স্কুলে মাধ্যমিক পর্যায়ে আমাদের ভাবসম্প্রারণ পাঠ্যসূচির অন্তর্ভূক্ত ছিল। এখন ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্ররা এসব আর পড়ে না। তারা এসবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত। ডিভাইসের যুগে গেম খেলাতেই সব আনন্দ তাদের। পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র হাতে পেলে আগেই দেখে নিতাম কোনটা কমন পড়লো। পরীক্ষা শেষে বন্ধুদের সাথে এবিষয়ে আলোচনা চলতো তুমুল। যেমন – “কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেনো কমল তুলিতে, দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহিতে”? ” “উত্তম নিশ্চিতে চলে অধমের সাথে, তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে”। “যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি, আশু গৃহে তার দেখিবে না আর নিশীথে প্রদীপ বাতি”। “অসির চেয়ে মসি বড়”। অর্থই অনর্থের মূল”।

দীর্ঘদিন যাবৎ আমি হোমিওপ্যাথি ঔষধ নিচ্ছি। হোমিওপ্যাথি ঔষধ প্রসঙ্গে আমার এক অগ্রজ আমাকে বলেন, “যার নাই কোনো গতি, সে খায় হোমিওপ্যাথি”। স্বাধীনতার পর আমি থাকি নারায়ণগঞ্জ, আপা থাকেন ঢাকা স্বামীবাগ। বড় বোনের দুই ছেলের হাতের আঙ্গুলে আঁচিল। আপা বললেন, ওদের জন্য হোমিওপ্যাথি ঔষধ এনে দিস। দুই ভাগ্নেকে নিয়ে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ নবীগঞ্জ ঘাটের কাছে তাবলীগ মেডিকেল হলে আসি। ডাক্তার ঔষধ দেয়ার পর ওদের আবার ঢাকা পৌঁছে দেই। এজন্য আমাকে দুইবার জার্ণি করতে হয়। এভাবে ছয় মাস ঔষধ ভক্ষণের পর কোনো ফল উদয় হলো না। এরপর ডাক্তার বদল। আমলাপাড়া শাহীন হোমিও হলে ঢুঁ দিলাম। ডাক্তার বিরাট, মোটা এক খাতায় রোগীর বৃত্তান্ত লিখেন প্রতিবারই। ছয়মাস পরেও বৃত্তান্তের ঘেরাটোপেই রয়ে গেলাম। আবার ডাক্তার বদল করি। নারায়ণগঞ্জ থানার কাছে আমেরিকান হোমিও হলে যাই। ছয় মাস ঢাকা – নারায়ণগঞ্জ লেফট-রাইট করেও কোনো মুনাফার লক্ষণ পেলাম না। এরপর বন্ধু শাহীনকে বললাম, ছোট্ট এক সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছি। শাহীন বললো, ঢাকার সূ্ত্রাপুর লোহারপুলে কাছে ডাক্তার নুর ইসলামের কাছে গিয়েছিলাম ছোট বোন শামীমাকে নিয়ে। তাঁর ঔষধে আঁচিল ভালো হয়ে গিয়েছে, তুই যা ওখানে। তাহলে তো ভালোই হয়, যাত্রা সংক্ষিপ্ত হলো।

এবার স্বামীবাগ থেকে রিক্সায় লোহারপুলে গিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলাম। সরু উত্তর-দক্ষিণে লম্বা তাঁর চেম্বারটি। কাঠের চেয়ার, টেবিল তাঁর। রোগীদের বসার জন্য টুল। প্রচুর রোগী, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও তাঁর কাছে রোগী আসে। সকালে তিনি এখানে বসেন সাধারণ মানুষদের জন্য। বিকালে ধানমন্ডি বসেন ধনীদের জন্য। ঔষধ নিলাম, দাম মাত্র দুই টাকা। ভাবলাম, ভয়ে বলবো না নির্ভয়ে বলবো। আচ্ছা ডাক্তার সাহেবকে বলেই ফেলি, আবার কবে আসবো? বিস্মিত হয়ে ডাক্তার সাহেব চোখ তুলে আমাকে ডিজিটাল স্ক্যান করে বললেন, “আর আসতে হবে না যান”। এবার সত্যি ভয় পেয়ে চলে এলাম। নিজে নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। এক ডোজের দুই টাকাতেই কিল্লা ফতে! সেটাই হলো, এই সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে আর যাই নাই। “সত্যি সেলুকাস কি বিচিত্র এ দেশ”।

এবার ডাক্তারের প্রতি ভক্তি বেড়ে গেলো প্রচুর। প্রতি বৎসরই ঠান্ডা, গরমে টনসিল বাবাজি উদয় হন আমার গলায়। ডাক্তার মাহবুবুর রহমানের (প্রয়াত) এন্টিবায়োটিকে সারলেও নাচন-কুদুন দিয়ে যায় যাবার সময়। টনসিল গ্ল্যান্ড ফুলে পুঁচ বের হয়ে তারপর টনসিল সারে। প্রতিবারই এরকম ঘটে। কিছুই গলাধঃকরণ করা যায় না। মা জাউয়ের মতো করে খিচুরী করে দিলে চামচ দিয়ে সেটা নামাতে ঠেলাঠেলি করতে হতো। ডাক্তারকে গিয়ে বললাম। তিনি বললেন, একটা চটি বই নিয়ে যাবেন। বইয়ের প্রশ্নের উত্তর পূরণ করে বিশ টাকা ফি দিবেন। এরপর চিকিৎসা শুরু হবে।

নিজের নাড়ি-নক্ষত্র বিষয়ক সব প্রশ্নমালা। প্রশ্নের উত্তর লিখতে গিয়ে হোঁচট খাই বারবার। কঠিন অবস্থা! একদিনে কি আর হয়। নিজে নিজেকেই প্রশ্ন করি। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা তখন আমার। যেমন, কয়টা বালিশে ঘুমান, রোজ কয়টা সিগারেট খান, রোজ কত কাপ চা খান, মশারী দিয়ে ঘুমান, না-কি মশারী ছাড়া, টক-ঝাল-মিষ্টি কোনটা পছন্দ করেন, পি – এর রঙ সাদা না হলুদ, বিষ্ঠার আকৃতি কি ছাগলের চানার মতো, ঘোড়ার লেদার মতো, না-কি গোবরের মতো। রাগলে কি করেন? আচ্ছা, মা’র কাছ থেকে কি জেনে নিবো। নিজের সম্পর্কে এতোসব প্রশ্নের মুখোমুখি জীবনে আর কখনো হই নাই। সাতদিনে যুদ্ধ জয়ের পর বিসিএস পাশ। অবশেষে বই নিয়ে হাজির হলাম। আশির দশক শুরু হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার সময় তাঁর কাছ থেকে সকালে ঔষধ নিয়ে যাই। টুথপেষ্ট দিয়ে ব্রাশ করা যাবে না এবং টক খাওয়া যাবে না। টক-ঝাল দু’টা থেকেই আমি একশ’ হাত দূরে থাকি। অতএব নো প্রোবলেম। টুথপেষ্টের পরিবর্তে আব্বার সাথে ডায়মন্ড টুথ পাউডার শেয়ার করি। প্রতিমাসে একবার ঔষধ আনি, এভাবে কয়েক বৎসর তাঁর ঔষধের কারিশমায় টনসিল বাবাজি পনের বৎসরের বাসস্থান ছেড়ে নদী পাড়ি দিয়ে পগারপার হলেন চিরতরে।

বিয়ের পর নব্বইয়ের দশকে পেলাম স্ত্রী’র বড় বোনের স্বামী ভায়রা ভাইকে। দুলাভাই বিমান বন্দরে সিভিল এভিয়েশনে চাকুরী করেন। সখের বশে ডিগ্রিবিহীন হোমিওপ্যাথি চর্চা করেন। প্রতিবার তিনি প্রায় পাঁচ হাজার টাকার ঔষধ ক্রয় করে প্যাকেট করে দেন। ঔষধের কোনো নাম তিনি একেবারেই দেন না। আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ঔষধ উড়োজাহাজে আসার পথে অর্ধেক উড়ে যায়। ফোনে বললাম, কনুইতে গোল একটা টিউমার হয়েছে। বললেন, ঐ ঔষধটা শুরু করেন। দীর্ঘদিন পর তাকিয়ে দেখি টিউমার বেচারা বেমালুম গায়েব! বন্ধু রুমির স্ত্রী’র নাকে পলিপ হয়েছে। দুলাভাইয়ের শরণাপন্ন হলাম, তিনি নিজেই ঔষধ ক্রয় করে দিলেন। রুমি ফোনে জানালো, নাই – তো। তোমার ভাবীরটা সেরে গিয়েছে। বললাম, দুলাভাইকে ভিজিট দিতে হবে না, আমার জন্য বিরিয়ানি ও মিষ্টির ব্যবস্থা করো।

“যার নাই কোনো গতি, সে খায় হোমিওপ্যাথি”। আল্লাহ কিভাবে, কোথায় কার হাতে গতির ব্যবস্থা করেন, তিনিই ভালো জানেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভুলে যেতে চাই
পরবর্তী নিবন্ধ“রেইকি”-স্পর্শচিকিৎসা-পর্ব ৫
কামাল উদ্দিন
লেখক পরিচিতি: কামাল উদ্দিন (জন্ম: ১৯৫৮) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে "বাংলা সাহিত্যে" স্নাতকোত্তর (১৯৮২) সম্পন্ন করেন। ১৯৮০ সাল থেকে তিনি ফটোগ্রাফি চর্চা করেন। বেগার্ট ইনষ্টিটিউট অব ফটোগ্রাফি থেকে ডিপ্লোমা-ইন-ফটোগ্রাফি (১৯৯০) এবং বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি'র (বিপিএস) যোগ্যতা বোর্ড থেকে ১৯৯০ সালে "সিনিয়র গ্রেড ফটোগ্রাফার" "লাইসেনসিয়েটশীপ" (এলবিপিএস) অর্জন করেন। তিনি নারায়ণগঞ্জ ফটোগ্রাফিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর প্রকাশিত বই "সহজ আলোকচিত্র" ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় এবং "আলোকচিত্র সহজ ও উচ্চতর" (২০০২ সালে) ভারত হতে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নারায়ণগঞ্জ সুধীজন পাঠাগারে অবৈতনিক গ্রন্থাগারিক হিসাবে নয় বৎসর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলা একাডেমীর জীবন সদস্য। " কামাল হাসান" ছদ্মনামে সাহিত্য চর্চা করেন। তিনি "কথন" আবৃত্তি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন উপদেষ্টা ও এক বৎসর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন