বাংলাদেশে ৬৪ হাজার গ্রাম রয়েছে তন্মধ্যে “এনায়েতপুর” একটা ছোট্ট গ্রাম । কয়েকটি বাড়ি নিয়ে এই গ্রামটি এবং 20/25 মিনিট হাঁটলে সব ক’টা বাড়ি ঘুরে আসা যেতো ।এ গ্রামে হাতে গনা কিছু লোক,মনে হতো একটি একান্ন ভুক্ত বড়ো পরিবার ।কেউ দাদা,কেউ চাচা,কেউ ভাই সবার মধ্যে রয়েছে একটা ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ।ঘর থেকে বার হলে একে অপরের সঙ্গে দেখা,খোঁজ খবর না নিয়ে উপায় নাই । কারো জন্ম দিন,মৃত্যু দিন ,বিবাহ ,মেজবানি এসব আলাপ আলোচনা করে গ্রামে একত্রে হতো । পুরা গ্রামকে মনে হতো একই সূত্রে গাঁথা । মৌলানা গফুর চাচার খানকায় মাসে একবার জিকির আজকার এবং এর সঙ্গে খাওয়া দাও এসব হার হামেশাই হতো । আসলে জিকির আজকার তো নাম মাত্র,মজার মজার খাওয়া,গোস,চিকন চালের পোলাউ,শেষে হব দুধের পিরণি ওটাইতো আকর্ষণ, সারারাত ঘুম মেরে জিকির আজকারের মূল কারণ ।
পুরা গ্রাম গাছ গাছড়ায় ভর্তি ,সন্ধ্যা হলেই পাখির কিচির মিচির সারা গ্রামকে মুখরিত করে তোলা । একেতো নিজেদের দেশীয় পাখি ,তার উপর শীতের মৌসমে অতিথি পাখি,মনে হতো পাখির রাজত্ব । সন্ধ্যা হলেই মনে হয় এত পাখির জগতে আমরা বাস করি । অগ্রহাউন ,পৌষ মাস শীতের মৌসুম ,প্রতিটি ঘরে নুতন ধান ,সবাই কম বেশি ফসল ঘরে উঠানো নিয়ে ব্যাস্ত । সবার মনে আনন্দ নুতন ফসল নিয়ে । সকাল বিকাল গরু দিয়ে ধান মাড়ানি, প্রতিটি ঘর কর্মরত ,মহিলারা ধান সিদ্ধ করা,ধান শুকানো, ঢেকি দিয়ে চাল করা ও গোলা ভর্তি নিয়ে মহা ব্যাস্ত । রাতে খেজুরের রস দিয়ে মিষ্টি পায়েসের সাধ তো আজ ও ভুলতে পারছিনা । খেজুর গাছের নলিতে আঠা দিয়ে পাখি শিকার, মাঠে বক শিকার তা ভুলে গেলে কি ভাবে চলবে ।গ্রামে কোনো বিদ্যুৎ নাই,তাতে কি, হারিকেন ,টর্চ অবশ্যই আছে ।আলো নাই বলে এ বাড়ি,সে বাড়ি বেড়ানো বন্ধ হবে কেন?
বর্ষার দিনে পাট কাটা,পানিতে ভিজিয়ে রাখা,খড়ি থেকে পাট আলাদা করে শুকিয়ে বিক্রি করা এত কৃষকের মহা আনন্দ । বর্ষার রাতে আলো জ্বালিয়ে নৌকায় পুকুর আর খালে মাছ ধরা যে কত আনন্দ তা ভুলে গেলে চলবে কিভাবে ।জ্যান্ত মাছ মা চাচীরা রান্না করবে আর সে না খেয়ে ঘুমাবো,চুলার কাছেই বসে থাকবো,গরম ভাত আর ফ্রেশ মাছের দোপেয়াজা, তার স্বাধই আলাদা, এ কি করে ভুলি ।
জৈষ্ট মাসে বৃষ্টি আর ঝড়ে আম কুড়ানোর ধুম,পাকা আম ,কাঁচা আম আলাদা করো ,কার গাছের আম কত মিষ্টি এতো মুখস্ত । বরষার দিনে পাট শাক ,শাপলা, আর শালুক উঠানো সে তো আর এক দৃশ্য,তবে পানিতে জোঁক আছে সে কথা ভুলে গেলে চলবে কেন । জোঁকে ধরেছে,কিন্তু ওতো রক্ত চোষা,লবন না দিলে ছড়ানো যাবেনা । দাদুর তর্জন গর্জন ,”খবরদার আর কোনোদিন মাঠে পানিতে যাবেনা ।” কিন্তু কার কথা কে শুনে, দাদুকে ফাঁকি দিয়ে মাঠে গিয়ে কই জাল,বড়শি পেতে মাছ ধরা তো এক আনন্দ আজ ও ভুলতে পারিনা । ভাদ্র আশ্বিনে মাজিদ চাচা, হাকিম আর রাশিদ ভাইকে নিয়ে নৌকায় করে মাঠে মাছ ধরা সেতো আর এক কাহিনী । বর্ষায় রুই আর মৃগেল মাছ পুকুরের নালা দিয়ে বের হয়ে ধান আর পাটের জমিতে নড়াচড়া করা ,কৌচ দিয়ে ধরার আনন্দ সে কি ভুলতে পারি। মাছ কটা পাওয়া গেল সেটা বড় কথা নয়,কিন্তু নৌকা নিয়ে মাঠে যাওয়া এক চমৎকার দৃশ্য সে কি আর পাবো. নৌকায় করে বাজারে যাওয়া এবং নৌকায় বসে আখ ,মুরালি কিনে খাওয়ার সাধ তো আজ ও মনে পড়ে ।
এই গ্রামের যত দেন দরবার, জমি জমা,ভাই ভাই ঝগড়া ,স্বামী স্ত্রী ঝগড়া , মীমাংসা করার জন্য ৪/৫জন মুরুব্বি শ্রেণীর লোক তাদের অনেকের নাম আজ আর মনে নাই(হাসমতির বাপ্,কাঞ্চনের বাপ্ ,সেকার বাপ্ ,এগতির বাপ্, মোহাম্মদ আলীর বাপ্ , তবে জমিরউদ্দিন প্রধানিয়া হলো দলীয় নেতা যাকে ব্যাতিত কোনো বিচার কাজ সমাধা হবেনা । সবাই একত্রে কথা বলে,কে কার কথা শুনে । কিন্তু মীমাংসার দায়িত্ব একমাত্র একব্যক্তির উপর । ওকে সবাই শ্রদ্ধা করতো তার সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নিতো । অনেক সময় আবার মীমাংসা হতোনা, সবাই যার যার মতে উঠে যেত ।
পুরা গ্রামে একটিমাত্র মসজিদ,কিন্তু মাঝে মধ্যে সামান্য কিছু নিয়ে ও কাভা কাভা হতো ।যত সব তর্ক বিতর্ক এই মসজিদে আসলে হতো । দেখতে দেখতে জগড়া এমন চরমে পৌঁছলো যে শেষ পয্যন্ত এই ছোট্ট গ্রামে তিনটা মসজিদ হলো । একটিমাত্র ঈদগাহ সবাই একত্রে নামাজ পড়ে ও আলিঙ্গন করে, প্রধানিয়া সাহেব সবাইকে খাওয়ার দাওয়াত করে, মহা আনন্দ, একত্রে খেয়ে দেয়ে যার যেই কাজে কর্মে যায় । ঈদ মানে মহা আনন্দ ,বৎসরে অন্ততঃ দুইবার সারা গ্রামের ছোট বড় সবাই একত্র হয় । কিন্তু কি সব সমস্যা সূত্র ধরে তও আবার গ্রামে দুই ঈদগাহ হয় । কিন্তু দুই ঈদ্গার লোকজন আত্মীয়তাপরায়ণ,সবাই মিলে মিশে একত্রে হৈচৈ করি । মজার জিনিস হলো , এই গ্রামে অতীতে প্রায়ই পুঁথিপাঠ,গল্প বলার আসর হতো, এ সব ভুলে যাবার মতো না । আজ কাল কি পুঁথি পাঠ আর গল্প বলার আসর হয়?
এই গ্রামের মাঝখান দিয়ে একটা খাল বরাবর গ্রামকে বহু যুগ থেকে দুইভাগ করেছে । কোনো সেতু নাই বা থাকলে ও এতই খারাফ অবস্থা যে প্যান্ট শার্ট পড়ে পার হওয়া অনেক কষ্টের । কিন্তু ১৯৮০র দিকে হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ সাহেবের আমলে দেশে যোগাযোগ ব্যাবস্থার অনেক উন্নয়ন হয় এবং সেই সঙ্গে আমাদের গ্রামের ও পাকা রাস্তা,পাকা ব্রিজ হয়েছে ।তাছাড়া প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়েছে । আজকাল প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বিল্ডিং নজরে পড়ে ।
সে যুগে ছেলেরা লুঙ্গি আর মেয়েরা শাড়ি পড়তো । আজকাল ছেলেরা প্যান্ট শার্ট আর মেয়েরা সালোয়ার কামিজ পড়ে । সে যুগে মেয়েরা প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করে বাড়িতে মা চাচীকে সাহায্য করতো.আজকাল মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা দিয়ে পড়াশুনা করে বড় চাকুরী করে.
আমাদের যুগে সারা গ্রামে ৫/৭জন হাতে গোনা শিক্ষিত ছিল ।বাকিদের অধিকাংশ পড়াশুনা জানতো না।বাহির থেকে কোনো চিঠি আসলে লোক খুঁজে বের করতে হতো চিঠি পড়ে শুনানোর জন্য এবং জবাব দেয়ার জন্য।জমি জমার দলিল বা খাজনার কাগজ সবাই পড়তে জানতো না ।কিন্তু আজকাল বাড়ি বাড়ি ও ঘরে ঘরে শিক্ষিত লোক,প্রতি ঘরে অন্তত একজন বিদেশে কাজ করে, এমনটি পাওয়া যাবে । আজকাল এই ছোট্ট গ্রামে অনেক হাইলী এডুকেটেড লোক রয়েছে যথা ডাক্তার ,ইঞ্জিনিয়ার,একাউন্টেন্ট ,টিচার যারা দেশ বিদেশে কাজ করে দেশে রেমিটেন্স পাঠায় । আমাদের বর্তমান প্রজন্ম গ্রাম ও সমাজকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।
আমাদের এনায়েতপুর একটি আদর্শ গ্রাম । এ গ্রামে স্কুল, দাতব্য চিকিৎসালয় ,লাইব্রেরি ও কমিউনিটি সেন্টারে রয়েছে । তা ছাড়া এই গ্রামের এতিম খানা ,মাদ্রাসা ও ইয়ং কমিউনিটি ক্লাব রয়েছে । আমরা এ গ্রামকে একটি আদর্শ গ্রাম হিসাবে গর্ব বোধ করি । যত দূরেই থাকিনা কেন,এ আমার ছোট্ট গ্রাম, তোকে হৃদ্বয়ে ধরে রেখেছি ।
অসাধারণ লিখনি ছিলো, এনায়েতপুর আমার নানা বারি,ছোটবেলায় অনেক সময় সেখানে কাটিয়েছি, আসলেই গ্রামটা অনেক সুন্দর, গ্রামটি আগের মতই আছে গাছ গাছালিতে ভরপুর, কিন্তু আধুনিকতার ছোয়ায় মানুষগুলো আলাদা হয়ে গেছে।।। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ গ্রামটিকে এত সুন্দর করে উপস্থাপন করার জন্য।।