“সাজিয়ে গুছিয়ে দে মোরে ,
সজনী তোরা, সাজিয়ে গুছিয়ে দে মোরে
বরই পাতা গরম জলে , সাজায়ে মশারির তলে
আতর লোবান আমায় মাখায় দে। ……”
এটি একটা বাংলা পপ গানের একটা অংশ। ১৯৭৬-৭৭ সালের কথা , বাংলাদেশে তখন পপ সংগীতের জোয়ার বইছে। গানটা কে গেয়ে ছিল , আজ আর তা মনে নাই। কিন্তু গানটা আমার খুব প্রিয় পপ গানের একটা।
টরোন্টোতে গত প্রায় তিরিশ বছর এই সাজানো গুছানোর কাজটা যে করে আসছে , তার নামটি শমশের আলী হেলাল। জন্ম হয়েছিল ঢাকা আজিমপুর কলোনিতে , ছোট বেলায় সেইখানেই বেড়ে উঠেছেন। পৈতৃক বাড়ী পাবনা জিলার সদর থানার কুলদী গ্রামে। টরোন্টোর বাংলাদেশী কমিউনিটিতে একটু অতি পরিচিত নাম। অবশ্য অনেকেই ওনাকে চেনেন আরেকটি নামে- “লাশ হেলাল “।
সকালের সূর্য্যটা দেখলে নাকি সারা দিন কেমন যাবে বলা যায়। কিন্তু প্রবাদটি হেলাল ভাইয়ের জীবনে মিথ্যা প্রমানিত হলো। আজিমপুর লিটল এঞ্জেলস স্কুলে লেখাপড়ার হাতে খড়ি। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত স্কুলের রেজাল্ট সব সময় খুব ভালো ছিল। বাবার সরকারের চাকুরীর কারনে অনেক দিন ঢাকার বাইরে থেকে আবার ঢাকাতে ফিরলেন ১৯৬৮ সালে। ভর্তি হলেন গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে। কিন্তু স্কুলের ওই ভালো ছাত্রটির আগ্রহ বাড়তে লাগলো বন্ধু আর আড্ডার প্রতি, ঝুঁকতে লাগলো বাইরের জগতের প্রতি । ওই সময় স্বপ্ন দেখতো , একদিন সে জাতীয় ফুটবল দলের গোলকীপার হবে। তাইতো রোজ বিকেলে আজিমপুর মাঠে তখনকার জাতীয় দলের গোলকীপার সেন্টু ভাইয়ের কাছে প্রশিক্ষণ নিতেন।
১৯৭১ সালে মুক্তি যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অনিয়ম আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে যেয়ে ,ভবিষ্যতের গোলকীপার হেলাল পরিণত হলো ” মস্তান হেলাল ” এ। আর এই নামের বদৌলতে হারিয়ে যেতে থাকেন নেশার অন্ধকার জগতে। ১৯৭৪ সালে ম্যাট্রিকে বাংলা পরীক্ষার দিন সামান্য একটা মস্তানীর ঘটনার জন্য , পরীক্ষা না দিয়েই হল ছেড়ে বারিয়ে আসলেন। স্কুলের দেয়াল টপকে একবার বেরিয়ে আসলে আর কোনো দিন যে সামনের দরজাটা দিয়ে ঢোকা যায়না। হয়তো কথাটা ওই দিন তিনি জানতেন না অথবা জানলেও ফিরে দেখার চেষ্টাও করেননি।
শৈশবের সেই ভালো ছাত্রটি হারিয়ে গেল “মস্তান ” নামের আড়ালে। বাবা ছিলেন একজন আদর্শ পুলিশ অফিসার। বাবার দৃস্টিতে মস্তান কথার অর্থই “অপরাধী”। আইন আর অপরাধীর মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। মোস্তান হেলাল কোনো ভালো কাজ করলেও , বাবার কাছে সেটা অপরাধ হিসাবে পেশ করা হতো। একসময় কথা বন্ধ হয়ে গেল দুজনের মধ্যে।
পথ তাকে কাছে ডাকলো। ১৯৭৬ সালে ভাসানীর ফারাক্কা লং মার্চে অংশ নিয়ে পরিচিত হলেন অনেক রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বৰ সাথে। ১৯৭৭সালে আবারো মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ফেল করলেন। ধীরে ধীরে বুঝতে লাগলেন আসলে রাজনীতির ভিতরের জিনিষটা অন্তর্সার শূন্য। সিদ্ধান্ত নিলেন দেশ ছাড়ার।
শুরু হলো যাযাবর জীবনের একটা নতুন অধ্যয়। ১৯৭৮ সালের ৮ই জুন। ইতালির উদ্দশ্যে মস্কোয়ের পথে ঢাকা ছাড়লেন। বিদায় বেলা বাবা বলেছিলেন “যদি কখনো নিজেকে পরিবর্তন করতে পারো তবেই দেশে ফিরবে। অন্যথায় তোমার আর ফিরে আসার দরকার নাই। ” ওটাই ছিল বাবার সাথে শেষ দেখা। ইতালিতে থাকা অবস্থায় বাবার মৃত্যু হয়।
