ফ্লোরিডা থেকে:-
আজ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল, টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছিল , তবুও আমি সমুদ্রে নেমেছিলাম । জোয়ার ছিল, তাই সমুদ্র সৈকত ডুবে যেয়ে জল চলে এসেছিল খুব কাছে । জলে একটা স্বচ্ছ সবুজতা ছিল। ঢেউ ছিল মৃদুর চেয়েও সামান্য বেশী। হাওয়া ছিল। আমার রঙীন ছাতাটি কাঁপছিল , আমি তাকে খুব গভীর করে বালুতে গেঁথে দিয়েছিলাম । তারপরে তিনটি বড় ও ভারী পাথর এনে তাকে আরও পোক্ত করে দিলাম যাতে বাতাসের ইচ্ছে না হয় ছাতাটিকে কেড়ে নেবার। আমি কেড়ে নেয়াকে ভয় ভাই ।এমনিতেই । অনেক দিনের পুরোনো ছাতা , অনেক স্মৃতির। ক্যানভাসের চেয়ার দুটোও বদলানো দরকার কিন্তু কত সমুদ্র হাওয়া , কত বালু, কত শামুক শেলের গন্ধ!
আমার শরীরটি ভালো নেই , আসলে সঠিক ভাবে বললে শরীরটি ভালোই আছে , মনটি ভালো নেই। মন ভালো না থাকলে আমার ভুল হয়, মনে হয় শরীর ভালো নেই। বুকে ব্যথা হয়। মনে কে যেন কাঁদে । আমি স্পস্ট সেই ফোঁপানির শব্দ শুনতে পাই। কে কাঁদে জানিনা।
সে ছাতার নীচে বসে রইল আর তার চুল গুলো উড়ে এসে তার মুখ স্পর্শ করে যেতে লাগল। দূরে জল থেকে মাথা তুলে তুলে আমি সেই মুখটি দেখতে লাগলাম।
আমি সমুদ্র জলে মুখ ডুবিয়ে মৃত মানুষের মত ভেসে থাকতে পছন্দ করি । আমার তাতে অনেক ভাবনা আসে । ভাবনা একটা রোগ । আজ জল বেশ উষ্ণ ছিল, আমার পিঠে ঝরে ঝরে পড়ছিল আকাশের অশ্রুকণা। আকাশ কাঁদে কেন ? কি তার দু:খ?
বাংলাদেশে এখন শ্রাবণ , তিন যুগ শ্রাবণ দেখিনি , দেখিনি হিজল ফুল । হিজল ফুল ফুল নয় , মায়া । আমার মধ্যে কি একটা অবসেশন । জলে ডুবো হিজল গাছ , পাতায় পাতায় স্রোতের পা আটকে যায় , আর লম্বা সুতোর মধ্যে মিহি ও নরম দলের হিজল ফুল ,জল ছুয়ে । স্রোত টেনে ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে দুটো একটা , কাউকে দেবে বলে। হ্যা , জীবন এমনি যে কাউকে কাউকে ফুল দিতে ইচ্ছে হয়, এই ইচ্ছের কোন লজিক নেই। যুগের পর যুগ পার হয়ে যায় তার পরেও ইচ্ছে থেকেই যায় ।
আমি সমুদ্রে সাঁতরাচ্ছি, সঠিক বলতে মৃতের মত ভেসে আছি ,আর আমার পিঠে বৃষ্টি পড়ছে , তীরে ছাতার নীচে তার মুখে চুল উড়ে উড়ে আসছে ,আর এই একই সমুদ্রে , ২৪ শে জুলাই দুই হাজার ষোল সালের একই সময়ে সাঁতরাচ্ছে অনেক গুলো তিমি অসম্ভব বড় বড় , সমুদ্র গরু বা “মানাতি” বিশেষ কোন রকম নড়া চড়া না করেই , জলস্রোতের ওপরেই তাদের চলাচলের দায়িত্ব ন্যস্ত আর অনেক গুলো হাঙর,
লেজ ও পাখনা নাড়িয়ে । তিমি বা সমুদ্র গরুর অবশ অবশ ভাবটায় ওদের এক ঘেয়েমি লাগে। ওরা আমার মত নয়, মানুষের মত , সক্রিয়। আর হ্যা ,অনেক মাছ, জেলী ফিশ্, শৈবাল, কোরাল । না আমি ওদের কাউকেই দেখতে পাচ্ছিনা । শুধু জানি ওরা সবাই একই সময়ে সাঁতরাচ্ছে আমার সাথে এই বিশাল সমুদ্রে । আকাশ চেয়ে আছে মাথা নীচু করে, বাতাস চুল গুলো উড়িয়ে ছুয়ে যাচ্ছে তার মুখ , সেই মুখে কি এক অচিন আলো ,আর তার বুকে হাল্কা যে বসন উড়ছে তার নীচে এক জোড়া ধুতুরা ফুল , ধুতুরা দুধ পান করলে কি হয়?
আমার কি হয়েছে?
আমি একজন মৃত মানুষের মত ভেসে আছি মহাকালের মহাসমুদ্রে । আমি অসুস্থ । না , আমার মন ভালো নেই । আমার বুকে ব্যথা , আমার মনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কে যেন কাঁদে ,আমি বুঝতে পারিনা। আমি তিন যুগ বাংলাদেশের শ্রাবন দেখিনি। আমার খুব হিজল ফুল দেখতে ইচ্ছে করে।
বাংলার ঋতু গুলো অসাধারন। মন খারাপ হয়ে গেল আপনার লেখা পড়ে। প্রতি আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টিতেই ভিজতাম একসময়, এখন কপালে নেই।