ফারহানা আফরোজ, ২০১৮ এর শ্রেষ্ট সংবাদ বাহক।
জীবন যেমন ভালো খারাপ মিলিয়ে, তেমনি একটি বছর যেহেতু জীবনের বাইরে নয় তাই সেখানেও থাকবে ভালো এবং খারাপ সময়। আমার কাছে তাই নতুন বছরের রেসুলেশন; সামনে কি করবো তার থেকে পিছনের ভালো কিছু ঘটে থাকলে সেটা স্মরণ করে, খারাপটির থেকে শিক্ষা নিয়েই সামনে এগিয়ে চলা। ভালো খারাপ মিলিয়েই আমার বছরটি গেছে। তবে খারাপটিকে আর মনে ধরে রেখে মনকে পীড়া দিতে চাই না, তা ছাড়া আপনাদেরকেও সেগুলি শুনাতে চাই না।
বেশ কিছু ভালো জিনিসের মধ্যে গত বছরের দুটি অন্যতম জিনিস আমি উল্লেখ করছি, কারণ এগুলির থেকে উৎসাহ পাওয়া বা inspired হওয়ার মতো কিছু থাকতে পারে। প্রথমত, গত ২০১৭তে আমার মাত্র ৯ বছর বয়সের ভাগ্নের বাবার সড়ক দুর্ঘটনা এবং অবশেষে তার মৃত্যু ছিল একটি কঠিন এবং করুন বিষয়। তবে গত বছরের ভালো লাগার এবং আশার বিষয় এই যে, সে তার বাবা হারার শোক, তার প্রিয় ইস্কুল, বন্ধু বান্ধব ছেড়ে বলতে গেলে নতুন জায়গায় নতুন করে জীবন শুরু করে আল্লাহর রহমতে তার ইস্কুলে খুব ভালো রেজাল্ট করার মাধ্যমে চতুর্থ শ্রেণীতে উন্নতি হয়েছে। এবং এখনো পর্যন্ত তার বাবার মতো সৎ এবং ভালো মানুষ হওয়ার ব্রত নিয়ে অগাস্ছে। এর থেকে আর বড়ো পাওয়া আর কি থাকতে পারে, তাই সমস্ত সমস্যা থাকলেও এমন একটি ঘটনা মনকে বেশ শান্তি দেয়। সামনে তার অনেক দিন পড়ে আছে, আপনাদের কাছে দোআ প্রাথী।
এবার দ্বিতীয় ঘটনায় আসি। এবার এমন একজনের কথা বলবো যাকে আমি জীবনে আগে কখনো দেখি নাই বা তার কথাও শুনি নাই। উনি একজন বাংলাদেশী কানাডিয়ান ইমিগ্র্যান্ট। মাত্র দুই বছরের কম সময়ে কানাডাতে। পেশায় একজন psychologist এবং গবেষক। এই বেক্তিটি আমাদের গতানুগতিক চিন্তাধারা বা assumption কে ভুল প্রমাণিত করেছেন। যেমন, আমি নিজে যথাযত তথ্য এবং গাইডেন্সের অভাবে এদেশে নিজেকে সেটেল্ড করতে অনেক সময় নষ্ট করেছি এবং অনেক স্ট্রাগগল করতে হয়েছে। তাই আমার আশা ছিল যদি কখনো ওই কষ্টের সময় পার হয়, তাহলে কিছুটা হলেও নতুনদের যাতে করে আমার মতো অতো সময় নষ্ট না হয় সেই চেষ্টা করবো, অন্তত অবসরের কিছু সময় ব্যয় করে। হাঁ, আমি যার কথা বলছি, তার নাম ফারহানা আফরোজ। ফারহানা, তার স্বামী এবং দুটি যমজ সন্তানসহ একটি ছোট সুন্দর পরিবার, তবে কানাডার শুরুর জীবনটা খুব সুন্দর ছিল না।
