কুইন সাবওয়ে থেকে বেরিয়ে এসে ডানদিকে মিনিট চারেক হাঁটলেই চোঁখে পড়বে টরোন্টোর একটি বিখ্যাত হাসপাতাল। সেন্ট মাইকেল হসপিটাল। এই হাসপাতালে মাঝে মাঝে আসতে হয় স্টিফেন নামে (ছদ্মনাম) এক ক্লায়েন্টের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সেবার জন্য। করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতার কারণে বেশিরভাগ ডাক্তাররাই এখন Virtual  Consultancy & Treatment এর পন্থা অবলম্বন করছেন। সহজ ভাবে বললে এর অর্থ দাঁড়ায় ফোন অথবা ভিডিওর মাধ্যমে চিকিৎসা বিষয়ক পরামর্শ দেয়া। তবে জটিল শারীরিক বা মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক চ্যালেঞ্জ থাকলে এর ব্যতিক্রম করতেও এখানকার ডাক্তাররা দ্বিধান্বিত হন না । স্টিফেনের রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা অস্বাভাবিক কমে যাওয়া এবং এর সাথে Internal Bleeding এর কোনো সম্পর্ক আছে কিনা তা নির্ধারণ করা সংক্রান্ত আলোচনা আজকে হাসপাতালে আসার মূল কারণ। আমার এই ক্লায়েন্ট অসম্ভব রকমের পড়ুয়া। যেকোনো  সাক্ষাতের জন্য যাওয়ার সময়ও তার হাতে ঢাউস সাইজের বই থাকে। যাহোক সাবওয়ে থেকে বেরিয়ে রাস্তার উল্টোদিকে টিম হর্টন থেকে ক্লায়েন্ট এবং নিজের জন্য কফি নিয়ে হাসপাতাল অভিমুখে হাটছি।পাশাপাশি হাটছে স্টিফেন। তার মনে কি উদয় হলো জানিনা, হাটতে হাটতেই হঠাৎ স্টিফেনের প্রশ্ন, “Do you think people will ever remember you once the life bird leaves your body ?” দেহের খাঁচা ছেড়ে প্রাণপাখি উড়ে যাওয়ার পর কেউ কি আমাকে মনে রাখবে ? জটিল, মারফতি জিজ্ঞাসা। স্থান, কাল, পাত্রভেদে এর কয়েকরকম উত্তর দেয়া যায় । জেমস প্যাটারসন, লি চাইল্ড এর মার্ডার মিস্ট্রি বা স্পাই থ্রিলার এ বুদ্ হয়ে থাকা কারো কাছ থেকে এরকম দার্শনিক প্রশ্নে কিছুটা থমকে যাওয়াই স্বাভাবিক। একটু সময় নিয়ে উত্তর দিলাম, “It all depends on the legacy you leave behind” । মনে হলো আমার উত্তর তার সন্তুষ্টির পর্যায়ে যায়নি। আবারো জিজ্ঞেস করলো, “What happens when I have no legacy to leave behind, no foot print at all?”  উত্তরে বললাম, “Well, in that case, people will remember you as who you were. Perhaps as a good or not so good human being.”। এই পরজাগতিক আলাপচারিতা বেশিক্ষন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ততক্ষনে পৌঁছে গেছি হাসপাতালের প্রবেশমুখে, Visitor Screener দের সামনে। শুরু হয়ে গেছে প্রশ্নবান, “Do you have fever, runny nose, cough, Did you travel outside of Canada in the last 14 days ………..” ?   Screening এর পালা শেষ করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম Dr Erik Tseng এর অফিসে।

কানাডিয়ান মানুষদের একটি বিষয় আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, মন ভরে উঠে শ্রদ্ধায়। এরা অকাতরে দান করেন। হাজার, হাজার, মিলিয়ন ডলার। নিজে যেহেতু স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে কাজ করি, সেজন্য এই ক্ষেত্রে তাদের অবদান বেশি চোঁখে পড়ে । অনেকে নাম প্রকাশ করেন, অনেকে করেন না । টরোন্টোর অনেক হাসপাতালে দেখি কিছু কিছু জরুরি বিভাগেও ( heart, oncology, neurosurgery)  এরা দুহাতে দান করে গেছেন। কোনো কোনো হাসপাতালে এই সব মহতীপ্রাণ দাতাদের নামের তালিকাও দেখতে পাই। অনেকে নিজের বাড়িঘর, এস্টেট, সহায়-সম্পত্তি, হাসপাতাল বা অন্যান্য জনহিতকর কাজের জন্য দান করে যান নীরবে, অনেকের  অজান্তে। শুধু হাসপাতালই নয়, সাধারণ মানুষের উপকারে আসে, এমন অনেক স্থানেই তাদের দানের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়। অনেক ন্যাশনাল পার্ক যেখানে অগুনতি মানুষ হাঁটেন, হাইকিং করেন, সেখানেও জায়গায়, জায়গায় পরিশ্রান্ত মানুষের বসার জন্য চমৎকার বেঞ্চ পাতা থাকে। অনেক সময়  বেঞ্চে লেখা থাকে, “In loving memory of ——“। চিরস্থায়ী নাগরিকত্ব নিয়ে আমরা কেউই দুনিয়াতে আসিনি। রবিন শর্মার ভাষায়, “Our life is mere blip in the canvas of eternity” । আজ থেকে পঞ্চাশ, সত্তর, একশত বছর পরে অথবা তারও আগে আমরা কেউই হয়তো থাকবোনা। কিন্তু রেখে যাওয়া এই সব legacy বা foot print থেকে যাবে। জানান দেবে যে দুনিয়াতে কিছু ভালো মানুষ ছিল যারা অচেনা, অজানা সাধারণ মানুষের শান্তি, স্বস্তির জন্য কিছু উপকরণ রেখে গেছেন। মানুষকে ধর্ম বা বর্ণের আবরণে না ঢেকে নিজেদের অজান্তেই হয়তো তারা সৃষ্টির সেবা করে গেছেন। স্পর্শ করতে পেরেছেন হাজারো মানুষের হৃদয়। মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে যাওয়ার মতো বড় Legacy আর কি কিছু হতে পারে ?

সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন