“বনের পাখিরে কে চিনে রাখে গান হ’লে অবসান।
চাঁদেরে কে চায় – জোছনা সবাই যাচে,
গীত শেষে বীণা প’ড়ে থাকে ধূলি মাঝে;
আলো দিতে পোড়ে কত প্রদীপের প্রাণ।”
আচ্ছা, এই যে বহু আগে নজরুল কথাগুলো বলে গেছেন এবং কথাগুলো যে কি পরিমান সত্য তা একেবারে নিজের ক্ষেত্রে না ঘটলে উপলব্ধি করা দুষ্কর। প্রাণী হিসেবে অসম্ভব স্বার্থপর এই মানবজাতি শুধুমাত্র নিতেই জানে, খুব অল্প সংখ্যক “নীলরক্ত” মানুষ আছেন যাদের কারনে পৃথিবীটা আজও টিকে আছে বটে, তবে সেই মানুষের সংখ্যা বড় নগন্য। নজরুলের কথামত বনের পাখির মর্যাদা ততক্ষনই আছে যতক্ষন সে গান গাইতে পারে, আর এখনকার এই ডিজিটাল যুগে যখন বনের পাখির গান কৃতিমভাবে তাৎক্ষনিক তৈরী করাই থাকে তাই বনের পাখির কথা আর আমাদের মাথায়ই নেই। এভাবেই কৃত্রিমতা আমাদের জীবনকে এত সহজ করে দিয়েছে যে এই সহজলভ্য উপকরনের মূল উৎস সম্পর্কে আমরা আর আগ্রহী নই। প্লাস্টিকের ফুল আর দামি মেকাপের স্তরে ঢাকা পড়ে গেছে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা ছোট্ট বনফুল। আমরা বন কেটে প্লাস্টিকের ফুল তৈরীর কারখানা দিয়েছি। প্রাকৃতিক সূর্যের আলোয় ঘুমানোর অভ্যাস করে, কৃত্রিমভাবে তৈরী আলোয় রাত জেগে নিজের স্টাটাস জাহির করি। জানি, তোমরা বলবে – ও… তুমি কি আলাদা? অবশ্যই আমি আলাদা নই। আমি নিজেও যে বড় দুষ্ট।
সবাই বলছে, পৃথিবীর মহামারী হয়েছে। আসলে হয়ত পৃথিবী নিজেকে বাঁচাতে, একটা পদক্ষেপ নিয়েছে। আর কত? পৃথিবী আমাদের কিছু কম তো দেয় নি। কিন্তু আমরা পৃথিবীকে কি দিয়েছি? মহামারিতে তো আমরা ভুগছিলাম- বছরের পর বছর। আর আমাদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট রোগী ছিলেন পৃথিবীর শিক্ষিত জনগোষ্ঠী যারা জেনে শুনে বিজ্ঞ হয়ে তারপর নিজের স্বার্থে পৃথিবীর পেট কেটে সোনার ডিম বের করে ভক্ষন করেছে এত বছর। তারা এই সেনার ডিমের ভাগ কিন্তু নিজের স্বজাতিকেও দেয় নি। পৃথিবীর মাটির নিচ লুকানো সম্পদ থেকে শুরু করে আকাশের ওজন স্তর পর্যন্ত কোনও কিছুই তারা বাকি রাখে নি। নিজেদের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়েই গড়ে তুলেছে কারখানা, শহর, বন্দর, যানবাহন। তারা ভুলেই গিয়েছিল, বিধাতার সৃষ্টি এই পৃথিবী সমগ্র প্রাণীকুলের চেয়েও কত বিশাল। এখানকার সমগ্র প্রাণীকুল যদি ভষ্মও হয়ে যায় তবে তার কিচ্ছু যাবে আসবে না।বরং সে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে।
আমি জানি কেউই আমাকে সমর্থন করবেন না, তবে আমি চাইনা এ পৃথিবী আবার আগের মত হয়ে যাক। চাইনা সবাই কাছাকাছি আসুক, চাইনা মানুষ নূন্যতম প্রয়োজনের বাহিরে কিছু করুক, একান্ত প্রিয়জন ছাড়া কারও সান্নিধ্যে আসুক।সময় কাটাতে পরিবেশ দূষন করে বেড়াতে যাক অথবা অর্থের প্রাচুর্য দেখাতে বাহারি পোষাক আর গহনা কিনুক।চাই না সপ্তাহান্তে এত বিপুল পরিমান লোক দেখানো মেকি দাওয়াত আর অতিরিক্ত খাবারের বন্যায় ভেসে যাক প্রবাস জীবনের মূল্যবান অর্থ ও সময়গুলো যখন পৃথিবীর বহু প্রান্তে বহু মানুষ না খেয়ে আছে।আমি চাই মানুষ আবারও সেই সহজ সময়ে চলে যাক, যখন পরিবার ও কৃষিকাজ ছিল সকল জীবনের কেন্দ্রে।
আমার মানসিক বয়স ৫৩ বছর। এই বয়সের একজন খেয়ালি মানুষ যা যা করতে পছন্দ করেন আমিও লুকিয়ে তাই পছন্দ করি। মাঝে মাঝে অবশ্য লৌকিকতার খাতিরে কিছুটা জানার ভান করি। হালের ফ্যাশন ট্রেন্ড কিংবা নতুন হিন্দী মুভি সম্পর্কে আমি একেবারে নিরক্ষরই বলা চলে।কাছাকাছি বয়সের নিন্দুকেরা আমার এই অজ্ঞতাকে “ক্ষ্যাত” বলে ভূষিত করলেও আমি স্রেফ বলে দিই- শোন হে বৎস- আমি ৫৩ বছর বয়সী একজন মানুষ। আমি সেকেলে, তোমাদের চোখে “ক্ষ্যাত” হতে পেরেই আমি ধন্য। অন্তত সুলভ এন্টারটেইনমেন্টের এই যুগে তোমাদের বিনোদনের পাত্র হিসেবে নিজেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। আমার কাছে পহেলা বৈশাখের একদিনের ইলিশ মাছ, ফাল্গুনের মেকি ফুল অথবা ঈদে একটার বেশি নতুন জামার কোনও মূল্য নেই। কারন আমি জানি, জীবন কত নশ্বর – আর ১০০ বছরের মধ্যে আমার পরিচিত কেউই আর থাকবে না। ১৫০ বছরের মধ্যে ৯৫% চেনা মানুষের চিহ্ন এই পৃথিবী থেকে মুছে যাবে চিরতরে।
পৃথিবী কিন্তু বেঁচে থাকবে। একদল নতুন মানুষ নিয়ে সে যাত্রা শুরু করবে নতুনভাবে। আহা সেই নতুন মানুষ যেন বিধাতার দান দুহাত পেতে নেয়, কৃতজ্ঞতার সাথে। আর তারা যেন ভালোবাসে এই পৃথিবীকে।