ফারহানার সাথে আমার পরিচয় হয় BCCBর মাধ্যমে। উনাকে আবার BCCBতে যোগ করেন আমার স্নেহভাজন psychologist সাইফুল, ওয়াদুদ এবং আরো ২/১ জন। উনি বাংলাদেশ থেকে উনার বর জাফর ভাই সহ আমেরিকাতে যান। সেখানে কিছু পড়াশুনা এবং গবেষণা সেরে কানাডাতে ইমিগ্র্যান্ট হয়ে আসেন। আমেরিকাতে থাকা অবস্থায় উনি মনে হয় আমার একটি লেখা পড়ে আমার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। উনি এখানে পড়াশুনা, চাকরি বাকরি ইত্যাদি সমন্ধে জানতে চাসছিলেন। আমি যাতে আমার বা উনার সময় নষ্ট না হয় সে জন্য উনার রেসুমীটা পাঠাতে বলেছিলাম, কারণ উনার প্রয়োজনীয় তথ্য আমার কাছে নাও থাকতে পারে; তাছাড়া উনার সম্মন্ধে জানলে কম কথায় কাজ সারা যাবে। উনি যখন উনার রেসুমিটা পাঠালেন, আমি সেটি দেখে বেশ impressed হলাম এবং সাথে সাথে মনে হলো উনার এখানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে খুব বেশি সময় লাগবে না। তার বিষয়টি psychology হলেও আমার কাজের সাথে অনেক মিল আছে তাই উনার সাথে আরো যোগাযোগ হলো। উনাকে কিছু তথ্য দিলাম এবং যেহেতু তার পড়াশুনা বা কাজের অভিজ্ঞতা ছিল তাই আমি উনাকে বড়সড়ো কোনো ডিগ্রি করতে নিষেদ করলাম।
এর পর উনি কানাডাতে এলেন, এবং আসার শুরুটা হলো খুব কষ্টের। আমি আর সেই অভিজ্ঞতায় গেলাম না। উনি, আমি নিজে যে bridging প্রোগ্রামে পড়েছিলাম সেখানেই ভর্তি পরীক্ষা দিলেন এবং চান্স পেলেন। এর মধ্যে আসলো আর এক চ্যালেঞ্জ। উনি তখন দুটি সন্তা নিয়ে প্রেগনেট হলেন। এ সময় ভাইয়ের তেমন কোনো চাকরি হয় নি, উনিও কিছু করেন না। বুঝতেই পারছেন। ইউনিভার্সিটি তাকে এক বছর ছুটি নিতে বললো এবং পরবর্তী বছরে তাকে কোর্সটি করার অনুমতি দিলেন।
মাঝে মধ্যে কথা হয়। উনি উনার যোগ্যতা অনুযায়ী প্রফেশনের কথা বাদ দিয়ে মনে করছিলেন যে কোনোমতে walmart, tim horton, canadian tire ইত্যাদি কোনো এক জায়গায় ঢুকলেই উনি জায়গা করে নিতে পারবেন এবং একদিন ওখানে ম্যানেজার হয়ে যাবেন। তার প্লানটি খারাপ ছিল না, কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম উনি চেষ্টা করলে উনার দক্ষতা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী তার স্বীয় প্রফেশনেই ভালো কিছু করতে পারবেন। উনি যখন হসপিটালে তখনও আমি বলেছি, যাই করেন না কেন আপনাকে কিন্তু আপনার প্রফেশনে যেতে হবে, সে যত দেরিই হোক, “because you have that ability.” I knew she was more stronger and smarter than she thought.
উনি উনার বাচ্চা ডেলিভারির জন্য যখন হসপিটালে ভর্তি, তখন ওই অবস্থায় উনি আমার দেওয়া City of Torontoর একটি জব পোস্টিং দেখেন, এবং সেখানে আবেদনে করেন। এর পর উনি উনার দুটি ফুটফুটে যমজ সন্তান নিয়ে বাসায় চলে আসেন। হটাৎ একদিন ফোন করে বলেন উনাকে সিটি ইন্টারভিউ এবং পরীক্ষার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে। উনার থেকে আমার বেশি ভালো লাগলো কারণ সিটির একটি পদে ডাক পেতে আমাকে প্রায় দু বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে, আর উনি আসার কয়েক মাসের মধ্যে ডাক পেলেন। উনি ambivalance ছিলেন পরীক্ষা দিতে যাবেন কি না, কারণ তখন তো চাকরি করার মতো অবস্থা নেই। আমি বলেছিলাম চাকরি দরকার নেই, পরীক্ষা দিতে অবশই যাবেন। ভাইয়ের যদি বেবিসিটিং করতে হেল্প লাগে আমি যাবো। যাহোক উনি ওই অবস্থাতে আমাদের অয়োজন করা একটি প্রস্তুতিমূলক আলোচনায় যোগ দেন এবং ভালোভাবে পরীক্ষা দেন। যদিও উনি শেষ পর্যন্ত জানাননি, কিন্তু এটি উনার ক্যারিয়ারের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকলো।
আমি উনাকে বললাম উনার শুধু এখন সময়ের বেপার, অতএব এখন তাকে তার বাচ্চাদের প্রতি নজর দেওয়া দরকার, things will surely come along. এগুলি সবই উনাদের এখানে আসার মাত্র কয়েকমাসের মধ্যে। যাহোক ওই দুই বচ্চা নিয়ে, নতুন জায়গায়, নতুন সংসার, কারোরই চাকরি নেই; মোটামুটি ভালোই ordeal চলছিল। ইতিমধ্যে আল্লাহর রহমতে জাফর ভাইয়ের Nova Scotiaতে তার প্রফেশনে একটি সুন্দর চাকরি হয়ে যায়। খুবই দ্রুত তাদেরকে ওখানে চলে যেতে হয়। আমি যেটা সবাইকে বলি যে, আপনার আপাতত চাকরি না লাগলেও মাঝে মধ্যে চাকরির আবেদন করতে হবে কারণ আপনি জব মার্কেটের ট্রেন্ডটা সমন্ধে জানতে পারবেন। ফারহানা নিজের থেকেই সেটা করছিলেন।
হটাৎ করে উনাকে ওখানকার একটি কলেজে বিশেষ একটি পদের জন্য ইন্টারভিউতে ডাকা হলো। উনি ইন্টারভিউ দিলেন। উক্ত পদে internal ক্যান্ডিডেট থাকায় উনার আর সেই চাকরি হলো না। কিন্তু উনি ইন্টারভিউতে এতো ভালো করলেন যে উনাকে তারা ছাড়তে চাসছিলেন না। তাই তারা উনাকে ৩-৬ মাসের জন্য, একটি স্টুডেন্ট এডভাইসরের পদের জন্য চাকরি অফার করলেন। বলতে গেলে এই পদটি তারা উনার জন্যেই তৈরী করেন। উনি শুরু করলেন। কন্টাক্ট শেষ হওয়ার আগে উনি আরো দুই একটি চাকরির আবেদন করলেন এবং উনার বাসা থেকে দূরে অন্য একটি চাকরির মোটামুটি সব ঠিক থাকে। এদিকে উনার ওই কলেজের বস উনাকে নতুন চাকরিতে দ্রুত কথা না দিতে বললেন, কারণ তারা চেষ্টা করছে তার বর্তমান চাকরিটাকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য। আমি উনাকে বললাম দুদিকেই যোগাযোগ রাখতে। এর মধ্যে বেশ কিছুদিন গেলো। বেস্ততায় যোগাযোগ করা হয় না। হটাৎ করে গত নভেম্বরের ২৬ তারিখে নিচের কয়টি লাইন লেখা একটি অফার লেটারের কিছুটাসহ একটি স্ক্রিনশট আমার ইনবক্সে এলো। অন্য কোনো লেখা বা অন্য কিছু নেই। যেহেত আগেই জানতাম তাই বুঝতে আর অসুবিধা হলো না যে তারা তাকে চাকরিটি continue করার অফার দিয়েছেন। “Dear Farhana, I am pleased to confirm the offer to extend your term, full-time employment as a Student Advisor & International Supports with Nova Scotia Community College effective December 21, 2018 and ending approximately December 22, 2020.
বলতে পারেন ওই মেসেজটি ছিল গত ২০১৮ এ আমার সব থেকে খুশির এবং ভালো লাগার খবর। একটি মানুষের শত ঝামেলার মাঝেও এখানে এসে বিন্দু মাত্র সময় নষ্ট করতে হয় নি, বরং কানাডিয়ান পড়াশুনা বা কাজের কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই তার অতি পছন্দের একটি চাকরি হয়ে গেলো। আর তার এবং তার পরিবারের এই journeyর অতি ক্ষুদ্র একটি অংশের সাথী হতে পেরে আমার খুব ভালো লেগেছে, তাইতো গত বছরে খারাপ সময় যাই কাটুক না কেন, সেটিকে ছাপিয়ে যায় ফারহানা আপা আর জাফর ভাইদের এমন সংবাদে। আমার বিশ্বাস উনার মতো চেষ্টা করলে আপনাদেরও পূর্বের পড়াশুনা এবং অভিজ্ঞতা দিয়েই কাজ হতে পারে। তবে হাঁ, উনার কমিউনিকেশন ইংরেজি অনেক ভালো। আমি appreciate করি জাফর ভাইকে ফারহানাকে তার অবিরত সাপোর্টের জন্য, যেটি অনেক হাসব্যান্ড এর ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
ফারহানাকে আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম, আপনি আমাকে যে appreciate করলেন আমার সাপোর্টের জন্য, কিন্তু আমিতো তেমন কিছু করিনি বা করার সময় পাইনি। উনার উত্তর ছিল, ” আপনি আমার ড্রিমটাকে জাগিয়ে রাখতে সাহায্য করেছিলেন, যেটা ছিল আমার জন্য সব থেকে বেপার বেপার” . তাই সবাইকে বলি মানুষের জন্য কিছু করতে হলে সব সময় বেশি সময় বা অনেক সাপোর্ট দরকার হয় না। আপনি জানেন না আপনার কোন কথায় কার কখন কি কাজে আসবে। কিছু না হলেও, অল্প একটু সময় নিয়ে actively অন্যের কিছু কথা শুনুন এবং পারলে তাকে তার আশাটিকে হতাশ না করে জাগিয়ে রাখতে সহায়তা করুন, এতেই অনেকের অনেক কাজে আসতে পারে।
অনেকে হয়তো চাইবে আপনি এর থেকে বেশি কিছু করেন কিন্তু আপনি হয়তো সেটা পারবেন না, তথাপি আপনার স্রেফ কিছু কোথায় অন্তত একজনেরও কোনো উপকার হলে তাতে কম কিসের।
আমি শুরুতে যেমন বলেছিলাম, আমার বা আমার মতো অনেকের কমুনিটির জন্য কিছু করতে পারলে সব থেকে আনন্দের বিষয় তখনি হয় যখন আমার মতো অন্যকে suffer করতে না হয়, এবং লক্ষ্যে পৌঁছাতে আমার থেকে কম সময় লাগে। মিস ফারহানা তেমনি একটি উদাহরণ। আর হাঁ, ফারহানার উদাহরণ কোনো নিরবিছিন্ন ঘটনা নয়, ইদানীনং নতুন আসা অনেক ইম্মিগ্রান্টদের মধ্যে এটি দেখতে পাসছি, যেটি শত চ্যালেঞ্জের মধ্যেও অনেক আশাব্যাঞ্জক। নিজের কাজ, পরিবার এবং অন্নান্ন কাজের মধ্যেও অবসরের কিছুটা সময় ব্যয় করে অন্যের জন্য কিছু করা কোনো নেতা হওয়ার জন্য না, কোনো দল করা, কোনো গোপন ফায়দা লোটা বা কোনো নাম কামানোর জন্য নয়, ঠিক ফারহানার মতো মানুষদের কাছ থেকে মাঝে মাঝে এমনি খবর শুনে ভালো লাগার এবং ভালো ফিল করার জন্য।
ফারহানা, কোথাও কোনো ভুল থাকলে নিজ গুনে সংশোধন করবেন।
নতুন বছরের সুভেসছাসহ সবাইকে ধন্যবাদ। দোআ করবেন যেন এই নতুন বছরে এমনি আরো দেশি ভাই বোনের খবর আপনাদেরকে দিতে পারি।
মুকুল
টরন্টো