৭১২ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম যুগ মুহাম্মদ ইবনে আল-কাসিমের সামরিক কমান্ডের অধীনে উমাইয়া খিলাফত কর্তৃক সিন্ধু ও মুলতান বিজয়ের পরে শুরু হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। অখণ্ড ভারতের পাঞ্জাবে সুলতান মুহাম্মদকে ( ১১৭৩-১২০৬) উত্তর ভারতে মুসলিম শাসনের ভিত্তি স্থাপনের জন্য কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তাহলে মুঘল শাসন শুরু হওয়ার অনেক পূর্ব থেকে ভারতে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, জৈন এবং বৌদ্ধরা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছিলো । আমরা মুঘল আমলের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দেখি রাজা বাদশার সিংহাসনে মন্ত্রী থেকে শুরু করে উজির,নাজির,পাইক পেয়াদা এবং কবি সাহিত্যিক- বিভিন্ন ধর্মের লোক একত্রে মিলেমিশে কাজ করেছে। ১৫২৬ সালে সম্রাট বাবর এর বিজয় থেকে ১৮৫৭ ব্রিটিশ দখল করার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত ভারতের মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। কিন্তু সে সময় কোনো ধর্ম বিরোধ দেখা দেয় নি বরং সবাই মিলেমিশে চলেছে ।তাছাড়া যে সব মুসলিম মুনিঋষি ধর্ম প্রচারে ভারতে এসেছেন , ওরা অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় ছিল, তাদের অনেক নিদর্শন আজ ও ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়; তাছাড়া এ সব মাজার যেমন আজমীর,সিলেট এবং আরো কত কি, সব ধর্মের লোকেরা জিয়ারতের বা দোআ নেয়ার উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করে।
ইংরেজ আমলে মুসলমানরা ব্রিটিশদের সঙ্গে অসহযোগ আন্দোলন করে খানিকটা পিছিয়ে গিয়েছিলো । মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষাকে হারাম বলে বিরোধিতা করেছে ; অপরপক্ষে হিন্দু ও অন্য্ ধর্মের লোকেরা সহযোগিতা করে লেখাপড়া,চাকুরী এবং ব্যবসা বাণিজ্যে এগিয়ে গিয়েছে । সে সময় মুসলমান বেশিরভাগ গ্রামেগঞ্জে বাস করতো; গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়ে উঠে নি, যে জন্য মুসলমান লেখাপড়া শিক্ষা থেকে পিছিয়ে যায়। ধীরে ধীরে মুসলমান নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এগিয়ে এসে ইংরেজি শিক্ষার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করে এবং ইংরেজদের সঙ্গে সহায়তা করে।
২
নিখিল ভারত মুসলিম লীগ : ১৯০৬ সালে ঢাকায় কিছু সুপরিচিত মুসলিম রাজনীতিবিদ ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম স্বার্থ সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর সাথে দেখা করে তাদের অভিমত ব্যাক্ত করে ; অতঃপর ভারতীয় মুসলমানদের অধিকার রক্ষার জন্য মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪০ সাল পর্যন্ত মুসলিম লীগ আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা করে নি যা প্রত্যাশিত স্বাধীন দেশ ভারত থেকে পৃথক হবে। কিন্তু ধীরে ধীরে সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপর বিভিন্ন দাঙ্গা, নির্যাতন বাড়তে থাকায় এই ভাবনা দানা বাঁধতে থাকে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু অধ্যুষিত দেশে সংখ্যালঘু মুসলিমদের পক্ষে ক্ষমতায় যাওয়া বা শান্তিতে থাকা কোনোক্রমেই সম্ভব হবে না। তাছাড়া হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় বিধিবিধানের জন্যএকত্রে বাস করতে গিয়ে দিনে দিনে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে ভারতে হিন্দুদের আধিপত্য বেড়ে যাবে।
১৯৪৬ সনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (স্বরাজ পার্টি, বেঙ্গল মুসলিম লীগ ও নিখিল ভারত মুসলিম লীগ) থেকে খাজা নাজিমুদ্দিনের বিরুদ্ধে বাংলার নির্বাচনে জয়লাভ করে প্রধান মন্ত্রী নির্বাচিত হন। তাঁর শাসনামলে ভারতীয় মুসলিম লীগ পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দাবিদাওয়া নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে তথা কলিকাতার রাস্তায় ও মিসিল করে; কিন্তু হিন্দু ও মাড়োয়ারি সম্প্রদায় এই সুযোগে পাল্টা আক্রমণ করে; এই দাঙ্গায় ৪ থেকে ৫ হাজার মুসলমান হতাহত এবং এক লাখের ও অধিক পরিবার বাড়িঘর থেকে অত্যাচার ও জোর করে বের করে দেয়। সারওয়ার্দী সাহেব গান্ধীকে নিয়ে শান্তি রক্ষার জন্য চেষ্টা করেন ও ধীরে ধীরে পরিস্থিতি অনুকূলে নিয়ে আসেন। এই দাঙ্গার পর পর নোয়াখালী,বিহার,উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। দেশের হিন্দু ও মুসলিম সংবাদপত্রগুলি উস্কানিমূলক এবং অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদনের মাধ্যমে জনসাধারণের অনুভূতি চরমে নিয়ে যায় ও হিন্দু -মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈরিতা বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে।
কয়েক শতাব্দী ধরে ভারতে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, জৈন এবং বৌদ্ধরা শান্তিপূর্ণভাবে একসাথে বসবাস করলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরম শত্রু হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৪৭ সনে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পনেরো মিলিয়নেরও বেশি লোক উচ্ছেদ এবং এক থেকে দুই মিলিয়ন বিভিন্ন দাঙ্গায় মারা যায় ; হিন্দু মুসলমান একে অপরের শত্রু হিসাবে পরিচিতি লাভ করে এবং আজ পর্যন্ত তার ভয়াবহ পরিস্থিতি রয়েছে ।
৩
হোসাইন শহীদ সারওয়ার্দী সাহেবের মতো একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময় ইস্কান্দার মির্জা ও আয়ুব খান চক্র যেভাবে নির্যাতন করে তাঁকে প্রধান মন্ত্রী থেকে ও পরবর্তীতে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে, তা ইতিহাস থেকে মুছে যাওয়ার মতো নয় । মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হোসাইন শহীদ সারওয়ার্দী কে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দেখতে চেয়েছিলেন এবং সারওয়ার্দী তাঁর যোগ্যতা দিয়ে তা প্রমান করে দেখিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মির্জা ও পরবর্তীতে জেনারেল আয়ুব খান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কার্যকাল সংক্ষিপ্ত করেছিলেন । প্রথমত এটা বিশ্বাস করা হয় যে রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মির্জা সোহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগের বিরুদ্ধে ছিলেন, কিন্তু যখন তার মুখোমুখি রাজনৈতিক বাস্তবতাবাদী অন্য কোনও বিকল্প ছিল না, তখন তিনি অর্ধহৃদয়ে তার নাম অনুমোদন করেছিলেন। তার কারণ হিসাবে বলা হয় যে সোহরাওয়ার্দীর রাজনীতির জীবনের একটা বিরাট অংশ ” চিত্তরঞ্জন দাসের স্বরাজ পার্টি “, ও গান্ধীর একনিষ্ট হিসাবে কাজ করেন। কাজেই সোহরাওয়ার্দী মনে প্রাণে একজন ভারতীয়।
১৯৪৭ সনের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে পাকিস্তানের রাজনীতির বিপর্যয় নেমে আসে এবং দেশটির রাজনৈতিক প্রতিহিংসা শুরু হয়; যার ফলে ঘন ঘন গভর্নর জেনারেল ও প্রধান মন্ত্রী নিয়োগ ও বরখাস্ত অব্যাহত থাকে।
