একটি কথা আছে-“শিশুকাল জাপানে, যৌবন ইউরোপে (আমেরিকাসহ পাশ্চত্য দুনিয়ায়) এবং বৃদ্ধকাল ভারতবর্ষে আনন্দময় ও সুখকর।” জাপানে যে বাড়ি হতে শিশুর কান্না শোনা যায়-পথচারিরা তাদের ধিক্কার দেয়। পাশ্চাত্যে যৌবন উপভোগের নৈতিক-অনৈতিক সকল আয়োজন সহজলভ্য ও সহজপ্রাপ্য। ভারতবর্ষে বৃদ্ধরা নিজ নিজ সন্তান-স্বজনের পরম ভালোবাসা-সেবাযত্নে দিন কাটায়। সেই ভারতবর্ষের একটি দেশ বাংলাদেশ। এখানে বাবা-দিবস, মা-দিবস, ভালোবাসা-দিবস আলাদা করে একটি দিনে ঘটা করে পালন করার কোন যৌক্তিক কারণ দেখি না। যদিও কিছু অমানুষ সন্তানের কারণে আমদের দেশেও ইদানিং বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছে। কিন্তু এটি আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্মের সাথে খাপ খায় না। তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে কখনো এসব নির্দিষ্ট দিবস পালন করি না। বাবা মারা গিয়েছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে বাবাকে পাই শয্যাশায়ী। ১৯৭২ এর ৪ এপ্রিল বাবা মারা যান। শেষ তিনটি মাস আমি ছিলাম বাবার সারাক্ষণ সেবাসঙ্গী। রাতে ১০-২৫ মিনিটে আমার হাতের শেষ পানিটুকু খেয়ে-পবিত্র কলেমা আওড়াতে আওড়াতে বাবা আমার চির নিদ্রায় শায়িত হলেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথমে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে বাবার জন্ম। তিনি ছিলেন মন-মানসিকতায় একজন উদার মানুষ। বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সি, সংস্কৃত ভাষায় ছিলো অগাধ পান্ডিত্য। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কংগ্রেসে যোগদান করেন। ১৯২০-১৯২১ সালে যখন মাওলানা শওকত আলী ও মাওলানা মোহাম্মদ আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের নেতৃত্বে ভারতবর্ষ জুড়ে খেলাফত আন্দোলন শুরু হয়। তিনি তখন নোয়াখালি জেলায় খেলাফত আন্দোলন সংগঠনে বিরাট ভূমিকা পালন করেন।এ সময়ে মাহাত্মা গান্ধী খেলাফত আন্দোলনকে সমর্থন করেন এবং তাঁর স্বরাজ আন্দোলনকে খেলাফত আন্দোলনের সাথে একীভূত করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা করেন। গান্ধীজির খেলাফত সমর্থনকে অনেক কংগ্রেসনেতা সমর্থন করেননি। তাদের কথা ছিলো এটি একান্তই মুসলমানদের খেলাফত রক্ষার আন্দোলন। এতে হিন্দুদের সমর্থন অযৌক্তিক। তখন গান্ধীজি তাঁর ঐতিহাসিক উক্তিটি করেছিলেন-”Khilafat is a Muslim Cow”. গাভী যেমন হিন্দুদের প্রিয়-তেমনি গাভীর মালিক মুসলমান হওয়ায় এটা তাদেরও প্রিয়।” নোয়াখালি জেলার সোনাইমুড়ি উপজেলার কালিকাপুর বাজারে খেলাফত ক্যাম্প স্থাপন করেন। বাজারের পরিবর্তিত নাম হয় খেলাফত বাজার, যা আজো বহাল আছে। এম এ ফাইনাল ও ল ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারেননি পুলিশের হুলিয়া ছিলো বলে। কর্মজীবন শুরু করেন ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউশনে। এটি ছিল তখন বিপ্লবীদের প্রতিষ্ঠান, এর পরে চলে গেলেন গ্রামে। গ্রামে শিক্ষার আলো না জ্বাললে জাতি শিক্ষিত হবে না। এ প্রত্যয়ে আমার বাবা আবদুল জলিল, কল্যাণ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রফুল্ল কুমার ভট্ট (পি.কে ভট্ট) হরিনারায়ণপুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুল হালিমসহ একদল তৎকালীন বিপ্লবী পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নেন। সারা জীবন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সম্ভবতঃ ১৯৪৫-১৯৫৫ পর্যন্ত নোয়াখালি শহরের আহমদিয়া হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষক থাকাকালে সোনাপুরে আমার জন্ম হয়। কর্মজীবন শেষ করেন কল্যাণদী হাই স্কুলে ১৯৬৮ সনে।

