গণতন্ত্র হচ্ছে সরকারের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম কাজ যা নিয়ে বিভিন্ন দেশে অহরহ ঝগড়া, মারামারি, হানাহানি বৎসরের পর বৎসর লেগেই থাকে। এইতো দুই বৎসর আগের কিছু চাঞ্চল্যকর স্মৃতি আজ ও চোখের সামনে ভাসছে : ডোনাল্ড ট্রাম্প ভোটে হেরে গিয়ে কিভাবে “হোইটহাউজ দখলে রাখতে চেয়েছিলো, দুনিয়ার মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো যে আমেরিকার মতো একটি বৃহৎ শক্তিশালী দেশে কি হতে যাচ্ছে? ডোনাল্ড ট্রাম্প আজ ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইকেল রিচার্ড পেন্সকে দায়ী করে যে ও সহযোগিতা করলে ডোনাল ট্রাম্প-ই প্রেসিডেন্ট হিসাবে ঘোষিত হতো। সে এখনো ও বলে জো বাইডেন অবৈধ সরকার প্রধান, জোর করে ক্ষমতা দখল করেছে । এই যদি আমেরিকার মতো দেশে ইলেক্শনকে কেন্দ্র করে হয়,তাহলে তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলে কি হবে ?
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে স্বৈরশাসক নাম মাত্র গণতন্ত্র দিয়ে দেশ পরিচালনা করে । বহু দেশে ভোট কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার চুরি করে সীল মেরে বক্সে ঢুকানো , জয় কে পরাজয়,পরাজয়কে জয় তো সরকারের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে, এ নতুন কিছু নয়। তাছাড়া তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি এই ভোট দেয়ানেয়া নিয়ে অহরহ ঝগড়া,মারামারি সর্বদাই করে থাকে। নিজেদের পরিচিত আপন আত্মীয়কে ও অনাত্মীয়ের মতো আচরণ এবং দলাদলি বা মারামারি করতে দ্বিধা করে না। ভোটাভোটি শেষ হলে সরকার কোরান, বাইবেল, গীতা বা অন্যু ধর্মের বই ছুঁয়ে শপথ নিয়ে বলে আমি সত্য কথা এবং সততার সঙ্গে কাজ করবো। কিন্তু ওয়াদা এবং কাজের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। তিন,চার বা পাঁচ বৎসর মেয়াদ পর্যন্ত সরকারি ও বিরোধীদলের মধ্যে সংসদে বা বাহিরে বাকবিতন্ডা,হাতাহাতি থেকে শুরু করে মারামারি পর্যন্ত হতে থাকে।
এইতো গত সপ্তাহে কানাডার মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে , NDP লিডার জগমিত সিং সমালোচনা করে (লিবারেল এবং NDP জোট) সরকারের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে দাবি দাওয়া না মেনে নিলে জোট সরকার থেকে সরে দাঁড়াবে বলেছে । কানাডার বর্তমান সরকার লিবারেল সংখ্যালঘু সংসদ সদস্য হওয়ায় NDP এর সঙ্গে জোট সরকার করেছে। কোনো গ্যারান্টি নেই যে চার বৎসর একত্রে দেশ চালাতে পারবে। বর্তমান সরকার ইতিপূর্বে ও জোট সরকার ছিল এবং পুরা মেয়াদ সংসদ চালাতে পারে নি , পুনরায় ইলেকশন দিয়ে সংখ্যা লগু সরকার গঠন করেছে। কানাডা একটা সভ্য দেশ, এখানে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সে ভাবে কাদা ছড়াছড়ি হয় না।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে গণতন্ত্রের ব্যর্থতার পিছনে যে কারণগুলি রয়েছে :
১) ক্ষমতার লোভ :
রাজনীতিতে ব্যক্তিগত সুবিধাভোগের কারণ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এবং এই দেশগুলিতে সত্যিকারের গণতন্ত্রের পথে এটিই সবচেয়ে বড় বাধা। ব্রিটিশ সরকার ভারত থেকে বিদায় নেয়ার পর থেকেই নেহেরু –গান্ধী পরিবার বহুদিন ক্ষমতা ধরে রাখছে, জনগণকে বুঝানো হয়েছে যে ভারতে আর কোনো যোগ্য ব্যক্তি নেই বা হবে না। অপরদিকে পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো ও তার কন্যা বেনজির ভুট্টো এবং নেওয়াজ শরীফ পরিবার মনে করেছিল পাকিস্তানের মালিকানা ওদের, এই দুই পরিবার ব্যাতিত আর কোনো ব্যাক্তি নেই দেশ পরিচালনার জন্য।
সিরিয়ার হাফেজ আল –আসাদ ১৯৭১ থেকে একটানা ২০০০ সন ও তার ছেলে বাসার আসাদ এ পর্যন্ত ক্ষমতায় রয়েছে। এই পরিবার ছাড়া কি আর কেউ দেশ পরিচালনা করার যোগ্য ব্যাক্তি নেই ? মূলতঃ এরা ক্ষমতা ছেড়ে যাবে কোথায় ? ক্ষমতা ছেড়ে দিলে নিজেদের কৃত অপরাধের বিচার হবে সে ভয়ে ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। অপর দিকে দেশ আজ ধ্বংস প্রাপ্ত, হাফেজ আসাদ যেটুকু দেশের জন্য ভালো কাজ করেছিল , তাঁর সুযোগ্য পুত্র দেশকে ঊনবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে দিয়েছে/ ধ্বংস করে ফেলেছে।
পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল আয়ুব খান তাঁর ম্যান্টর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে সরিয়ে ক্ষমতা নেন । ইস্কান্দার মির্জা আয়ুব খানকে exceptional promotion দিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান করেন। কিন্তু ক্ষমতা পাওয়ার পর দেরি না করে মির্জাকে ক্ষমতাচ্যুত করে স্বপরিবারে লন্ডন পাঠিয়ে দেন। তাঁর পরের ঘটনা সবার জানা, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে ৮০ হাজার বেসিক ডেমোক্রেট এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন । তাঁর যুক্তি ছিল সাধারণ মানুষ ভোটের মর্যাদা বুঝে না, কাজেই ওদের প্রতিনিধি ভোট দিলেই চলবে।
২ )স্বৈরাচারী শাসন: সামরিক সরকার তৃতীয় বিশ্বে বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের মসৃণ প্রবাহকে যুগে যুগে বাধাগ্রস্ত করেছে। উগান্ডার ইদি আমীন, ঘানার নক্রুমাহ আরো ও কত না জানা ব্যক্তি যারা যুগে যুগে ক্ষমতা ধরে রেখে দেশের ধ্বংস করেছে, তা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। প্রকৃতপক্ষে স্বৈরাচারী সরকার জনগণের মধ্যে ভয়ভীতির সৃষ্টি করে এমন ভাবে দেশ পরিচালনা করে , কেউ মুখ ফুটে সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলে হয় জেল , না হয় গুম খুন । ইদি আমিনের শাসনামলে উগান্ডার ৫০,০০০ এশীয়কে বহিষ্কার করেছে। ১২ মিলিয়ন লোকসংখ্যার দেশ উগান্ডা, আমিনের শাসনামলে ৫০০,০০০ লোককে হত্যা করেছে ।
একইভাবে, রুয়ান্ডা একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশ , কিন্তু এর সরকার, মিডিয়ার সহায়তায়, হুতু সংখ্যাগরিষ্ঠদের অস্ত্রে সজ্জিত করতে সক্ষম হয়েছিল এবং একশত দিনের ব্যবধানে সরকার হুতুদের দিয়ে ৮০০,০০০ বা তাঁর ও বেশি সংখ্যা লগু তুতসি হত্যা করেছিল।
) উচ্চ নিরক্ষরতা: তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে শিক্ষার হার নিম্নমানের, কি শিক্ষিত, কি অশিক্ষিত ভোটের মূল্য বুঝে না এবং কেউ বুঝলে ও অন্যের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে ভোট দেয়,, ব্যালট বাক্স চুরি করে। এই ভোট দেয়া নেয়া নিয়ে নিজের জীবন ও দিয়ে থাকে। একটা লোক বুঝে না যে “আমি একজনকে অনাকাঙ্খিত ভোট দিতে গিয়ে কেন নিজের জীবন দেব এবং নিজের পরিবারকে বিপদে ফেলবো ।
৪ )তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বেশির ভাগ রাজনীতিবিদই জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধি নন। তারা তাদের ভোটারদের কল্যাণ ও উন্নয়নের জন্য কাজ করার পরিবর্তে, তাদের নিজস্ব স্বার্থ অনুসরণ করে। এ সব লোক নিজের স্বার্থের প্রতি খেয়াল রেখে বহু পয়সা খরচ করে নির্বাচিত হয়। নির্বাচিত হওয়ার পর নিজের পেট ভরার কথা চিন্তা করে।
৫)রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের অভাব: তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে বেশিরভাগ মানুষ গ্রামাঞ্চলে বাস করে যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল এবং সংবাদ মাধ্যম থেকে বঞ্চিত থাকে এবং তাই তারা রাজনৈতিক উন্নয়ন এবং সরকারী উত্থানের প্রতি উদাসীন।
এ থেকে বোঝা যায় যে, রাজনীতির শিক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ। কানাডার মতো উন্নত দেশগুলিতে স্কুলে রাজনীতি, সমাজনীতি সম্পর্কে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দেয়া হয়। তাছাড়া এমনভাবে শিক্ষা ব্যাবস্থার প্রচলন করা হয়েছে যাতে ছেলেমেয়েদের নৈতিক চরিত্র গড়ে উঠে। ছেলেমেয়েদের অন্যায় কাজ থেকে যাতে বিরত থাকে সে দিকে খেয়াল রেখে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।
“অ্যারিস্টটলের মতে , গণতন্ত্র হলো সরকারের একটি জঘন্য রূপ, যেখানে অনেকে তাদের ক্ষমতাকে সাধারণের ভালোর জন্য নয় বরং তাদের নিজের জন্য ব্যবহার করে। “