সোহরাওয়ার্দী সাহেব একজন ব্যস্ততম রাজনীতিবিদ হওয়ার পাশাপাশি সদালাপী এবং রসিক মানুষ ছিলেন। আইন আদালতে তার পারফরম্যান্স ছিল … ব্রিলিয়ান্ট। তিনি যে সব মামলা মোকাবেলা করতেন তা ব্রহ্মচর্যের কারণ হয়ে দাঁড়াত এবং লোকেরা কেবল তার কথা শোনার জন্য আদালতে ভিড় করত।
রাজনীতি থেকে তিনি কখনো আর্থিক মুনাফা অর্জন করেননি। বরং জীবিকার তাগিদে আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, পাকিস্তানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, সোহরাওয়ার্দীর সাথেও একই আচরণ করা হয়েছিল।
সোহরাওয়ার্দীর সমালোচকরা তাঁর বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর যে অভিযোগটি উত্থাপন করেছেন তা হল, তিনি মিঃ গান্ধীর সাথে হাত মিলিয়ে অবিভক্ত ভারতের পক্ষে কাজ করেছেন। কিন্তু তিনি গান্ধীর সঙ্গে হাত মিলানোর কারণ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা দমন করা এবং তা সাফল্যের সঙ্গে করেছিলেন।
১৯৫৮ সনে এক প্রস্তাবের মাধ্যমে পাকিস্তানের গণপরিষদে সোহরাওয়ার্দীর আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হয়,যেখানে বলা হয় যে প্রস্তাব পাস হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে যে কেউ পাকিস্তানে বসবাস করেনি, সে গণপরিষদের সদস্য থাকবে না। প্রস্তাব পাস হওয়ার পর সোহরাওয়ার্দী সাহেব সমস্যায় পড়ে গেলেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসের চেষ্টা করেন। তিনি ১৯৫৮ সালের জুন মাসে পাকিস্তানের তৎকালীন রাজধানী করাচী থেকে ঢাকায় গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে দেশ থেকে বহিষ্কারের নোটিশ দেওয়া হয়।
প্রয়াত হোসেন সোহরাওয়ার্দী একজন সৎ রাজনীতিবিদ ছিলেন;তিনি পূর্ব ও পশ্চিম বাংলাকে পাকিস্তানের মানচিত্রে তুলে ধরার জন্য লড়াই করেছিলেন। এই উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য তিনি দিল্লিতে আইন প্রণেতাদের কনভেনশনে একটি প্রস্তাব ও পেশ করিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তাঁকে প্রধান মন্ত্রী হিসেবে তাঁর মর্যাদার আঘাত দেয় এবং যখন এই আঘাত অসহনীয় হয়ে ওঠে, তখন আহত লোকটি চিরতরে তার দেশ ছেড়ে চলে যান , ফিরে আসার চেয়ে নির্বাসনে মৃত্যুকে পছন্দ করেন । শুধু কি তাই ? তাঁকে পাকিস্তানী কোর্টে প্র্যাক্টিস করে বেঁচে থাকার অনুমতি ও দেয় নি, সেখানে ও শত্রুতা করা হয়েছিল ।
হোসেন শহীদ সারওয়ার্দীকে “গণতন্ত্রের মানসপুত্র ” বলা হতো। ১৯৫৪ সনে মাওলানা ভাসানী ও শেরে বাংলা একে ফজলুল হক মিলে “পূর্ব পাকিস্তান যুক্ত ফ্রন্ট “গঠন করে মুসলিম লীগ কে পরাজিত করে পূর্ব পাকিস্তানে একনিষ্ঠ জয়লাভ করার ব্যাপারে তিনি সাহায্য করেন। পরে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পরবর্তীতে “আওয়ামী লীগ ” গঠন করার কাজে সাহায্য করেন।
রাজনীতিতে শেখ মুজিবুর রহমান ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সম্পর্ক ছিল গভীর সৌহার্দপূর্ণ । সোহরাওয়ার্দী রাজনীতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের পরামর্শদাতা ও পথপ্রদর্শক ছিলেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে একজন তরুণ, বিশ্বস্ত ও উদ্যমী রাজনীতিবিদ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন । সোহরাওয়ার্দীকে বাঙ্গালীর নাগরিক অধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে স্মরণ করা হয়, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়।
সমাপ্ত