এখন মাঝে মাঝেই সেই দিনে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। যেদিন টা শুরু হতো ময়নার মা চাচী আর আরমান চাচার ঝগড়া দিয়ে। আমাদের বাসার বের হবার ঠিক রাস্তার উপর ওনাদের একটা ঘর। এতোটাই ছোট যে কোন চৌকি পাতার জায়গা ছিল না। চাচী ছোট ছেলে নান্নু ( নাইন্যা) কে নিয়ে আমাদের রান্না ঘরে থাকতেন। আর চাচা চুন্নু কে নিয়ে। খুব সকালে চাচা দাত মাজতে মাজতে আসত,চাচী তখন ব্যস্ত নাস্তা বানাতে।
আমার মাকে দুজনেই বিচারক মানে। এসেই চাচার নালিশ, এই মেয়েছেলে আমার স্বামীর অধিকার দেয় না। রান্না করে না, সেবা করে না, দোজখে ও ওর জাগা হবি না! চাচীর ঝন ঝনানো উত্তর ভাবী তারে যাইবার কন। কি দিছে বুইড়া আমারে। শেষ পর্যন্ত ভিটা বাড়ি বিক্রি কইরা আমারে পথে বসাইছে, রাস্তায় থাকি। উনারে কন হাইট্যা বেহেস্তে যাক। আমারে আর যেন জ্বালায় না।
তখন আমাদের বাসার সামনেই টাইম কলে পানি আসত। যে আগে লাইনে দাঁড়াবে সে আগে যাবে এই নিয়ম। সেখানে প্রতিদিন সকালে ছোট খাট ঝগড়া লাইনে দাড়ান নিয়ে।কেউ কেউ আবার চালাকী করে কলস রেখে যেত। সেই সমস্যার সমাধান ও মুরুব্বীরা করতেন। মালিক না থাকলে কলস পিছনে যাবে। কেউ পানি নিচ্ছে, কেউ রাজনীতি, এই বাড়ী ওই বাড়ীর গল্প, আবার কেউ গামছা কাধে দাঁড়িয়ে থাকত গোসল করার জন্য। পাড়ার উঠতি রোমিওদের দাত মেছাক করা শেষ হতো না যতক্ষন জুলিয়েটদের দেখা না পেত।
ময়নার মা চাচী এর মধ্যে পানি নিয়ে এসে চা রুটি বানানো শুরু করতেন। এতো যে ঝগড়া চাচার সাথে, নাস্তা দিতে ভুল করতেন না। বলত আর যাই হোক সব্বনাইশ্যা স্বামী তো!
আমাদের বাসার একটা বাসা পরেই ওনাদের বাড়ী ছিল। হঠাৎ শুনি চাচা জমি বিক্রি করে দিছে ঘর সহ। ক্রেতা মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিন। চাচীর কান্নায় আকাশ বাতাস একাকার। তিন ছেলে এক মেয়ে নিয়ে যাবে কোথায়?? থাকার জায়গার অভাবে মেয়েকে দিল পাশের বাসায় কাজে, বড় ছেলেকে বিয়ে করালো যাতে অন্য জায়গায় থাকতে পারে। কি অদ্ভুত ভাবে একটা স্বছ্বল পরিবার রাস্তায় বসে গেল।
অবস্থাপন্ন গৃহস্থ পরিবারের মেয়ে সে। খাওয়ার কষ্ট কোনদিন ছিল না। ৭ টা বোনের পরে একভাই তাদের। অনেক আদরের। সেই ভাই সব বোনদের জমি নিজে দলিল করে নিয়েছে। দুঃখ করে মা’র কাছে বলত। কিন্তু চাচার সাধ্য ছিল না তার ভাই এর নামে কিছু বলার। অনেক চেষ্টা করেও চাচীকে দিয়ে তার ভাই এর বাড়ির সম্পত্তি আনাতে পারে নাই।
সারাদিন পরিশ্রম, খাটা খাটুনীর পরেও অদ্ভূত ভাবে হাস্যমুখে থাকতে পারতেন চাচী। ও ভাবী তারে কন তো কি দিছে সে আমারে জ্বালান ছাড়া! চাচার উত্তর ক্যা তোমারে বাক্লাই শাড়ী দেয়া লাগব নি!! আমরা হাসতাম,বাকলাই শাড়ি কি? চাচাকে জিজ্ঞেস করলেই বলতো, ওইত হইলো।
চুন্নু,নান্নু র সাথে লুডু, আর নড়ি গুটি খেলতাম। ওরা আমাদের টিনের ঘরের বারান্দায় থাকত এক সময় । একসাথেই বড় হয়েছি। আর ময়না পাশের বাড়িতে থাকার সুবাদে প্রতিদিন দুই তিনবার আসতো। চাচা তার মেয়েকে খুব ভালোবাসতেন। আমার ময়না পাখী কোথায়রে এভাবে মেয়েকে ডাকতেন । এক ঘোড়া ওয়ালা রাজকুমারের সাথে মেয়েকে বিয়ে দিবেন এই স্বপ্ন ছিল তার।
রাতে চাচীর কাছে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেতাম। এগার বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল ৩০ বছর বয়সের লোকের সাথে। শাশুড়ী বাচা থাকতে তাকে বাবার বাড়ী যেতে দেয়নি। বিয়েতে বর যাত্রীদের ঠিকমতো খাওয়া দেয়নি বলে। কতগুলো বোন, বাপ যাকে পাইছে তার সাথেই বিয়ে দিছে, পাগল ছাগল বাছ বিচার করে নাই। বাপের বাড়ী খাওয়ার অভাব নাই। কিন্তু ভাগ্য দোষে এখন মাইনষের বাড়ী কাজ করি। একটা কথা শুনো মেয়েরা, পড়াশুনা কইরো! “বাপের বাড়ী দালানকোঠা কর্মে আছে মাটি কাটা”। বাপের সম্পত্তি কিছু না। নিজের বাহুবল হইলো আসল।
চাচীর গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম। মনে মনে চিন্তা করতাম একদিন লেখাপড়া শেষ করে চাকুরী করব, চাচীকে খাওয়া পরার কষ্ট করতে দিব না। কাজ করতে দিব না। জ্বর হলে কত পানি ঢালত মাথায়। গরম যাতে না লাগে পাখা দিয়ে বাতাস করতো। হাসি দিয়ে বাড়ী মাতিয়ে রাখতো সারাদিন।
হঠাৎ করেই একদিন তাদের ঘরটা ভেংগে দিল। ওনারা ভাজন ডাংগা গুচ্ছ গ্রামে চলে গেলেন। যাবার সময় আমাদের সেকি কান্না। খুব বেশী দূরে নয়, কিন্তু সারাদিন তো আর দেখা হবে না! হবে কালে ভদ্রে, চাচীর কান্না থামে না। অনেক দিন দেখা নাই, আমি ঢাকায় নিজের সংসারে। বাড়িতে গিয়ে জানতে পারি চাচী খুব অসুস্থ্য। আমি আর মা দেখতে গেলাম। হাত আর ছাড়ে না, বুঝতে পারলাম আমার আশা পূর্ণ হবে না। চুন্নু রিক্সা এক্সিডেন্টে মারা যাবার পর উনি আর বিছানা থেকে উঠতে পারেন নাই। আমি দেখে আসার দু’দিন পরেই চাচী চলে গেলেন। কারোরই কিছু করার সাধ্য থাকলো না। এখন বুঝি যত টুকু সাধ্য তার মধ্য দিয়েই ভালো বাসার মানুষের জন্য কিছু করতে হয়। আমার যখন অনেক টাকা হবে তখন তার ওই প্রয়োজন টা আর মানুষ টাই আর থাকবে না।
ভালোবাসার ঋন কখনোই শোধ হবার নয়। ঋনী ই থেকে গেলাম। মাঝে মাঝেই মনে হয় এতো ভালোবাসার মানুষ গুলো কোথায় হারিয়ে গেল! আর সেই দিন গুলো!!