ক্যাম্পিং কানাডিয়ানদের কাছে একটি জনপ্রিয় অবকাশ যাপনের উপায়। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালীন সময়টা সব ক্যাম্প গ্রাউন্ডগুলো ভরা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রায় এক বছর আগেই বিক্রি হয়ে গেছে প্রতিটি স্পট। শুধু ক্যাম্পিং নয় অনেকে আবার পছন্দ করেন কটেজ। যদিও খরচের দিক থেকে ক্যাম্পিং অনেক সস্তা বটে। আমার দৃষ্টিতে ক্যাম্পিং এর জনপ্রিয়তা বেশী – কারণ এর মধ্যে একটা এডভেঞ্চার আছে। রাতে বনের মধ্যে তাবুতে ঘুমিয়ে থাকার যে মজা যে পাইনি সে হয়তো অনেক কিছুই মিস করেছে। রাতের বেলা বাইরের কোন অপরিচিত শব্দে ঘুম ভাঙলে, বাইরের উকি দিয়ে হয়তো দেখবেন কোন রেকুন বা ভালুক খাবার সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে আপনার তাবুর পাশে। কিন্তু ভয় পাওয়ার মতন কিছু নেই তাতে। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলে দেখবেন হয়তো একটা খরগোশ বা হরিণ ঘাস খাচ্ছে আপনার তাবুর সামনে।
সবার কাছে ক্যাম্পিংয়ের গল্প শুনতে শুনতে আমারও আগ্রহ হলো, এর স্বাদ নেবার। যথাপোযুক্ত সঙ্গিও পাওয়া গেল। হফিজ ভাই, খোকন ভাই আর মনির ভাই। সবাই সপরিবারে। সব মিলিয়ে আমাদের সদস্য সংখ্যা দাড়ালো ১১ জন। আমাদের গন্তব্য নির্ধারিত হলো Summer House Park, Camp Ground এটা একটা ব্যক্তি মালিকানার সম্পত্তি। এটার অবস্থান ব্রুস পেনিনসুলায়। মিলরে লেকের পাড়ে। আমাদের জন্য তিনটি SPOT ভাড়া নেয়া হলো। এর মধ্যে ২টি তাবুর জন্য আর অন্যটা Travel Trailer এর জন্য। Travel Trailer -টি মূলত মহিলা আর বাচ্চাদের জন্য। সেই সাথে সেখানে খাবার রাখার জন্য ফ্রিজ আর রান্নার ব্যবস্থাও আছে। ধীরে ধীরে আমাদের প্রস্তুতি চলতে লাগলো। সবাইকেই কিছু কিছু দায়িত্ব দেওয়া হলো। অবশেষে এলো আমাদের যাত্রার দিনটি।
আমাদের মিটিং পয়েন্ট হাফিজ ভাইয়ের বাসা। সকাল বেলা যথা সময় আমরা হাজির হলাম সেখানে। তারপর শুরু হলো আমাদের যাত্রা, ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে। দূরত্ব প্রায় ২৫০ কিলোমিটার। পথে একটা বিরতি নিয়ে দুপুর প্রায় দেড়টায় এসে পৌছুলাম ক্যাম্পে। আসার সাথে সাথেই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমার দুটি স্থানে তাবু স্থাপনের সাথে সাথে অন্যান্য আনুসাঙ্গিক কাজ আর মহিলারা দুপুরের খাবার তৈরীতে। এই দুটি কাজ যখন শেষ হলো তখন বিকেল প্রায় ৫টা। সবাই বেরিয়ে পড়লাম আমাদের Camp Ground টা ঘুরে দেখতে। ৮৫ একর জমির উপর এই Camp Ground এ মোট ২৩৫ টি Campsite আছে। প্রতিটি Site এর সাথে একটা Picnic table আর একটা Fire Pit আছে। আমাদের ঘোরা শেষ করে আমরা লেকের পাড়ে ‘ডেক’ এ এসে বসলাম। এখানে আছে সুন্দর আর ছোট একটা Sandy beach। এখান থেকেই ভাড়া করা যায় Boat, paddle boat, canoe আর Kayak। এখানে কেউ beach এ হাটলো আর কেউবা paddle boat চালালো, তারপর সন্ধ্যায় আবার ফিরলাম ক্যাম্পে।
এবার সন্ধ্যা আয়োজন। হফিজ ভাইয়ের ছেলে আরিব ক্যাম্পের অফিস থেকে Firewood কিনে আনলো Campfire এর জন্য। আর সেই কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালাল Fire pit এর মধ্যে। এটা ছিল তার জন্য নির্ধারিত কাজ। আস্তে আস্তে সবাই এসে ঘিরে বসলো সেই আগুনের চারিপাশে। আমার জন্য নির্ধারিত ছিল রাতের BBQ। আমিও শুরু করলাম আমার কাজ। একদিকে Campfire অন্য দিকে পুড়ছে মুরগী আর এসবের মধ্যে সমান তালে চলছে গল্প, হাসি, তামাশা। বাড়তে থাকে রাত, আমরা এখানেই সেরে নেই আমাদের রাতের খাবার। তারপর ১১টার আগেই ফিরে যাই নির্ধারিত তাবুতে। কারণ রাত্র ১১টার পরে বাইরে জোরে কথা বলা যাবেনা – এটাই নিয়ম। তাবুতে ঢোকার পরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। হঠাৎ করে কোন কারণে ঘুম ভাংতেই বুঝলাম কেউ এসেছে তাবুর বাইরে। তবে সেটা যে ভালুক নয়, তা নিশ্চিত। বাইরে উকি দিয়ে দেখি মহিলারা এসে হাজির কারণ এই জঙ্গলের মধ্যে তাদের ঘুম আসছে না। সম্ভবতঃ ভয়তেই হবে। এবার শুরু হলো আড্ডার ২য় রাউন্ড, চললো বেশ কিছুক্ষণ। তারপর যখন তারা চলে গেল হারিয়ে গেলাম গভীর ঘুমের মাঝে। হাফিজ ভাইয়ের সেই কড়া নাক ডাকাও আমার ঘুম ভাঙ্গাতে পারে নাই।
রাতের কড়া ঘুমের পর সকালে উঠে বেশ হালকা লাগছিল। আজ দ্বিতীয় দিন, আমাদের দিনের তালিকায় আছে, দুটি স্থান পরিদর্শন। প্রথমটা Sauble Falls আর দ্বিতীয়টা Lion’s head লাইট হাউস এবং Bruce Trail। সকাল ১০টার আগেই দুটি গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। Sauble Falls এর দূরত্ব খুব বেশী নয় আমাদের ক্যাম্প থেকে। মাত্র ৩০ মিনিটের ড্রাইভ। Sauble Falls ছোট আর সুন্দর একটা Water Falls। ঝর্ণার পানিটা Sauble নদী হয়ে শেষ পর্যন্ত লেক হুরনে চলে যায়। আমরা সবাই পানিতে ভিজলাম এখানে। বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে দুপুরে রওনা দিলাম Lion’s head বাতিঘরের উদ্দেশ্যে। এখানে পৌছে দুপুরের খাবার পর্ব শেষ করে hiking এর জন্য বেরিয়ে পড়লাম Bruce Trail ধরে। সারা বিকেল লেকের পাড়ে কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফিরলাম Camp Ground -এ। কেউ চলে গেল হালকা বিশ্রাম নিতে, কেউবা paddle boat -এ, খোকন ভাই আর মনিরভাই বেরিয়ে পড়লেন মাছ ধরার উদ্দেশ্যে। যথারিতি সন্ধ্যায় আবার সবাই একত্রিত হলাম। শুরু হলো আরিবের Campfire আর আমার BBQ পর্ব। খাওয়া দাওয়া আর এই আড্ডা শেষে মাঝ রাতের কিছু আগে সবাই গেলাম লেকের পাড়ে ডেকের উপর। এখানে বলে রাখা ভালো এটা ছিল শুক্লপক্ষ, সম্ভবত দ্বাদশী বা ত্রয়োদশীর রাত। আকাশে পূর্ণ চাঁদ। লেকের পানিতে চাঁদের আলো আর সেই বনবাসীর উপর ছড়িয়ে থাকা জোৎস্নায় মনে হচ্ছিলো বসে আছি বাংলাদেশের কোন নদীর পাড়ে, একটি চাঁদনি রাতে।
তৃতীয় দিনের প্রস্তুতি। আরও একটা ব্যস্ত দিন সামনে। আজ আমরা যাবো টোবারমুরি এবং সাইপ্রাস লেকে। Tobermory দক্ষিণ ব্রুস পেনিনসুলার একটা ছোট জলবসতী। টরেন্টো শহর থেকে ৩০০ কিঃমিঃ দূরে। ছোট্ট কিন্তু ছবির মতন সাজান একটি বিশেষ টুরিস্ট আকর্ষণ। এখানেই আছে Big Tub Light House -এটি ১৮৮৫ সালে তৈরী। দুপুর পর্যন্ত Tobermory -তে কাটিয়ে চললাম Cyprus Lake এর উদ্দেশ্যে। পথে সাথে করে আনা খাবার দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সারলাম। যখন