১৯২৪ সালে যাত্রা শুরু করা অম্বিকা চরন লাহা পাইলট স্কুলের প্রাঙ্গণ প্রথম দর্শনেই সবার মুগ্ধতা কেড়ে নেয়। স্কুলের উত্তরে বহতা পানগুছির কথা প্রথমেই উল্লেখ করেছি। তারই কিছু দক্ষিণে এসে নদীর সমান্তরালে পূর্ব-পশ্চিমে ধাবিত রাস্তাটি স্কুল প্রাঙ্গণের শরীর ছুঁয়ে গেছে। এই রাস্তা দিয়ে নেমেই স্কুলের প্রধান ফটক। ভিতরে প্রবেশ করে হাতের বাঁয়ে প্রথমেই রয়েছে সমাবেশ মাঠ (Assembly Ground). এই সমাবেশ মাঠেই রয়েছে রবার্ট মোড়েলের স্মৃতি স্তম্ভ। বলাবাহুল্য এই রবার্ট মোড়েলের নামেই উপজেলাটির নাম হয়েছে মোড়েলগঞ্জ। রবার্ট মোড়েলের স্মৃতি স্তম্ভটি শুধু যে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের স্বাক্ষর বহন করে তাই নয়। নীল চাষের অত্যাচার তথা মোড়েলগঞ্জের ছোট ইতিহাস টুকুও স্মরণ করিয়ে দেয়। আর সে কারনেই প্রশ্ন জাগে এই নীল চাষ এবং মোড়েলদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে সেদিনের বিপ্লবী চাষী শহীদ রহিমুল্লার কোন একটি স্মারক চিহ্নও কেন মোড়েলগঞ্জের কোথাও নেই? স্মারক চিহ্ন কেন, এই প্রজন্মের কোন মোড়েলগঞ্জ বাসী আত্মত্যাগী এই রহিমুল্লার নাম কখনো শুনেছে কিনা তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমাদের নিজস্ব পরিচিতিকে তুলে ধরার বিষয়গুলো এমন একপেশে হয় কেন তা আমার মাথায় আসেনা। এর জন্যেও কি আমাদের সেই ভয়ানক রকম আত্মমর্যাদাহীনতাই দায়ী? মোড়েলগঞ্জের ইতিহাস সম্পর্কে কেউ আগ্রহী হলে আমি সুলেখিকা প্রয়াত রিজিয়া রহমানের লেখা ‘অলিখিত উপন্যাস’ বইটি পড়ার অনুরোধ করবো। স্বাধীনতার অব্যাবহিত পরেই সেদিনের বীর মুক্তি যোদ্ধা, মোড়েলগঞ্জের ই সন্তান স. ম. কবির আহমেদ মধু তার এক ভাষনে এই উপজেলাটির নাম পরিবর্তন করে রহিমগঞ্জ রাখার দাবী তুলেছিলেন মনে পড়ে। কিন্তু সেই দাবী সেদিনের বিকেলের বাতাসেই শুধু একবার ধ্বনিত হয়েছিলো মাত্র। এর বেশী কিছু নয়।
বলেছিলাম সেলিম শিকদার এর কথা বলবো। বলি এক আর করি আর এক। এটা যে আমার সমস্যা তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এটা আমাদের জাতিগত সমস্যার পর্যায়েও পড়ে কিনা সেটি বোধ হয় কখনো খতিয়ে দেখা যেতে পারে? যাহোক পথে ফেরার চেষ্টা করি। সমাবেশ মাঠ পাড় হয়ে আর একটু এগোলেই স্কুলের প্রধান ভবন। আর সোজা না গিয়ে ওখান থেকে একটুখানি বাঁয়ে হাঁটলেই আমাদের হোস্টেল বিল্ডিংটি। স্কুলের সর্বদক্ষিণে বেশ বড়সড় একটা খেলার মাঠ। হোস্টেলের পিছনেই রয়েছে সেই বিখ্যাত নীলকুঠি বাড়ী। যেখানে এক সময় রবার্ট মোড়েলের আবাস ছিলো। হোস্টেল আর স্কুলের প্রধান ভবনের মাঝের জায়গাটাকে দখল করে আছে কিছু সাগর কলা আর সব্জির ক্ষেত এবং বিশাল মাপের পুকুরটা। সুতরাং স্কুল ভবন এবং হোস্টেল দাড়িয়ে আছে মুখোমুখি। আরও সরু জানালায় দেখলে বলতে হয় হেড স্যারের রুম আর আমাদের রুমের মুখোমুখি বাস! আর সে কারনেই আমাদের রুমের পিছনের দিকের দুটা জানালার একটির শিক কেটে বাঁকা করে রাখা হয়েছে। উদ্দেশ্য? জানালা গলে লাফ দিয়ে নীচে পড়ে সোজা কুঠি বাড়ির এলাকায় হাওয়া হয়ে যাওয়া। আর এই জিনিয়াস আউডিয়ার ভাস্কর অবশ্যই সেলিম শিকদার তথা অফিসার। তবে এর পেছনে খুবই যুক্তি সংগত দুটি কারন আছে। যার প্রথমটি হলো হেড স্যার হাতে বেত নিয়ে তার রুম থেকে বেড়িয়ে গেলে হোস্টেলের বারান্দা দিয়ে দৌড়ে ভেগে যাওয়ার সময় তার চোখে ধরা পড়ার সমুহ সম্ভাবনা। সেক্ষেত্রে শাস্তির মাত্রা আরও বেশী। তুলনায় স্যারকে বেড় হতে দেখা মাত্র রুমের দরজা বন্ধ করে জানালা গলিয়ে কুঠি বাড়ি এলাকায় গায়েব হয়ে যাওয়াটা শতোভাগ নিরাপদ। পড়ে কখনো জিজ্ঞেস করলেও সহজ উত্তর। খাতা পেন্সিল কিনতে বাজারে গিয়েছিলাম। হেড স্যারের মাথার ব্যারোমিটারটা এই কানাডার আবহাওয়ার চেয়েও বেশী অনিশ্চিত ছিলো। উনি যেদিন পিটাতেন সেদিন পড়া পারা না পারা কোন বিষয় নয়, উত্তর দেয়ার আগেই হয়তো বেত তুলে ফেলেছেন। আর যেদিন ভালো সেদিন অমায়িকতার অবতার। আমাদের কাছে এই মনস্তত্ব নিয়ে গবেষণার চেয়ে তার নাগালের বাইরে চলে যাওয়াটাই অনেক বুদ্ধিমানের কাজ মনে হতো । দ্বিতীয় কারনটা হলো, শীতের সময়ে হোস্টেলের ব্যাডমিন্টন কোর্টটি ছিলো বিল্ডিং এর পিছনে ঠিক আমাদের রুম বরাবর। সুতরাং বারান্দা দিয়ে ঘুরে কোর্টে আসার আর দরকার হতো না। জীবনের মহামূল্যবান বেশ কয়েকটা মুহূর্ত তো আমরা এভাবেই বাঁচিয়েছি। আর তাই এখন রাস্তাঘাটে দীর্ঘ জানযটে আটকে গেলেও তেমন একটা উদ্বিগ্ন হই না! এমন কি এরশাদ আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে জীবন থেকে গুনে গুনে যে তিনটে বছর খুন হয়ে গেলো তাতেও তেমন কিছু ভাবিতো হয়নি!! হে.হে..।
প্রতিটা শিশু (আমার মতে অন্য সকল প্রাণীর শাবকও) পৃথিবীর বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন প্রকার সামাজিক চুক্তির অধীনে শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে থাকে। যার কিছু কিছু লিখিত তবে বেশীর ভাগই অলিখিত। জেনেভায় জন্ম, ফরাসী দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাক রুশো (Jean-Jacques Rousseau) ১৭৬২ সালে প্রকাশিত তার বিখ্যাত বই ‘সামাজিক চুক্তি (Social Contract) এ প্রথম এটি চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করেন। তার মতে এই সামাজিক চুক্তির মাধ্যমেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা প্রকৃতির রাজ্য ছেড়ে সামাজিক জীবনে প্রবেশ করেছিল। এই চুক্তি সর্বস্তরে এবং সব ধরনের সম্পর্কের মধ্যেই বিরাজমান। এমনকি পিতা-মাতার সাথে সন্তানদের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। খৃষ্ট ধর্মমতে রেবেকাকে বিয়ে করে মাইকেল নাম নেয়ার ফলে মধুসূদন দত্তের সাথে তার বাবা রাজনারায়ণ দত্তের সম্পর্কের টানাপোড়েন এর এক বড়ো উদাহরণ। নিবন্ধটি হালকা মেজাজের। সুতরাং এমন ভারী উদাহরণ কেন আনলাম? কারণ আমাদের এই এক পয়সা দু’পয়সার জীবন থেকে উদাহরণ নিলে কারোর তা বোধগম্যই হবে না। আসলে কেউ তার কোন গুরুত্বই দিবে না। আর গুরুত্ব না দিলে বোধগম্য হবে কি করে? সে কারনেই আমরা হর হামেশাই দেখি, জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠান ও সেলিব্রিটিদের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে নিয়োগ করে। নাহ্, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে তারা এমন আহামরি কিছু বলেন না যা আমরা বুঝি না বা আমাদের জীবন বোধের পাতার বাইরে। এগুলো আমরাও হয়তো বহুবার বহুভাবে আওরিয়েছি। কিন্তু আম জনতার কথার মূল্য কি? ঐ একই কথা যখন জীবনের বিভিন্ন পেষায় সফল ব্যাক্তিরা বলেন তখন তা বানী হয়ে যায়, কোট হয়ে যায়। বিষয়টা অনেকটা এরকম, একজন দামী লোক যখন সাদামাটা গোছের পোষাক পড়েন তখন তাও অন্য এক মাত্রা পায়। আর আমার মতো লোক একটা দামী পোষাক পড়লে পোষাকটারই মানহানি ঘটার উপক্রম হয়। এ বিষয়েও প্রায় প্রাসঙ্গিক সেলিম শিকদারের একটা কথা আমার বেশ মনে পড়ে এবং তা হলো ‘ গরীবের মরন চোখ বুঝলেই হইছে। চোখ বুঝলেই বলে বাঁশ কাটো। আর ধনীরা মারা গেলেও বলে আরে মরে নাই স্পেশালিষ্ট ডাকো’। এটাও হয়তো আমাদের অলিখিত সামাজিক চুক্তির আর একটি রূপ। এবং কালের প্রবাহে আমাদের মনোজগতের একটি স্হায়ী রূপ!
সেলিম শিকদারের অফিসার টাইটেল টা কে দিয়েছিলো তার শানে নযুল আমার সঠিক জানা নেই । হয়তোবা নাজমুল। লম্বা ছিপেছিপে গড়নের নাজমুল হোস্টেলে না থাকলেও বেশীরভাগ সময়ই হোস্টেলে আড্ডা দিতো। ওর কথায় পড়ে আসবো। তবে সেলিম শিকদারের অফিসার টাইটেল টা যে যথার্থ তাতে কোন সন্দেহ নেই। নিয়ম ছিলো সিনিয়র ছাত্রদের মধ্যে থেকে পালাক্রমে প্রতিমাসের ম্যানেজার নির্ধারিত হবে। সবার জমা দেয়া টাকা পয়সার হিসেব এবং প্রতিদিনের খাবার তালিকায় কি থাকবে সেগুলো ঠিক করাই মূলতঃ ম্যানেজারের দায়িত্ব। তা ম্যানেজার যেই হোক এর প্রকৃত দায়িত্বে সবসময়ই মূলত সেলিম শিকদার। সামনের ক্ষেত থেকে লুকিয়ে ছাপিয়ে কলাটা সব্জিটা এনে তরকারি হিসেবে চালিয়ে দিয়ে খরচ কমানোর দায়ভার দায়িত্ব সবই যেন তার একার। তরকারির স্বাদ কোনদিন একটু এদিক সেদিক হলে এই একই হোস্টেলে ২০ বছর ধরে রান্না করার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আকবর ভাইকে বলতো ‘আকবর ভাই… তুমি এই পাঠটি পড়ো নাই’! অংকের শিক্ষক অমল স্যার কাঠের ব্যবসা করতেন। তার সাথে দর কষাকষি করে রান্নার কাঠের দায়িত্ব সফল হাতে সে সব সময়ই সামাল দিতো। এ নিয়ে স্যারের সাথে সেলিম শিকদারের আর একটি বাড়তি লেনদেন ছিলো। এবং তা হলো পরীক্ষার আগে স্যারের কাছে অংকের সাজেশনের জন্যে যাওয়া। স্যার ওকে নিরাশ করতেন না, ঠিকই কয়েকটা অংক নির্দিষ্ট করে দিতেন। তাই পরীক্ষার আগে আমরা যখন অংক করতাম মাঝেমধ্যে সেলিম শিকদার উঁকি দিয়ে বলতো ওহ্ এটা? আরে এটাতো এভাবে শুরু করতে হবে। এর চতুর্থ লাইনে গিয়ে তিনশোকে সাত দশমিক পাঁচ দিয়ে ভাগ দিতে হবে। ফাইনাল উত্তর হলো…..। অর্থাৎ স্যারের সাজেশনের অংক সে মোটামুটি সবগুলোই মুখস্হ করে ফেলেছে! সবই ঠিক আছে। তবে পরীক্ষার পূর্ব পর্যন্ত। পরীক্ষার হল থেকে বেড়িয়েই দেখা যেত খিস্তি খেউড় আওরিয়ে সে স্যারের ছাপ্পান্ন গোষ্ঠী উদ্ধার করছে! কারন..? নাহ্ স্যারের দেয়া সাজেশনের অংক পরীক্ষায় আসেনি! সেলিম শিকদার এর সোজা কথা ‘দেখলি তো সালার কাছ থাইকা এতোগুলা টাকার কাঠ কিনলাম আর আমার লগে এমন গাদ্দারিটা করলো?’ স্যার তাহলে এমন কাজটি করলেন কেনো? সমস্যাটা কোথায়? এ প্রশ্ন পাঠকের কাছে রাখলাম। তবে ঘটনাটা হলো স্যার অংক ঠিকই দিয়েছেন। তবে হুবহু নয়, একই নিয়মের। আর ঐ কদিনের জন্যে সেলিম শিকদার এর রোবোটিক স্মৃতি শক্তি তো আর তা বোঝার জন্যে তৈরী হয়নি। তার যে চার এর জায়গায় পাঁচ হলেই সমস্যা!
নদীর স্রোতের মতো, প্রকৃতির ধারার মতোই প্রতিটা মানুষের চরিত্রের একটি সহজাত ধারা থাকে। সময়ের সাথে, বয়সের সাথে সাথে এর কিছুটা পরিবর্তন, পরিমার্জন হয়। কিন্তু অন্তর্নিহিত স্রোতে মূল ধারাটি ঠিকই বহমান থাকে। পরিবেশ পরিস্থিতির কারনে চরিত্রের এই ধারা আবার যে কখনও প্রকাশ হবেনা সেটিও যেমন নিশ্চিত করে বলা যায় না, কখনো কোনদিন কোনো মানুষের এই মূল ধারায় যদি কোন পরিবর্তন দেখা যায় বা নিয়মের ব্যাত্যায় ঘটে তাহলে তার পিছনেও যে বড়ো কোন কারণ নেই তাও ভাবা ঠিক নয়। মানিক বন্দোপাধ্যায় তার বিখ্যাত ছোট গল্প “প্রাগৈতিহাসিক” এ এটি চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন। আর অতি সংক্ষিপ্ত নাজমুলের স্মৃতিতে ডুবে গেলে আমার নিজের মাঝেও এমনি একটি ধারনার জন্ম হয়..! চলবে…
ফরিদ তালুকদার / ডিসেম্বর ১১, ২০১৯