২০০৫ সালের মার্চ মাস । আমি তখন একশনএইড বাংলাদেশের Social Development & Economic Justice সেক্টরের ‘সেক্টর হেড’ । নাসরিন আপা কান্ট্রি ডিরেক্টর। ইতিমধ্যে আমার কানাডা অভিবাসনের সব কাগজপত্র চূড়ান্ত। কানাডার পার্মানেন্ট রেসিডেন্টশিপ এর সীল দেয়া পাসপোর্ট হাতে এসে পৌছেছে। ছয়মাসের মধ্যে কানাডায় আসতে হবে। সিদ্ধান্ত নিলাম চাকরি ছেড়ে দেব। চাকরি ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্তে নাসরিন আপার প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে ভেবে মনের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। দুরু দুরু বুকে Executive Assistant প্যাট্রিসিয়া ব্যানেট আপাকে বলে নাসরিন আপার কক্ষে ঢুকলাম। জানালাম চাকরি ছাড়া এবং কানাডায় অভিবাসনের সিদ্ধান্ত। চেহারা দেখে বুঝা যাচ্ছিলো আমার সিদ্ধান্ত উনার পছন্দ হয়নি, প্রচন্ড রেগে গেছেন। কিন্তু মুখে তেমন কিছুই না বলে শুধু বললেন, “হাসান, জীবন আপনার সিদ্ধান্ত ও আপনার। কিন্তু আপনার সাথে আমার এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আপনি আসুন। আমি পরে এ নিয়ে কথা বলবো।” দুই তিন দিন পরে তখনকার HR Head পারভীন আপা (পারভীন হুদা) আমার রুমে এসে বললেন, “মসিউল ভাই, চাকরিটা একেবারেই না ছেড়ে কিছুদিন ছুটি নিয়ে দেখা যায়না ? চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা না হয় পরেই নিলেন।” পরিষ্কার বুঝতে পারলাম বাংলাদেশের ডাকসাইটে, গুণী এই HR professional নাসরিন আপার সাথে কথা না বলে আমার কাছে আসেননি। সবিনয়ে জানালাম যে দুই নৌকায় পা দিয়ে সামনে এগোনো সঠিক নয় সম্ভবও নয়। যাহোক জানালাম যে চলে যাওয়ার আগে আমার স্থলাভিষিক্ত যিনি হবেন, তাকে আমার বিভাগের সব বিষয়ে সম্পূর্ণ অবহিত করেই তারপর যাবো। ২০০৫ সালের আগস্ট মাসে পাড়ি জমাই কানাডায়।
কানাডায় আসার পরেও নাসরিন আপা ইমেইলে যোগাযোগ রেখেছেন আমার সাথে। ফিরতে চাইলে AAB র দুয়ার খোলা থাকবে আমার জন্য, সেই আশ্বাসও দিয়েছেন। ২০০৬ সালের এপ্রিলে যখন জাকি ( সেই সময়ের REFLECT এর ) ইমেইলে আমাকে নাসরিন আপার মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটির কথা জানায় তখন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। জলজ্যন্ত একজন মানুষ এভাবে চলে যাবেন নিজের ঘরের সামনে, নিজের গাড়ির ড্রাইভারের অসাবধানতায়, দুঘটনায়? টের পাচ্ছিলাম সহকর্মীদের আর্তনাদ। অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন নাসরিন আপা। Senior Management Team এর সদস্য হওয়ার সুবাদে উনাকে অনেক কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। এখনকার অনেক উন্নয়নবিদদের মতো টিভির টকশোতে এসে গলাবাজি করে উন্নয়ন পাকাপোক্ত করার প্রয়োজন হয়নি উনার। যেকোনো বিষয়ের গভীরে ঢুকে যেতে পারতেন সহজে। নিজের বক্তব্য তুলে ধরতেন সুনিপুন, জোরালোভাবে। মনে আছে Local Government Consultative Group on Governance নামে বহুজাতিক দাতা সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত একটি গ্রূপের মিটিঙে নিয়ে যেতেন আমাকে। ব্যক্তিত্ব ও বক্তব্যের ধারে বা ভারের কারণেই হউক, মনোযোগ দিয়ে উনার কথা শুনতেন সবাই। সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে দুস্থ, অসহায় মহিলাদের জন্য ভালো কিছু একটা করার অপ্রতিরোধ্য মনোভাব, প্রেরণা তাড়িয়ে বেড়াতো নাসরিন আপাকে। সেজন্য যেকোনো পরিবেশে উনাদের সাথে মিশে যেতে পারতেন অনায়াসে। আমি বলবো সাধারণ মানুষ বিশেষ করে মহিলাদের উন্নয়নের জন্য একধরণের ‘missionary zeal’ নিয়ে কাজ করেছেন নাসরিন আপা । কোনো ভয়, ভীতি, বৈরী পরিবেশ কোনো কিছুই উনাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
কাজী নজরুল ইসলামের গজলের একটি লাইন আমার খুব প্রিয়। লাইনটি হচ্ছে, “আমার যখন পথ ফুরাবে, আসবে গহীন রাতি, খোদা আমার যখন পথ ফুরাবে”। পথ আমাদের সবারই ফুরাবে। এই পথ ফুরানোকে কেউ মনে রাখবে, কেউ মনে রাখবে না । পথ ফুরালেও নাসরিন আপার মতো মানুষকে মানুষ মনে রাখে তার কীর্তিতে, শ্রদ্ধায়, প্রার্থনায়। মৃত্যুবার্ষিকীতে তার বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। প্রার্থনা করি পরম করুনাময় আল্লাহ্পাক তার অসীম দয়ার গুণে নাসরিন আপাকে ক্ষমা করুন, উনার আত্মাকে রাখুন জান্নাতের ছায়ায়।