যতটা আগ্রহ নিয়ে যাই, ততটাই মন খারাপ করা অনুভূতি নিয়ে ফিরে আসি হাসপাতালের Palliative Care Unit থেকে. ওল্ড হোম, নার্সিং হোমকে ছাড়িয়ে এর অবস্থান. বলা যায় মৃত্যুর একেবারেই কাছাকাছি এক পর্যায়. সব চিকিত্সার আশা  যেখানে শেষ, Palliative Care সেখানেই শুরু। Sunnybrook হাসপাতালের Dr Bannette এর ভাষায় এ হচ্ছে “End of Life Care”. যাদেরকে এই ইউনিট এ রেফার করা হয়, জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ার তিন মাসের এক সময়সীমা তাদের জন্য বরাদ্দ থাকে। তাদের জীবনের শেষ দিনগুলো যাতে অপেক্ষাকৃত কম কষ্টের হয়, সেজন্য ডাক্তার, নার্স, কেয়ার ম্যানেজার নিয়ে বিশেষ একটি টিম রুগীর সাথে সংশ্লিষ্ট সব রখমের সার্বক্ষণিক সেবা নিশ্চিত করেন। অসাধারণ মানসিক দৃঢ়তা না থাকলে এসব জায়গায় কাজ করা ও কঠিন। এখানে প্রায় প্রতিদিনই কারো না কারো পরপারের ডাক আসে, আর এই ডাক্তার, নার্সরা হন চিরবিদায়ের প্রত্যক্ষদর্শী।

আমি এখানে আসি জীবন মৃত্যুর সন্ধি ক্ষণে থাকা আমার এক ক্লায়েন্ট কে দেখার জন্য। এই ইউনিট এ  স্থানান্তরিত হউয়ার আগেও সায়মন (ছদ্মনাম) এই হাসপাতালেই ছিল। দীর্ঘ দিন ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ, বিভিন্ন রকমের চিকিত্সা, রেডিয়েশন শেষে ডাক্তাররা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে সায়মনের জন্য  আর  কোন প্রতিকার অবশিষ্ট নেই। একটু কঠিন ভাবে বললে এর অর্থ দাড়ায় যে চিকিত্সা শেষ, মৃত্যুর জন্য  দিন গুনা শুরু।  সায়মনের সাথে  দেখা করার আগে হাসপাতালের একটি তথ্য বিনিময় মিটিং এ অংশ নিতে হয়েছে। Paliative Care ইউনিট এর রুগীর জন্য নির্ধারিত ডাক্তার, নার্স, কেয়ার ম্যানেজার, হাসপাতাল সমাজকর্মী, কেস ম্যানেজার, রুগীর ঘনিষ্ট আত্মীয়র অংশ গ্রহণে অনুষ্টিত এরকম মিটিং এ প্রধানত কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য  হলো রুগীর সার্বিক শারীরিক অবস্তা, এক  পর্যায়ে রুগী নিজে যখন কোন সিদ্ধান্ত নিতে  পারবে না , সেই সময়ের জন্য Substitute Decision Maker নির্ধারণ করা, রুগী ODSP বা OW নির্ভরশীল হলে সেই কতৃপক্ষের সাথে যুগাযুগ করা, অন্তেষ্টি ক্রিয়ার জন্য Funeral Home নির্ধারণ এবং রুগীর ইচ্ছামাফিক কোন peer গ্রুপ এর সাথে সংযুগ সাধন। এর অনেকগুলোর সাথেই আমার কমবেশি সম্পৃক্ততা রয়েছে. কেস ম্যানেজার হিসেবে আমার উপস্তিতি সে কারণেই. সায়মন এই মিটিং এ অংশ নিতে অসম্মতি জানিয়েছে. মিটিং শেষে তার কেবিনে এসে পুরো আলোচনার সারমর্ম তুলে ধরি। ভাবলেশহীন কন্ঠে সায়মনের উত্তর,”আমি জানি, ডাক্তার বলে গেছেন”। বুঝতে পারছিলাম কোন কিছুই সায়মনের অজানা নেই এবং এই দেশে এটাই স্বাভাবিক। এখন আর তার রুগ নিয়ে আলোচনার অবকাশ নেই। পরিবেশ হালকা করার জন্য প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টায় কানাডিয়ানদের আলোচনার সহজ বিষয় আবহাওয়া দিয়ে শুরু করলাম, ” যা গরম পড়েছে, এত বাংলাদেশের মতই”. বাংলাদেশের প্রসঙ্গ আসতেই খেয়াল করলাম তার মধ্যে কিছুটা কৌতুহল সঞ্চারিত হয়েছে. জিগ্যেস করলো, “আত্তীয় সজন কেও থাকেন ঐখানে?” উত্তরে বললাম যে মা বাবা সহ অনেকেই। কি কারণে বুযলাম না, বলল, ” That is the only fountain of unconditional love, take care of them”. বলেই, বিছানায় কিছুটা হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইলো। আমি কিছুটা বিস্মিত। মৃত্যুপথ যাত্রী একজন মানুষ আমাকে মা বাবার যত্ন নিতে বলে। অথচ দৌড়ের জীবনে অভ্যস্ত সুস্থ মানুষ আমরা এই সাধারণ কর্তব্যটিই ভুলে যাই. আমাদের মধ্যেই কিছু মানুষ আছেন যাদের ধ্যান জ্ঞান সবকিছুই টাকা পয়সাকে ঘিরে। জাগতিক অন্য কিছুতেই তাদের আগ্রহ নেই. এমনকি একান্ত আপনজনদের খবর নেয়ারও বিশেষ কোন তাগিদ তাদের মধ্যে নেই. জীবনভর পরম মমতায় যারা আগলে রাখেন আমাদের, নিঃস্বার্থ বটবৃক্ষের মত প্রশান্তির ছায়া দিয়ে যান অবিরাম, তাদের জন্য আমাদের সময় নেই। মানুষ আসলেই বড় অকৃতজ্ঞ।  সন্দেহ নেই বেচে থাকার জন্য জীবনে টাকার প্রয়োজন আছ ।কিন্তু শুধুই টাকার জন্য বেচে থাকা ? অর্থহীন।

