আমাদের ছেলে বেলায় একটা উৎসব চালু ছিল আমাদের এলাকায় তা হলো গাস্বী। কেন করতাম সেই চিন্তা করার বয়স বা সময় নাই। নিজেরাই স্কুল ছুটি দিতাম, আর বাড়ীতে বলতাম স্কুল ছুটি গাস্বীর কারনে। আমাদের মিয়া ভাই ( চাচাত ভাই) ডেকে বললেন আমরা স্কুল কলেজ পার হয়ে আসছি জীবনে এই উপলক্ষ্যে ছুটি দেয়া দুরে থাক শুনি ও নাই তোরা দল ধরে মিথ্যা বলার শাস্তি আছে। মিয়া ভাইকে আমরা সবাই খুব ভয় পেতাম। আমাদের বাড়ীর যত ছেলে মেয়ে আছে তাদের শাসন আর বেত দিয়ে মারার দায়িত্ব ছিল তারই। এর মধ্যে তার নিজের ছেলে মেয়েরাও ছিল। আমাদের বাড়ীর ১৮/২০ জনের বিচার আচার সাথে গ্রামের আরোও কয়েকজন ছিল আমাদের এই দলে। তো মিয়াভাই ক্ষান্ত দিয়ে বললেন এবারের মত মাফ এর পরের বার আর যেন না শুনি। আমার মিয়া ভাই এর কথা লিখে শেষ করা যাবে না, আমাদের বাড়ির সবার লেখাপড়া, স্কুল, মদ্রাসা নির্মানে তার অব দান চিরদিন কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করব সবাই।
আমার পরীর মতো সুন্দরী নয়া চাচী (আসাদ ভাই এর খালা) র শ্লোক। আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম গাস্বীর নিয়ম। এর কারণ ও আছে, আমাদের ছোট্ট গ্রামটাতে কয়েকজন ফকির ছিল। নতুন ফকির তাদের মুরীদদের কাছে অনেক কারিশ্মা দেখাতে হয় তার মধ্যে গাস্বী, বাশ নাচানো ছিল বিশাল আকর্ষনীয়। বাড়ী থেকে যেহেতু বারন ছিল এই ফকিরদের বাড়ী যেন না যাই, কিন্তু স্কুলে যাবার নাম করে ফকিরবাড়ী কি হয় সব শিখতাম। আমার চাচাত ভাই পচা র স্বপ্ন ই ছিল বড় হয়ে আলেফ ফকিরের মতো হবে। আমরা যেন ওর সাগরেদ হই। আমরা সবাই একবাক্যে রাজী ছিলাম। পড়তে তো হবে না আর!
দুপুর থেকেই আমাদের আয়োজন চল তো। ঊঠানে একজায়গায় গোল করে আউলা মাটি (গোবর ছাড়া) লেপা হতো। তার ভিতরে রাখতাম বড় একটা বাশের তৈরী চালন। সব কিছু সাত টা করে রাখতে হতো। যেমন তালের আঠি ( শাস), নারিকেল,যেকোন ফুল,হলুদ গাছের ফুল পানি সহ, ওটা আচমকা গায়ে ছিটালে পাহর হয় না (শোনা কবিরাজী),বড় ই, বাবালা ফুল যা পেতাম তাই রাখতাম। যেহেতু বাড়ীতে সুবিধা করতে পারতাম না, চিড়া মুড়ি কোথায় পাব। আমরা আমার সেজ খালাকে পটাতাম। খালা আমাদের সবার জন্য, চিড়া, মুড়ি আর নারু বানিয়ে দিতেন। কালা কেশরের পাতা বেটে মাথায় দিতাম,আর হাতে মেন্দী, গায়ে হলুদ দিয়ে সূর্য ওঠার আগে গোসল করতে হবে। ব্যাপক আয়োজন।
সারারাত সবাই এক ঘরে থাকতে হবে ২৫ জনের গ্রুপ। নয়া চাচীর ঘর আমাদের জন্য ফ্রি। আমার চাচা মারা গিয়েছেন অনেক আগে, যে কোন আয়োজনে চাচীর কাছে আব্দার। কেউ ঘুমাবে না, সারারাত কিচ্ছা আর গল্প। আমার খালা আর চাচী আমাদের সাপোর্টার। কাকাদের বোঝাতেন, একদিন এসব করলে কিছু হবে হবে না। পোলাপান এসব করেই। বোনদের বিয়ে হয়ে কে কোথায় যাবে তার ঠিক আছে নাকি! থাক ওরা আনন্দ করুক।
সে পর্যন্ত ঠিক ছিল। আমাদের লিডার পচা বললো এই শোন ফকির বাড়ীতে কিন্তু মধ্য রাতে ঢোল বাজায়, আমাদের তো ওসব নাই, তাই আমরা কাসার থাল কাসার চামচ দিয়ে বাজাব। অনেক শব্দ হবে। ভূত পেত্নী সব দূরে থাকবে। যেই বলা সেই কাজ। সবার ঘরের প্লেট চামচ জোগাড় করে রাখছি। রাত ৩/৪ টা হবে শুরু করছি বাজনা বাজানো। এমন সময় আমার কাকারা উঠে আসছেন সাথে মিয়া ভাই। তাইলে তোমরা সবাই ফকির এখন!! আমাদের আয়োজনে বিস্মিত সবাই। মিয়া ভাই বললেন বিচার হবে যদি আবার ঢোল বাজাও কেউ। মানুষের ঘুম নষ্ট করে এই আয়োজন আবার যদি দেখি!
সকালে গোসল করে, চিড়া, মুড়ি, তালের শাস, নারিকেল দিয়ে শুরু, আর সবাই পাটিতে বসে শুক্তা ভর্তা দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়া। চুল ঘন কালো হবে বলে কালো কেশরের পাতা বাটা মাথায় দেয়া আর চুল লম্বা হবে বলে কলমী লতা দিয়ে চুল ঝারা।
আমাদের বাড়ীটা ছিল যেন আনন্দ বাড়ী। এখনো নয়া চাচীর শ্লোক মনে পড়ে
“আশ্বিনে রান্ধে, কার্তিকে খায়
যে বর মাংগে, সেই বর পায়”
এখনো সন্ধ্যা হলে মুরগী গুলো কি খোপে যায়! বাচ্চাগুলো কি ট্যাউ ট্যাঊ করে? সন্ধ্যায় হারিকেনের চিমনি মেজে কি কেউ পড়তে বসে!
এখনো চাচীর কথা খুব মনে পরে। বলতেন পর আর পর, মা চাচীও করছে পরের ঘর। সোনা মুখীরা বাপের বাড়ীর চন্দ্রস্নানে আনন্দ করো।
আবার যদি একবার যেতে পারতাম সেই আনন্দ বাড়ীতে।