Cyprus লেকে খাবার জন্য পার্কের গেটে আসলাম তখন জানতে পারলাম আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে। কারণ ভিতরের সব Parking Spot গুলো ভরে গেছে। অতিরিক্ত গাড়ী যেতে দিতে কর্তৃপক্ষের আপত্তি। তথাস্থ বলে রাজী হয়ে হেলাম। কিন্তু মহিলারা অপেক্ষার জন্য তৈরী নয়। তারা ফিরে যেতে চায় ক্যাম্পে। সিদ্ধান্ত হলো আমি আমার ছেলে-মেয়ে এবং হাফিজ ভাই আরিব সহ আমরা অপেক্ষা করবো আর বাকী সবাই ফিরে যাবে। তাই হলো। ১৫/২০ মিনিট অপেক্ষার পরে গেটে আমাদের ডাক পড়লো। গেট থেকে ঢুকে ৫/৬ কি: মি: গাড়ী চালিয়ে পৌঁছালাম Cyprus লেকে।
এখানে গাড়ী রেখে হাটতে হবে BRUCE TRAIL ধরে। আমাদের গন্তব্য GROTTO আর INDIAN HEAD COVE। এই GROTTO হচ্ছে BRUCE PENINSULA-এর একটি অন্যতম আকর্ষন। আমরা যখন TRAIL ধরে হাটছিলাম তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে কিন্তু সন্ধা নয়। ঘন গাছ পালার জন্য ভিতরে আলো বেশী প্রবেশ করেনা এখানে তাই মনে হচ্ছিল হয়তো সন্ধা হয়ে আসছে। প্রায় এক ঘন্টা হাটার পরে পেইলাম গন্তব্যে নিচের পানি থেকে প্রায় ৫/৬ শত ফুট উপরে পাথরের উপর দাড়িয়ে বুক ভরে নিশ্বাঃস নিলাম। মুখ থেকে বেরিয়ে আসলো একটা শব্দ-অপরূপ। ভুলে গেলাম সব ক্লান্তি। বেশ কিছুটা সময় এখানে কাটিয়ে ফিরে আসলাম ক্যাম্পে। কিছুক্ষন বিশ্রামের পরে শুরু হলো আমাদের সেই সন্ধা অধিবেশন। Campfire আর জমিয়ে আড্ডা। কাল আমাদের ফিরে যাবার পালা। তাই রাতে ঘুমাতে যাবার আগে সম্ভব্য সব গুছিয়ে নিলাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুরু হলো যাবার প্রস্তুতি। সব কিছু গাড়ীতে তোলা হচ্ছিল। আমি হাফিজ ভাইকে সাহায্য করলাম Tent দুটোকে গুছিয়ে নিতে। মহিলারা ব্যস্ত সকালের নাস্তা আর দুপুরের জন্য সাথে করে নিয়ে যাওয়া খাবারের জন্য। কারন পথে আমরা যাত্র বিরতি করবো Sauble Beach-এ, বিশ্বের দীর্ঘতম Fresh Water Beach এর মধ্যে অন্যতম একটা Beach এই Sauble Beach।
যথাসময় যাত্রা শুরু করলাম। দুপুর নাগাদে পৌছে গেলাম Sauble Beach-এ। Sauble Beach-এ আমার এটাই প্রথম আসা। আমরা পৌছবার আগেই ওখানে পৌছে গিয়েছিল বাবু আর সাইদ ভাই। দুজনেই সপরিবারে এসেছেন টরেন্টো থেকে। এটা অবশ্য আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। তৈরী হলো ছোট খাটো একটা Picnic এর পরিবেশ। সবাই সেদিন উপভোগ করেছিল এই আনন্দ। বিকেলে চায়ের পট ক্ষেয়ে করে বাড়ী ফিরবার পালা। তিন রাত্রের Camping এর ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা নিয়ে বাড়ী ফিরলাম। অনেক আনন্দের সেই অভিজ্ঞতা।
এই লেখাটি যখন লিখছি তার অনেক আগেই আমরা আমাদের এ বছরের Camping এর জন্য জায়গা নির্ধারন করে ফেলেছি। এবার আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন আরো দুটি নতুন পরিবার। যারা আমাদের গল্প শুনেই ভালোবেসে ফেলেছেন Camping কে। হয়তে আগামীতে এই সংখ্যা আরো বাড়বে।
এ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে আবারো ফিরে আসবো বলে আশা রাখি।
হুমায়ুন মজুমদার
টরেন্টো, কানাডা
আপনাদের তোলা কিছু ছবি দিলে আরো ভালো লাগতো।