছু শৈশব, তারুণ্য হামাগুড়ি দেয়। কখনও বা নির্ঘুম রাতের শেষ প্রহর টেনে নিয়ে যায় আর একটি ভোরের দরজায়। এবং এভাবেই..। জীবনটা তো ঠিক দিনের মতো নয় যে চক্রবালে জেগে উঠে চক্রবালে হারিয়ে গিয়ে আবার জেগে উঠে। জীবন যে সুনির্দিষ্ট একটি দিগন্তের দিকেই কেবল ধাবিত হয়। আর এভাবেই সেই দিগন্তের নিভু নিভু আলো যখন দূরবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়াই ক্ষয়িষ্ণু জ্যোতির চোখে দিব্যি ভেসে উঠে তখন মাঝরাতে ঘুম ভাঙা প্রহরের তাৎপর্য যেন আর একটু মাত্রা পায়। তখন কলমে জমে থাকা আধা শুকনো কালিটুকু দিয়ে দুমড়ানো কাগজের পাতায় এভাবেই ঘষাঘষি করতে কখনো মন চায়।
শুরু থেকে এ পর্যন্ত আমার আগাগোড়া লক্ষ্যহীন এই জীবনের মতোই আজকের এই কলম নিয়ে বসা। কোন বিশেষ উদ্দেশ্য বা ভারী কোন দর্শন কিংবা কোন সামাজিক সমস্যা নিয়ে দৌড়ানোর কোন ইচ্ছে আজ নেই। ঐ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে যেমন হয়। পূর্ব নির্ধারিত কিছু নয়। কখনো টুকরো স্মৃতি, কখনো বা পরবর্তী দিনের কিছু পরিকল্পনা কখনো আবার যে স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্নটি দেখে ঘুম ভেঙে গেলো তারই চর্বিত চর্বণ করা।
আমরা সবাই ই নিজের মতো করে একটা শৈশব নিয়ে বেড়ে উঠি। অনেকে জীবনের প্রাক্কালেই ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে ফেলি। সেখানে সন্তানদের নিয়ে বাবা-মার স্বপ্ন পূরণের ও একটা বিশেষ ভূমিকা থাকে। যদিও সে তীর্থে পৌঁছানোর বিষয়টা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সময়ের হাতেই থেকে যায়। আমরা আজ যারা বয়সের হাফ সেঞ্চুরি করে ফেলে হাতের ব্যাট তুলে অভিবাদন নেয়ার পরিবর্তে টাকলা মাথাকে ঢাকার জন্যে (সবাই নয়) নূতন হ্যাটের ডিজাইন খুঁজছি, তাদের কাছে খুব জানতে ইচ্ছে হয়, তরুণ বয়সে এদের মধ্যে শতকরা কতোজন এই বর্তমান অবস্থান বা এর কাছাকাছি কোন জীবনের চিত্র ভাবতে পেরেছিলেন? নিজের কথা বললে বলতে হয় সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষ্যই তো ছিলো না। যদিও এস এস সি পরীক্ষার পূর্বে ‘জীবনের লক্ষ্য’ (aim in life) রচনাটি প্রাণপণে মুখস্থ করেছিলাম। এটাও মনে আছে রচনায় সে লক্ষ্যটি ছিলো প্রকৌশলী (ইঞ্জিনিয়ার) হওয়ার। এটি হতে চাওয়ার পেছনে কিছু কারণ সেখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছিলো যার একটিও এখন আমার মনে নেই। আর যদি বলি আমার তখনকার বোধের জগতের কথা তাহলে বলতে হয় ওটি তখন পরীক্ষায় আসার সমূহ সম্ভাবনা ছিলো বলেই পড়েছি। এ ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন বোধ কাজ করে নি। মনে পড়ে জীবনের লক্ষ্য রচনার জন্যে অন্য দু’একটা বইতে আরও যে পছন্দগুলো দেখেছিলাম তাতে ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে ছিলো, শিক্ষক হবার ইচ্ছে নিয়ে ও একটি রচনা ছিলো। কিন্তু ‘যে পেশায় ই যাই না কেনো জীবনে একজন ভালো মানুষ হতে চাই’ বা একজন সমাজ সেবক হতে চাই, এমন কোন বিষয় নিয়ে কোন রচনা পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। ঐ সময়ে পাঠ্যের আরও একটা বিষয় আমার এখনো হামেশাই মনে পড়ে এবং তা হলো নোট বই থেকে যে ব্যাখ্যা গুলো পড়তাম। ওটাকে এভাবেই সার সংক্ষেপ করা যায় ‘আলোচ্য অংশটুকু কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের… বইয়ের শেষে লেখা থাকতো একজন অভিজ্ঞ প্রধান শিক্ষক (by an expert headmaster)। আর বইখানা অবশ্যই হয় পুঁথিঘর লিঃ বা কাজল ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত’!
বিশ্ব সংসারের প্রতিটা জীবন ই তো এক একটি অনুপম চরিত্র। বৈশ্বিক মহাকাব্যে সবাই ই কিছু না কিছু ভূমিকা রেখে চলে। জীবনে চলার পথে এই চরিত্র গুলোর কোনটি যেমন মনের পটচিত্রে চিরস্থায়ী দাগ কেটে যায় তেমনি কোন ঘটনা, কোন দৃশ্যও হয়ে থাকে সময় জয়ী। বয়সের সাথে সাথে এভাবেই অদ্ভুত এক স্মৃতির বাগান হয়ে যায় এই মনোভূমি। যেখানে কোন পাখি ঘুরে ঘুরে আসে আবার কোন পাখি একবার দেখা দিয়ে হারিয়ে যায় চিরতরে। আর সেই হারিয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই মনের মধ্যে একটা গভীর দাগ রেখে যায়। আজকের নিবন্ধে স্মৃতির ভান্ডার থেকে এমনই দু’একজন বন্ধু এবং তাদের সাথে কিছু কিছু মূহুর্তকে স্মরণ করার চেষ্টা করবো। তার আগে নিজের সম্পর্কে দু’টো সত্যের স্বীকারোক্তি করে নেয়াই ভালো মনে করছি। আমার গোটা ছাত্র জীবনে ক্লাসের ব্যাক বেঞ্চাররাই সব সময় আমার কাছের বন্ধু হয়েছে। শিক্ষক কিংবা গুরুজনদের চোখে যারা আদর্শ ছাত্র বা আদর্শ সন্তান অর্থাৎ যারা খুব ভালো ছাত্র, ভব্য সন্তান তাদের সাথে কখনোই আমার তেমন কোন ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। হয়তো বন্ধুত্ব তৈরীতে আমার যোগ্যতা ঐ পর্যায়ে ছিলো না। বিষয়টি এখনো তেমনি আছে। পেশাগত জীবনেও মোটা চশমা ওয়ালা সুপার পেশাধারী কেতাবী ভব্যতার কারো সাথে আমি এখনো কোন বন্ধুত্ব করতে ব্যর্থ হই। আমার দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিটি হলো, বাস্তবতার নিরিখে আমার মাথাটা (স্মরণ শক্তি) হলো এক অপ্রয়োজনীয় তথ্যের আঁস্তাকুড়। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মর্তবাটা বেমালুম ভুলে গেলেও ১৯৯৪ সালে এসি মিলান আর বার্সেলোনার মাঝে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল খেলায় মিলান যে বার্সেলোনাকে ৪-০ গোলে হারিয়েছিলো শুধু তাই নয় ঐ খেলায় মিলানের পক্ষে সার্বিয়ান স্ট্রাইকার ডেজান সাভিসেভিস দুর্দান্ত খেলে যে একটি গোলও করেছিলেন তা দিব্যি মনে আছে। এমন ভুরিভুরি অপ্রয়োজনীয় তথ্য মাথার স্মরণ কোষগুলোতে গরিলা গুলুর মতো সব সময় সেঁটে থাকে বলে আমার দ্বারা আর কিছুই হলো না..! পার্থিব লোক ত্যাগ করার পূর্বে বাবা এমনই কোন কষ্ট বুকে নিয়ে বিদেয় নিয়েছিলেন কিনা সেতো আর কোনদিন জানা হবে না। আসলে বাবা-মাদের সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি বা জানার জন্যে কৌতুহলী হই। কখনোই তাদের জিজ্ঞেস করিনি তাদের শৈশবের স্বপ্নগুলো কেমন ছিলো? তাদের সুখ-দুঃখের সবচেয়ে বড় স্মৃতিগুলো কি? যারা ভাগ্যবান, যাদের এখনো এই সুযোগটুকু আছে তারা হয়তো এটি করার চেষ্টা করতে পারেন। আর যদি আমার মতো আজীবন আউটসাইডার (outsider) হয়ে থাকেন তাহলে হয়তো হঠাৎ একদিন এমন মনে হলে বুক শূন্য করা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছু থাকবেনা..!
যা হোক সেলিম শিকদারের কথা খুবই মনে পড়ে। সেলিম শিকদার, যার নিক নাম টুকু কিন্তু স্কুল পাড়ায় যে অফিসার নামেই বেশ পরিচিত ছিলো। দশম শ্রেণীতে আমার ক্লাসমেট এবং হোস্টেলে আমার রুমমেট। তার বিখ্যাত ডায়ালগটি আমি এখনো আওরাই মাঝে মাঝে। ‘খাইয়া দাইয়া মইরা যামু, পেটটা ভরা থাকবে চিন্তা কি’? সংক্ষিপ্ত হোস্টেল জীবনে শুধু সেলিম শিকদারের সাথে ঘটনার অভিজ্ঞতা নিয়ে হয়তো একটা শিশু উপন্যাস লেখা যায়। সে প্রচেষ্টা আপাতত না করলেও কিছু ঘটনার উল্লেখ পরবর্তী পর্বে করার চেষ্টা অবশ্যই করবো। চলবে…
ফরিদ তালুকদার / নভেম্বর ৩০, ২০১৯
Beautiful writing. Waiting for the next episode.