ইউরোপ আসার পর পরিবর্তন হয় চিন্তা-চেতনার, সব সময় নিবেদিত ছিলেন পরের জন্য। কিন্তু কোথাও স্থায়িত্ব পেলেন না। ১৯৮৩ তে পাড়ি জমালেন কানাডাতে। তরী ভিড়লো সঠিক ঠিকানায়।
সেই থেকে হেলাল ভাই টরোন্টোতে থাকেন। বদলে গেছে অনেক কিছু বদলে গেছে জীবন। সময়ের স্রোতের মাঝে হারিয়ে গেছে সেই মস্তান আর যাযাবর হেলাল ভাই । জীবনের রঙ্গিন স্বপ্ন গুলো পূরণ করতে যেয়ে এখানেও চলতে থাকে সেই একই জীবন ধারা। একটা সামান্য ঘটনা নিজের অজান্তেই পাল্টে দেয় মানুষের জীবন। ১৯৮৫ সালের প্রথম দিনের একটা সুক্ষ্য ঘটনা পাল্টে দেয় তার জীবনের গতি। শুরু করলেন ধর্মের পথে চলতে। হারিয়ে গেল তার এতদিনের পরিচিত প্রিয় নেশার জগৎ।
১৯৯০ সাল থাকে এখন পর্যন্ত হেলাল ভাই ট্যাক্সি চালান। কারণ হিসাবে বলেন এটাই তার সব চাইতে বড় বিদ্যাপিট। বিভিন্ন দেশ আর জাতীর যাত্রীরা ওনার গাড়িতে বসেন। সবার মধ্যে উনি ছড়িয়ে দিতে চান ওনার শিক্ষার প্রথম ছবক “Peace be upon you ” .
ছোট বেলা থেকে সবার বিপদে এগিয়ে যাবার স্বভাব ছিল তার। ১৯৯০ সালের কোনো একটা দিন, একটা মৃত্যু সংবাদে ছুটে যান স্থানীয় একটা হসপিটালে। লাশের সৎকার করা প্রয়োজন কিন্তু ওই সময় টরোন্টোতে লাশ গোসল করাবার তেমন ব্যবস্থা ছিল না। বন্ধুরা মিলে লাশটা একটা চার্চে নিয়ে যায় এবং আরো ২ / ৩ জন বাংলাদেশ আর পাকিস্তানিদের সহায়তায় হেলাল ভাই জীবন প্রথম লাশ গোসলের কাজটি সম্পর্ণ করলেন।
হেলাল ভাইকে অন্যের প্রথম লাশ ধোয়াবার অভিজ্ঞতটা জিজ্ঞাস করতে বললেন “লাশের শরীরে প্রথম হাত দিয়ে আমার মনে অন্য রকম একটা ভাবনা আসলো। আমি অনুভব করলাম এর মতো আমিও যেকোনো সময় মৃত্যু বরণ করতে পারি। মুহূর্তেই আমার নাম হেলাল থাকে লাশ হয়ে যাবে। আমি কোথায় মারা যাবো, কে আমার লাশ ধোয়াবে ,কোথায় দাফন হবে ,আমার লাশ নিয়ে করা ছুটাছুটি করবে। এক ধরনের ঘোরের মধ্য দিয়ে নানা ভাবনায় আমি লাশ ধোয়ানোর খুঁটিনাটি ডাকলাম দেখলাম ও সাহায্য করলাম। সেদিন থাকে টরোন্টোতে কারো মৃত্যু সংবাদ আসলে নিজেই ছুটে যেতাম লাশ ধোয়ানোর জন্য।”
টরোন্টোর মুসলিম কমুনিটিতে লাশ ধোয়ানোর কারণে সবাই ওনাকে “লাশ হেলাল ” বলে চেনে। এই সেবামূলক কাজের জন্য স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০০ সালে কানাডার মর্যাদাপূর্ণ অন্টারিও ভলেন্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন তিনি।
সে দিনের সেই “মোস্তান হেলাল” আজ “লাশ হেলাল”। কি বিচিএ এই জীবন !!!!!
ধন্যবাদ হাফিজ ভাই, ব্যতিক্রমধর্মী সেবাদানকারী একজন মানুষকে আমাদের সামনে নিয়ে আসার জন্য. হেলাল ভাই, আপনাকে সশ্রদ্ধ সালাম.
শুনলাম সেয়ার্স বন্ধ হয়ে যাবে, অনেক লোক বেকার হবে / আবার হাজার হাজার রেফিউজি কানাডাতে প্রবেশ করে প্রতিবৎসর / পৰিস্থিতি খুবই ভয়াবহ / কারণ সম্পদ সীমিত / কেউকি বিস্তারিত হাইলাইট করবেন ?
মোহাম্মদ আবেদীন
আবেদীন ভাই সাহেব, আপনার প্রশ্নটা ঠিক বুজতে পারলাম না।
সেয়ার্স , বেকার আর রিফুজী কোন ব্যাপারটার উপর আপনি আলোচনা করতে চান ?
আমার মনে হয় আমরা এই ব্যাপারে আপনার মতামতটা সবার আগে জানতে চাই।
তারপর না হয় আমরা আমাদের মতামতটা নিয়ে আসবো।
আপনার কথা শোনার অপেক্ষায় থাকলাম।…..