আমার মা ছিলেন শান্ত একটা নদী বা স্বচ্ছ্ব একটা পুকুর। যেখানে আবর্জনা ভিড়তে দিতেন না। আমার মা মাত্র অষ্টম শ্রেনীতে উঠেছেন, তারপর বিয়ে। কিন্তু এখনো ভাবি আমরা মায়ের কাছ থেকে অনেক কিছুই শিখতে পারিনি।
কলেজে ওঠা পর্যন্ত মায়ের বানানো জামা পড়েছি। আমাদের ঘরে টানানো ছিল হাতে সেলাই করা সিনারী।সেগুলো মায়ের তৈরী। ” সোনার হরিন কোন বনেতে থাকো” যাও পাখী যাও বনে। আরোও কত কি! হাতে বোনা সোয়েটার, আমরা, আমার বাবা, চাচাত ভাইয়েরা সব মায়ের হাতে বানানো। কত করকমের আচার আর পিঠা যে মা বানাতেন! বাড়ীর ছোট বউ আমার মা সব চাচা চাচীরা শধু বলতেন ছোট ব উ এটা বানাই দিও তো। মা খুব খুশী হয়ে এসব করতেন।
আমার মা প্রচন্ড ধর্মভীরু ছিলেন, কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। আমি যখন ৮ বছর পর প্রথম গ্রামের বাড়ী যাই, অনেকে ছালাম দিচ্ছে মাকে, কিছু মেয়ে এমন ভাবে বোরখা দিয়ে চোখ মুখ ঢেকেছে, মা প্রথমেই বলেন আমি বুঝব কিভাবে কার সাথে কথা বলছি? মুখ বের করে কথা বলো। পর্দা করা এক জিনিস আর এভাবে নিজেকে ঢেকে রেখে চলা অন্য জিনিস। শালীনতা বজায় রেখে পোশাক পরো আর মাথায় কাপড় দাও। আমাদের মেয়েরাও স্কুল, কলেজ ইউনিভার্সিটি শেষ করেছে, সমস্যা তো হয় নাই কোনদিন। মা কোন কুসংস্কারকে প্রশয় দিতেন না।
আমার চাচাত বোনের বাড়ী গিয়েছি, আমার ভাগ্নেরা অস্থির নানুর আসতে কোন কষ্ট হইছে কিনা? তোমার নানী কোন রকমে জান নিয়ে আসল। তোমরা শিক্ষিত ছেলেরা এলাকায় থাকতে রাস্তার ভেংগে ইট নিয়ে যায় কারা? ভাগ্নেরা উত্তর দেয় নানু গ্রামের মানুষ আর মহিলারা খুব খারাপ। মা আমার তিন ভাগ্নেকে বলেন, তোমরা তিন ভাই মহিলারদের চৌকির নীচ,রান্নাঘর আর ঊঠান থেকে ইট নিয়ে আসবে। এভাবে মানুষ নিজের এলাকার ক্ষতি করে? ওরা হাসে আর বলে আমার নানু এমপি হলে ভালো হতো ????
আমার মা যখন বাইরে যেতেন সুন্দর করে পরিপাটি হয়ে যেতেন । গোসলের পর মা যখন শরীরে পাউডার আর মুখে একটু ক্রীম লাগতো, কিযে অপূর্ব লাগতো। মা বিশ্বাস করতেন মেয়েদের সব সময় পরিপাটি হয়ে থাকতে হয়। তাতে সংসারে সুখ আসে।
সন্তান, সংসার, স্বামী আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে নাকি সুন্দর জীবন হয়। মায়ের কাছেই শেখা। অনেক দায়িত্ব নিয়ে বড় সংসারে এলাম, মা বলতেন এই তো তোমার দেবররা, ভাশুরের ছেলে লেখা পড়া শেষে চাকুরী নিলেই তোমার দায়িত্ব শেষ। এসব দায়িত্ব পালন করলে আল্লাহ খুশী হোন।
অনেকে বলে শাশুড়ী কখনো মা হয় না। আমার মায়ের তিনটি ছেলের বউ বলবে হ্যা তাদের শাশুড়ী ছিল তাদের বন্ধুর মতো। অনেকে বলতো একি আপনি তো বউদের কিছু বলেন না। মা’ র উত্তর ছিল কি বলব আমার লক্ষী বউদের। বউদের সাথে গল্প করা, মার্কেটে যাওয়া ছিল তার খুব প্রিয়। আমরা মাকে বলতাম, মা আমরা জানি তুমি এখন মেয়েদের ভুলে গেছো! মা হাসতেন বড় বউ সুমী ১৪ বছর থেকেছে মার সাথে, আমেরিকা আসার আগ পর্যন্ত। ছোট বউ ৫ বছর আমেরিকা আসা পর্যন্ত। মেজো বউ লিমিয়ার বেশী থাকা হয় নাই, ও ঢাকায় ছিল, পরে লন্ডনে গেল। কিন্তু একজন মা কিভাবে সব সন্তানদের, একজন শাশুড়ী তার ছেলের বউদের সমান ভালোবাসতেন!!