“তুমি এখন যেতে পারো,  আমি ঘুমাবো”। হঠাত সায়মনের কথায় এলোমেলো চিন্তা থেকে বাস্তবে ফিরে আসি। চেয়ে দেখি সত্যিই সে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিদায় নিয়ে পাতলা একপ্রস্ত চাদর তার গায়ে বিছিয়ে, দরজাটা সামান্য একটু খোলা রেখে নিঃশব্দে তার কেবিন থেকে বেরিয়ে আসি। ইচ্ছে করেই elevator এড়িয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে ভাবি জীবন এবং জগতে কোন কিছুই স্থায়ী নয়। আমরা কেউই পার্মানেন্ট রেসিডেন্টশিপ নিয়ে পৃথিবীতে আসিনি। একসময় দৌড়ের জীবন এবং জীবনের দৌড় দুটোই থেমে যাবে। ফিরে যেতে হবে উত্সমুখে. যে অর্থ, বিত্ত, সম্পদের জন্য এত ছুটাছুটি, তার কোন কিছুই আমাদের সাথে যাবে না.
কিন্তু যা সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারব, সেই সঞ্চয় কি আমাদের আছে ?

সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে

4 মন্তব্য

  1. এ দেশের কালচারে শেষ জীবনে মা বাবার যত্ন নেবার বিষয়টি খুব একটা দেখা যায় না। মাদার বা ফাদার ডে পালনের সময় কেহ কেহ মা বাবার খোজ নেন। একজন মৃত্যু পথযাত্রীর মনে যে গভীর কষ্ট বিরাজমান তাই এখানে প্রকাশ পেয়েছে। লেখাটি ভালো,,এধরনের আরো লেখা আশা করি। ধন্যবাদ।
    *good*

  2. মনির ভাই, আপনার মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ. আপনি ঠিকই বলেছেন, বছরের ৩৬৪ দিন খবর না রেখে একটি বিশেষ দিনকে ঘটা করে উদযাপনের মধ্যে দিয়ে মা বাবার প্রতি ভালবাসা প্রকাশ কতটা যৌক্তিক তা বলা কঠিন. আমি আমার এক অতি ঘনিষ্ট আত্তীয়কে জানি যিনি সারারাত অতি কষ্টকর একটি কাজ করেন, কিন্তু ভোর রাতে এসে উনার মাকে ফোন না দিয়ে উনি ঘুমাতে পারেন না. দিনের পর দিন, মাসের পর মাস উনি এই কাজটি করে যাচ্ছেন আনন্দচিত্তে. তা কিভাবে সম্ভব ? আমার কাছে মনে হয় এটি অনেকটাই চেতনার, উপলদ্দির বিষয়. উপলদ্দিতে না আসলে nothing actually matters.

  3. চমৎকার অভিব্যক্তি মশিউল হাসান ভাই! তবে আপনার এই লেখাটা পড়ে মনের কোথায় যেন কষ্ট অনুভূত হলো।নিশ্চয়ই এটা আপনার লেখার স্বার্থকতা।মা- বাবা, আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি কর্তব্য পালনে আমাদের কারোর যেন দৌঁড়ের জীবন বাঁধা না হয়ে দাঁড়ায় সেই কামনা করি।

  4. অনেক ধন্যবাদ জাকির ভাই. আশা করছি অচিরেই আপনার নুতন লেখা পাব. ভালো থাকুন.

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন