আমি পরিবার নিয়ে গত ৩৪ বৎসর কানাডার মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে বাস করি। এই দীর্ঘ সময়ে যতগুলি নির্বাচন যথা মিউনিসিপাল,প্রভিন্সিয়াল এবং ফেডারেল দেখেছি, প্রতিটি নির্বাচন নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হয়েছে। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর ভোট কারচুপি হয়েছে বলে আমি একবার ও শুনি নি।
এখানকার জনগণ বা স্কুল, কলেজ কি উনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা এই নির্বাচন নিয়ে কোনো সময় নষ্ট করে না। এ দেশে উনিভার্সিটিতে ছাত্র/ছাত্রী সংগঠন আছে, তবে কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ নিয়ে মাথা ঘামায় না। সরকার বা বিরোধী দল ছাত্র/ছাত্রীদের কাদা ছড়াছড়ি করতে দেয় না।
এ দেশে অনেকেই কথা প্রসঙ্গে বলে থাকেন,” তুমি সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করো অথবা নির্বাচন করে জনগণের কাজ করো; ভালো কাজ করলে অনেকদিন কাজে থাকবে, আর না হয় তুমি চাকুরিচ্যুত হবে, জনগণ ভোট দেবে না ,অত্যন্ত সহজ।”
আমি অনেক সময় কাজের জায়গায়, পরিচিত বা অপরিচিতের সঙ্গে কানাডার রাজনীতি নিয়ে অযাচিত আলাপ করতে গিয়ে যা উত্তর পেয়েছি তা নিম্ন রূপ :
১) কেউ কেউ বলতে শুনেছি, আমি বা আমরা ভোট দেই না, ভোট অযথা দিয়ে কোনো লাভ নেই , এ দেশ এ ভাবেই চলবে। আমার বা তোমার ভোট দেয়া নেয়া নিয়ে কিছু যায় আসে না।
২) দলের নেতৃস্থানীয়ের মধ্যে হাড্ডা হাড্ডি লড়াই টেলিভশন খোললে দেখি । মিডিয়া কোন পার্টি কতদূর এগিয়ে আছে বা পিছিয়ে আছে দেখায় , রিপোর্টারদের মধ্যে বিভিন্ন দলের নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিবর্গের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা করতে শুনি। কিন্তু বাহিরে জনগণের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া বা সাড়াশব্দ নেই। কেউ আলোচনা ,সমালোচনা করতে ও দেখি না।
এ দেশে ১০০% লোক শিক্ষিত, এরা প্রচার মাধ্যমে সরকারের জনপ্রিয়তা, ভালো, মন্দ দেখে এবং কাকে পরবর্তীতে ভোট দেবে মনে মনে ঠিক করে। তাছাড়া ভোটের পূর্বে পার্টি প্রধানদের মধ্যে হাড্ডা হাড্ডি বিতর্ক (ডিবেট) হয়, ওতে কোন পার্টি এগিয়ে ,কোন পার্টি পিছিয়ে, ভালোভাবে দেখে এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে ভোট দেয়ার চিন্তা করে ।
৩ ) গত ফেডারেল নির্বাচনে আমার স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রাথী এসে আমার বাড়ির দরজা নক করলে আমি দরজা খুলে অভ্যর্থনা জানাই। ওরা বলে তোমার বাড়ির সামনে একটা নির্বাচনী সাইন লাগাতে চাই; তুমি কি আমি বা আমার দলকে সমর্থন দাও?
আমি প্রত্যুত্তরে বললাম ” দুঃখিত, কাকে সমর্থন করি, এ ব্যাপারে কিছুই বলতে পারছি না। এটা আমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার। প্রশ্নিকর্তা এবং তার লোকজন মাথা নিচু করে সাইন না লাগিয়ে চলে গেছে। যদিও আমি ওকে এবং এই দলকেই ভোট দিয়েছি। কিন্তু আইন অনুসারে সে জিজ্ঞেস করতে পারে না বা আমিও বলতে পারি না।
রাস্তার মোড়ে,ড্রাইভওয়ে বা কারো কারো বাড়ির সামনে ভোটার প্রার্থীর ছবি সহ সাইন দেখা যায়। কিন্তু ভোট কেন্দ্রে গেলে দেখি অনেক প্রার্থী যারা কখনই চেহেরা দেখাতে আসে নি। কাকে ভোট দেব ?
এদের ভোটের জন্য মাথা ব্যাথা নেই, পয়সা খরচ করে না ক্যাম্পেইন করার জন্য, মারামারি তো দূরের কথা । “ভোট দেব কাকে, অমুক ভাইকে, তমুক ভাইকে, কেউ বলে না।” পাশ করলে চার বৎসরের জন্য চাকুরী হয়ে গেলো, না হলে শখ করে দেখলো । এ দেশে আমাদের দেশের মতো মার্কা বলতে “হাতি,ঘোড়া,বাঘ, মহিষ ,হরিণ” কিছু নেই। ভোটার লিস্টে দলীয় মনোনীত ব্যাক্তির নাম আছে, আপনার পছন্দের ব্যক্তিকে, যাকে পছন্দ ভোট দিয়ে দেবেন। কেউ আপনাকে কোনো প্রশ্নই করবে না। ভোট দিতে ভোটার কার্ড, না থাকলে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখে আপনাকে শনাক্ত করবে।
৪ ) এ দেশে অগ্রিম ভোটদান পদ্ধতি আছে , দুই/তিন সপ্তাহ পূর্ব থেকে ভোট নেয়া শুরু করে বা ডাকে ও ভোট দিতে পারেন। যে কোনো লোক তার কাজের সুবিধা অনুযায়ী অবসর সময়ে গিয়ে ভোট দিয়ে আসে। ভোট দিয়ে কাজের জায়গায় যদি বলি আমি ভোট দিয়েছি, আমার সহকর্মীরা তাকিয়ে থাকবে, কোনো আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করবে না ” তুমি কাকে ভোট দিয়েছো ?” এটা তার আলোচনার বিষয় নয়।
৫) কানাডার যে কোনো স্থান থেকেই ভোটার ভোট দিতে পারেন নিজের এলাকার পছন্দের ব্যক্তিকে। ওরা আপনার মূল্যবান ভোট জায়গা মতো পাঠিয়ে দেবে, আজকাল কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটের যুগ, সব কিছুই সম্ভব এবং নিজের ঘরে বসে ও ভোট দেয়া যায়। কোনো ক্যাম্পেইন, কারো সঙ্গে আলাপ করার প্রয়োজন নেই। এমন কি নিজের স্ত্রী বা ছেলে মেয়েকে ও বলার দরকার নেই , কেউ এসে ঘাড়ে চেপে এ ব্যাপারে জোর জবরদস্তি করবে না। কানাডার আইন কানুন সবাই মেনে চলে।
৬) ভোটের দিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত একটানা ভোট গ্রহণ চলে। ভোট কেন্দ্রে সকাল এবং বিকেলের দিকে কিছুটা ভিড় হয়, বাকি সারা দিন ভিড় হয় না। তাছাড়া অনেকেই অগ্রিম ভোট দিয়ে থাকে যে জন্য ভোট কেন্দ্রে লোকজনের উপস্থিতি কম। সব প্রার্থীর লোক হয়তো বা ভোট কেন্দ্রে থাকে শুধু নিয়ম শৃঙ্খলার জন্য; কিন্তু ভোট কেন্দ্রে টু শব্দটি ও হয় না ; ভোট দেয়ার পর পর বাসায় গিয়ে লোকজন টেলিভিশনে ভোট গণনা দেখে এবং রাত ১২টার মধ্যে মোটামোটি ধারণা করা যায় কে বা কোন দল পাশ করতেছে।
৭) রাত ১টার দিকে প্রথমে পরাজিত দলের প্রধান মঞ্চে এসে হইচই করে পরাজয় স্বীকার করে জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তব্য রাখে এবং নিজেদের ব্যার্থতার কারণ ব্যাখ্যা , পরবর্তীতে আরও শক্তি নিয়ে মাঠে আসবে ও ওপর দলকে অভিনন্দন জানিয়ে সরকার গঠনের জন্য আহবান জানায়। কি সুন্দর ব্যবস্থা ? পরাজিত ব্যক্তি বা দল অতি সহজেই পরাজয় মেনে নিয়ে অপরকে সাহায্য করে।
৮) এবার বিজয়ী দল জয় জয় স্লোগান দিয়ে মঞ্চে আসে এবং পরাজিত দলকে বক্তব্যের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তব্য শুরু করে। এ ছাড়া যা যা জনগণের নিকট অঙ্গীকার করেছে,বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়ে হইচই করে বক্তব্য দিয়ে পর্ব শেষ করে।
৯) এখানে পরাজিত বা বিজয়ী দল কোনোরকম কাদাছোড়া ছড়ি করে না। এই হলো কানাডার নির্বাচন নিয়ম কানুন।
১০) পরাজিত প্রধান মন্ত্রী হোক বা দল প্রধান হোক, সাধারণত জনসমর্থন নেই বলে দল প্রধান থেকে অব্যাহতি নেয় এবং অন্য নতুন কাউকে সুযোগ দিয়ে রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়ে থাকে। বিজয়ী দল সরকার গঠন করে নিজের অঙ্গীকার অনুযায়ী কাজ করে যায় এবং পূর্ব প্রশাসনের ব্যার্থতা নিয়ে আলোচনা,সমালোচনা না করে নিজের দেয়া কর্মসূচি অনুযায়ী কাজ করে। এ দেশের সরকার বা জনগণ অযথা পূর্বের সূত্র টেনে এনে ঝগড়া করে না বা পছন্দ করে না। এখানকার জনগণ খেয়াল করে সরকার ঠিক ভাবে কাজ করছে কি না ?
মিডিয়া সময় সময় তথ্য দিয়ে জানিয়ে পর্যালোচনা করে সরকারের যোগ্যতা এবং অযোগ্যতা;সময় সময় জনপ্রিয়তা যাচাই করে এবং এর উপর নির্ভর করে এই দল পরবর্তীতে সরকার ঘটনা করার মতো কি না ?
১১) আমি ১৯৮৮ সন থেকে এ দেশে বিভিন্ন নির্বাচন দেখে আসছি, সে সময় কানাডার প্রধান মন্ত্রী সম্মানিত মার্টিন ব্রায়ন মালরোনি (Martin Brian Mulroney)ছিলেন। মার্টিন ব্রায়ান মালরোনি, একজন আইনজীবী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ এবং (১৯৮৪ থেকে ১৯৯৩ কনসারভেটিভ পার্টি ) ৯ বৎসর দেশের প্রধান মন্ত্রী ছিলেন। । মালরোনি শেষের দিকে উত্তর আমেরিকার মুক্তবাণিজ্য ( North American Free trade ) বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেন এবং নিজ থেকে রাজনীতি থেকে সরে পড়েন। মালরোনি জনসমর্থন হারালেও ওর দেয়া North American Free Trade আজ ও কানাডা, USA এবং মেক্সিকো মেনে চলছে। মালরোনি জনসমর্থন হারিয়ে পদত্যাগ করে কিম ক্যাম্বেলকে(Kim Campbell ) ক্ষমতা ছেড়ে দেন । জন সমর্থন না থাকলে কেউ জোর করে গদি বা দলের পদ ধরে না রেখে অন্যকে সুযোগ দিয়ে রাজ্ নীতি থেকে সরে পড়ে ।
১২) সম্মানিত মিসেস কিম ক্যাম্পবেল (জুন ১৯৯৩ থেকে নভেম্বর ১৯৯৩ ) ৬ মাস প্রধান মন্ত্রী ছিলেন। তাঁর জনসমর্থন না থাকায় লিবারেল পার্টি জন ক্রিস্টিয়েনর(Jean Chrétien) নিকট নির্বাচনে হেরে যান ,যার ফলে রাজনীতি থেকে সরে পড়েন।
১৩) জন ক্রিস্টিয়েন (লিবারেল) একজন আইনজীবী এবং রাজনীতিবিদ যিনি (১৯৯৩ থেকে ২০০৩) ১০ বৎসর কানাডার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন । কিন্তু জনপ্রিয়তা হ্রাস পেলে তৎকালীন ফিনান্স মিনিস্টার পল মার্টিন স্থলাভিসিক্ত হন ।
১৯৯৫ সালের কুইবেক গণভোট: জন ক্রিস্টিনের সময় ৩০ অক্টোবর, ১৯৯৫ তারিখে কানাডার কুইবেক প্রদেশে অনুষ্ঠিত গণভোট, যা কুইবেক এবং কানাডার বাকি অংশের মধ্যে একটি নতুন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অংশীদারিত্বের মধ্যে প্রদেশের জন্য সার্বভৌমত্বের প্রস্তাব করে। গণভোটে মাত্র ১ শতাংশ বা ৫৫,০০০ এরও কম ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়। ফলে কুইবেক আর কানাডা থেকে আলাদা হতে পারে নি।
১৪ )সম্মানিত পল মার্টিন(Paul Martin), ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদ যিনি কানাডার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন (২০০৩-২০০৬) ৬ বৎসর । ২০০৩ নির্বাচনে পল মার্টিন কনজারভেটিভ স্টিফেন জোসেফ হার্পার (Stephen Joseph Harper ) এর নিকট হেরে যান।
১৫) স্টিফেন জোসেফ হার্পার একজন রাজনীতিবিদ যিনি (২০০৬ থেকে ২০১৫) ৯ বৎসর কানাডার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ।
১৬) কানাডার প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী পিয়ার এলিয়ট ট্রুডোর ছেলে জাস্টিন ট্রুডো(Justin Pierre James Trudeau) ২০১৫ সালে তার বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে কানাডার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচনে স্টিফেন জোসেফ হার্পারকে হারিয়ে জয়লাভ করেন। জাস্টিন ট্রুডো এবার (২০২১) পুনরায় তৃতীয়বারের মতো জয়ী হয়ে প্রধান মন্ত্রী হন।
জাস্টিন ট্রুডো, প্রধান মন্ত্রী, মাসে অন্ততঃ একবার মিডিয়াতে এসে দেশের করোনা পরিস্থিতি, ও দেশের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা করেন। রিপোর্টার প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে জর্জরিত করে এবং সব প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য। বক্তব্য শেষ করে যে চেয়ার এ বসে ছিলেন, নিজ থেকে সরিয়ে উঠে চেয়ার সুন্দর করে রেখে মিডিয়া থেকে বিদায় নেয়; কতখানি নম্র/ভদ্র হলে একজন প্রধান মন্ত্রী নিজের বসার চেয়ার ঠিক করে রেখে যেতে পারে ?
সমাপ্ত