বাবার সান্নিধ্য পেয়েছিলাম কিন্তু দুর্ভাগ্য বাবা থেকে কোন কিছু শিখতে পারিনি। তিনি ছিলেন নির্লোভ, প্রচারবিমুখ, প্রচন্ড নীতিপরায়ণ ও কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং অবশ্যই সততার নিরিখে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আসীন। একবার নোয়াখলির জেলা পরিষদের তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান নোয়াখালির এক সময়ের একমাত্র এমবিবিএস ডাক্তার মোয়াজ্জেম হোসেন বাবাকে বললেন-‘তমঘায়ে কায়েদে আযম খেতাব প্রদান তালিকায় উনার নাম প্রস্তাব করতে চান শিক্ষাবিদ হিসেবে।আইয়ুব খান তার ১০ বছর শাসন উপলক্ষে লিখেছিলেন-ফ্রান্স নট মাস্টার্স -প্রভূ নয় বন্ধু নামক একটি বই।সে উপলক্ষে এ খেতাব প্রদান। আইয়ূব খানের খেতাব গ্রহণের প্রস্তাব তিনি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন, সেটি সম্ভবত ১৯৬৯ সালে।

বাবা বলতেন, আমরা যে জন্যে রাজনীতি করেছি-সেটা সফল হয়নি। পাকিস্তান রাষ্ট্র আমরা এভাবে চাইনি। রাজনৈতিক হতাশা তাকে প্রচন্ডভাবে গ্রাস করেছিলো। তাই মামুন ভাই (ল ইয়ার্স কলোনীর সাইদুল আবরার মামুন ১৯৬৭-১৯৭৭ পর্যন্ত তুখোড় ছাত্রনেতা। ছাত্র ইউনিয়ন মেনন-পন্থী, পরে বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। আমার মেঝ ভাইয়ের বন্ধু, সহপাঠী। কয়েকবার জেল খেটেছেন, পলাতক ছিলেন। ১৯৭৭-১৯৮০ সালে রোকেয়া হলের সামনে জীর্ণ পোষাকে উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াতেন। ‘একটি টাকা দাও তো’ শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ। অনেকের কাছেই চাইত। একদিন হারিয়ে গেলেন, আজো খোঁজ মেলেনি। আছে কি নেই, কেউ বলতে পারে না।) যখন পুলিশের হুলিয়া খেয়ে আমাদের রেল লাইনের পূর্বের বাসায় আশ্রয় নিতেন, তখন বাবা তাকে খুবই আদর করতেন, সান্ত্বনা দিতেন। সারাদিন গল্প করতেন। একদিন বলেছিলেন, মামুন, Political frustration is dangerous than any other frustration. আজকে জাসদসহ অনেক বামপন্থী মেধাবী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর হতাশা বাবার কথাকেই সত্য বলে প্রমাণ করে। সেই বাবার কথা, হারিয়ে যাওয়া ভাই-বোনদের কথা, সারাক্ষণ মনে পড়ে। চোখের সামনে ভাসে। স্মৃতি বড়ই বেদনাদায়ক। ঈদ আসছে-অনেকে নেই। হয়তো আগামি ঈদে আরো কেউ থাকবে না-এটাই জগতের রীতি। এর বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা কারোরই নেই।