আমার মা খুব চাইতেন মেয়েরা লেখাপড়া করবে, চাকুরী করবে, স্বামী, সন্তানদের যত্ন করবে সুন্দর সংসার করবে। । আমার লেখাপড়া সম্পূর্ণ করতে পেরেছি আমার মায়ের পূর্ণ সহযোগিতায়। স্বাবলম্বী মেয়েদের মার খুব পছন্দ ছিল।
আমার মনে আছে একদিন এক মহিলা তার অসুস্থ্য বাচ্চা নিয়ে ভিক্ষা করতে আসছিল। মা প্রথমেই সাবান দিয়ে বললো, গোসল করে কাপড় ধুয়ে, প রিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে আসো। তোমার মেয়ের ডায়রিয়া সারবে কেমনে এতো অপরিস্কার থাকলে! তার নাম কমলা। সেই কমলা বু আমাদের বাসায় সপ্তাহ থেকে মেয়ে সুস্থ্য করে ফিরে গেল।
আমাদের বাসার আশে পাশে ফ্যালা ভাই, সোনা ভাই সহ অনেক ছেলে মেয়েদের লেখাপড়াও আমার মায়ের উতসাহে ও সহ যোগিতায় হয়েছে। সবাইকে বলতেন, পরিস্কার পরিছন্ন থাকো। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করাও। ওরা নিজেদের পথ দেখে নিবে।
প্রতিদিন দৈনিকপত্রিকা দীর্ঘসময় নিয়ে পড়তেন। গাফফার চৌধুরীর কলাম মার খুব পছন্দ ছিল। মা খেলা দেখতেন আমাদের ভাই বোন ও তাদের বন্ধুদের সাথে। যত বার চা চাইত কেউ, না ছিল না তার। ওমনি রেডী। রাত জেগে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখা, ক্রিকেট দেখা মার খুব প্রিয় ছিল।
মা কখনো নামাজ কামাই করতেন না। আমাদের নামাজ পড়ার মানুষের জন্য তাগিদ দিতেন। আমি তখন প্রাইমারী স্কুলে পড়ি তখন থেকেই দেখেছি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত “নারী ” পত্রিকা, ঝিনুক মা নিয়মিত পড়তেন। আমাদের ধরা নিষিদ্ধ ছিল ওসব। আমাদের ক্লাসের ছেলেরা মেয়েরা অনায়াসেই আমাদের বাসায় আসত। মা খুব পছন্দ করতেন ওদের আসা।
অন্য মায়েরা যখন খুব গর্ব নিয়ে বলত আমার ছেলে মেয়ে এক গ্লাস পানি ঢেলে খায় না। আমার মা বলত, আমার ছেলে মেয়ে নিজেরা পানি ঢেলে খায় আর মানুষকেও খাওয়ায়।
আমাদের মায়ের হাতে অলিখিত পাওয়ার দেয়াছিল,আমাদের শাসন করার, মার দেয়ার। কারন আব্বা কখনো ছেলে মেয়েদের কাছে ভিলেন হতেন না। মার হাতে পাখা থাকলে ওটা ব্যবহার হতো বাতাস দেয়া আর পিটুনি দেবার কাজে।
বাবা বলতেন তোমার মা আরেকটু লেখাপড়া করলেই ইন্দিরা গান্ধী হয়ে যেত ????
আমার মা রত্না গর্ভার স্বীকৃত পাননি, কিন্তু এলাকার সবাই তাকে রত্না গর্ভা হিসেবে জানে। কেউ পরীক্ষা দিতে যাবে, চাকুরী খুজতে যাবে মাকে ছালাম করে দোয়া নিতে আসতো। এই সুন্দর আমেরিকা, কানাডা তাদের আকৃষ্ট করতে পারেনি, দেশে যাবার জন্য অস্থির থাকতেন।
মায়ের সাথে কত কথা বলতাম, আর কত কিছুইতো বলার ছিল। হয়নি বলা মা!
তুমি যেমন একটা তারা হয়ে জ্বলে আছো আকাশে আমিও একদিন চলে যাব তোমার কাছে। যখন খুব মন খারাপ হয় আমি তোমার সাথে কথা বলি, জানি না তুমি শুনতে পাও কিনা!
এখনো তোমার সাথে অনেক জায়গায় বেড়াতে যেতে ইচ্ছা করে। ছোটো কোনো গ্রামে বা ছোট্ট শহরে । তোমাকে দেখাতে ইচ্ছে করে পৃথবীর সব সুন্দরকে।
তুমি আর বাবা শুয়ে আছো ফরিদপুর শহরের আলীপুরের কবরস্থানে। তোমার আর বাবার কবর জুড়ে সাদা কামিনী ফুল ফোটে। বিলু লাগিয়েছে। আমারও তার আশেপাশে শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। খুব সুন্দর জায়গা।
কিন্তু আমার মেয়েরা যে বলে, তুমি এতো দূরে থাকলে কিভাবে দেখব তোমাকে!! তুমিও যে আমাদের মা।