যাক-বলছিলাম বাবা থেকে কিছুই শিখতে পারিনি। বাবা বলতেন প্রতিদিন ১টি শব্দ শিখবি-বেশী না-আমরা একদিনে ১০/১২টা শিখে বাবাকে শুনিয়ে বলতাম বাবা ১০টা শিখেছি-আগামী ১০ দিন ছুটি। নিজেকে নিজেই ফাঁকি দিয়েছি। এ রকম একটি শব্দের অর্থ শিখতে গিয়ে আজকের নিবন্ধের সূচনা-
“পিতার কাছে ইংরেজি পাঠ”
সম্ভবতঃ ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ি। স্কুলে গিয়ে শুনলাম আমাদের স্কুল ‘হরিনারায়ণপুর হাই স্কুল’ ফুটবল খেলায় সেমি ফাইনালে উঠেছে। স্কুলের সবার মধ্যে আনন্দ-উত্তেজনা। সেমি ফাইনাল জিতলেই ফাইনাল। ফাইনাল জিতলেই চ্যাম্পিয়ন! তখন কী আর অতশত বুঝি! তবুও সকলের মাঝে সংক্রামিত আনন্দ-উত্তেজনা আমাকেও সংক্রামিত করে। বাসায় ফিরে মা-বাবা, ভাই-বোন সকলকে একই কথা বার বার বলতে থাকি। আমাদের স্কুল সেমি ফাইনালে উঠেছে! আমাদের স্কুল সেমি ফাইনালে উঠেছে! ইয়া আল্লাহ আমাদের স্কুলকে জিতিয়ে দাও। সে সময় আমাদের স্কুল পড়াশোনায় খুব একটা ভালো ছিলো না। তবে খেলাধুলা ও মারামারিতে সেরা। ছোট্ট শহর নোয়াখালিতে সবাই হরিনায়ণপুর হাই স্কুলের নাম শুনলে সমীহ করতো।
বার বার একই কথা বলতে থাকায় বাসার সবাই বিরক্ত হয়। বাবা ডাকলেন-এই যে সেমি সেমি করছিস, সেমির অর্থ কী বল? আমি বলি সেমির আবার অর্থ কী! সেমি মানে সেমি ফাইনাল। বাবা শিক্ষকতা করতেন। হেড মাস্টার জলিল সাহেব নামে তাঁর পরিচিতি ছিলো ব্যাপক। বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সী, সংস্কৃত ভাষায় ছিলো অগাধ পান্ডিত্য। আমায় ডাকলেন। তোকে আজ বলতে হবে, সেমির অর্থ কী। আমি মাকে ডাকলাম। দেখ মা, বাবা কী বলছে, সেমি মানে সেমি ফাইনাল, এটাও বাবা জানে না; আবার হেড মাস্টার! বাবার সাথে আমরা ভাই-বোনেরা খুবই বন্ধুসুলভ ছিলাম।

বাবা এবার আমাকে আবার ডাকলেন। হাত ধরে পাশে বসালেন। বললেন, বল গাঁধা-আমার সাথে সাথে বল-সেমি, ডেমি, হেমি, হাফ (Semi, Demi, Hemi, Half) আমিও বলি সেমি, ডেমি, হেমি, হাফ। কয়েকবার এরকম বললেন। আমিও সাথে সাথে বললাম। এবার বললেন, এর সবগুলোর অর্থই অর্ধেক। সেমি অর্থ অর্ধেক, যেমন সেমি ফাইনাল-মানে ফাইনালের অর্ধেক। ডেমি অর্থও অর্ধেক, যেমন ডেমি লেটার, ডেমি গড। হেমির অর্থও অর্ধেক, যেমন Hemisphere অর্থাৎ গোলার্ধ। আর হাফ এর অর্থও অর্ধেক, যেমন হাফ সার্ট।হাতাকাটা সার্ট। না-এটাও জানিস না গর্দভ। জন্মদাতা পিতার নিকট সারাজীবন এটাই আমার একমাত্র ইংরেজি শিক্ষা। এরপরও বাবা ৯ বছর বেঁচে ছিলেন। বাড়ির গরু ঘাটার (বাড়ির সম্মুখভাগ) ঘাস খায় না, প্রবাদটি যথার্থই।

দ্বিতীয় বারেও একটিমাত্র ইংরেজি শব্দ শিখেছিলাম আর একজন পিতার কাছে। তিনি আমার জন্মদাতা পিতা নন। তবে যে দেশটিতে বর্তমানে আমি ও আমার পরিবার-সন্তানরা বাস করছি তিনি হলেন সে দেশটির জন্মদাতা পিতা। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঘটনাটি ১৯৭২ সালের ২৩ জুন সকাল ১০ ঘটিকায়। তার আগের দিন (২২ জুন) তিনি স্বাধীনতার পরে প্রথমবারের মতো নোয়াখালি এলেন। ২৩ জুন সকালে ৯-৩০টায় নোয়াখালি প্রেস ক্লাবের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং নির্মিতব্য প্রেসক্লাব প্রাঙ্গনে মৌমাছি কচি-কাঁচার মেলার সদস্যদের বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার প্রদানের কর্মসূচি। নেতা আসতে একটু বিলম্ব হলো। এসেই প্রেসক্লাবের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। একটি চারা গাছ রোপন করলেন। এর পর ছোট একটি মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন। সাথে নোয়াখালির তৎকালীন জননেতা স্বাস্থ্যমন্ত্রী আব্দুল মালেক উকিল ও নোয়াখালি জেলা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার এবং নোয়াখালি মৌমাছি কচি-কাঁচার মেলার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছাত্রনেতা মাহমুদুর রহমান বেলায়েত, অধ্যাপক হানিফ, কচি ভাই প্রমূখ। বখতিয়ার সিকদার (বর্তমানে সাংবাদিক) অধিনায়ক এবং আমি সহ-অধিনায়ক। গার্ড অব অনার প্রদান করা হলো। নেতা গার্ড পরিদর্শন করে মঞ্চে ফিরলেন। আমরা সবাই আরামে দাঁড়ানো অবস্থায়। নেতা এখন কিছু বলবেন। কিন্তু না। নেতা শুধু দুটো কথা বললেন, ”তোমরা ভালোভাবে পড়াশোনা করো, ভালো মানুষ হও, এদেশ তোমাদেরই গড়তে হবে। আমি আজ খুবই ব্যস্ত। মোটেই সময় নেই। আজ আর কিছু বলবো না। অ্যাম্বাসেডর সাহেব বসে আছেন। সাড়ে দশটায় এপায়েনমেন্ট।” এ বলে বাঁ হাতের সম্মুখভাগ একটু ঝাঁকি দিয়ে ঘড়ি দেখলেন। এবং মঞ্চ থেকে নেমে চলে গেলেন। ধীরে ধীরে আসর ভাঙ্গলো। কিন্তু আমার মাথার মধ্যে তখন গুন গুন করছে একটি শব্দ অ্যাম্বাসেডর , অ্যাম্বাসেডর ! এর অর্থ কী। উচ্চ মাধ্যমিকে দ্বিতীয়বর্ষে পড়লেও তখনকার দিনে মফস্বলের ছাত্রের ইংরেজি জ্ঞান আর কতটুকুই। রাতে বাসায় ফিরেই ডিকশনারি খুলে দেখলাম-অ্যাম্বাসেডর মানে রাষ্ট্রদূত। পিতা, তোমার কাছ থেকেও মাত্র একটি শব্দই শিখলাম।
লেখক: বাংলাদেশ সরকারের  সাবেক প্রধান তথ্য কর্মকর্তা

 

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন