নরওয়ে থেকে:-
আমরা তিন বন্ধু , আমাদের ভাষা শিক্ষার ক্লাসের সবাই মোটামুটি উচ্চ শিক্ষিত ছিল বলে সারা স্কুলের মাঝে সাড়া জাগানো ক্লাস ছিল আমাদেরটা । আমাদের বেশিভাগ সহপাঠী স্কুলের শিক্ষকদের চেয়েও অনেক বেশি উচ্চ শিক্ষিত ছিল। আমি , ভিক্টর ও লিনা খুবই কাছের বন্ধু ছিলাম বলে এবং ক্লাসের ফাঁকে একসাথে কেন্টিনে খেতে যেতাম বলে ক্লাসের সবাই আমাদের নিয়ে প্রায় ঠাট্টা করতো। ইংল্যান্ড, আমেরিকা , জার্মানি, ফিলিপিন, থাইল্যান্ড, হল্যান্ড, উক্রেন , লিথুনিয়া, রাশিয়া , কাজাকিস্তান , ইন্ডিয়া , ব্রাজিল, চায়না, পোল্যান্ড , চিলি, বাংলাদেশ মিলিয়ে প্রায় ১৫ টা ন্যাশনালিটির ছেলে মেয়ে আমাদের ক্লাসে পড়তো। সবার একটাই উদ্দেশ্য ছিল ভালো করে রওয়েজিয়ান শিখে নরওয়েতে নিজেকে প্রতিষ্টিত করা। ভিক্টরের বাড়ি চিলির সান্টিয়াগো শহরে , লিনা ইন্ডিয়ার পুনে থেকে এবং আমি বাংলাদেশের সিলেটের ছেলে। ২০১১ সালে প্রতিদিন খুব সকালে উঠেই হিমশীতল ঠান্ডার মাঝে বরফ ঠেলে ঠেলে যখন নরওয়েজিয়ান স্কুলে ভাষা শিখতে যেতাম,, কেন জানি নিজের জীবনটাকে অভিশপ্ত মনে হতো। আমি বাংলাদেশী হওয়ায় ঠান্ডাটা মনে হয় বেশিই লাগতো। মাঝেমাঝে মনে হতো কেনইবা নিজেকে এমন কষ্ট দিচ্ছি ? এত তাড়াহুড়া করে নরওয়েজিয়ান শিখে কিইবা লাভের লাভ হবে ?? তবে ২০১৭ সালের এইদিনে দাঁড়িয়ে হলফ করে বলতে পারি , ২০১১ সালের ভাষা শিক্ষার যে কোর্সটা নিয়েছিলাম এবং সফলতার সাথে সবগুলো পরীক্ষা পাশ করেছিলাম তা এখন পর্যন্ত নরওয়েতে আমার ব্যক্তিগত অর্জনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো একটা অর্জন। ভালো করে নরওয়েজিয়ান বলতে, লিখতে ও পড়তে জানি বলে অনেক ক্ষেত্রে অন্যরা যেখানে কোনো কিছু করতে বা কোনো জায়গায় যেতে দ্বিধাবোধ করে আমি সে জিনিসটা নির্দ্ধিধায় করে ফেলতে পারি , সপ্রভিতো ভাবে ভাষা বলতে পারি বলে নরওয়েজিয়ান সমাজের যেকোনো কিছুতে খুব সহজেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি।
নিজের দেশ থেকে অন্য দেশে গিয়ে আনন্দের সাথে বসবাস করতে হলে সে দেশের ভাষা জানাটা খুবই জরুরি। আপনি যদি বিদেশে কোনো দেশ থাকেন এবং ওই দেশের ভাষা না জানেন তবে যত টাকা ইনকামই করুন না কেন সব সময় নিজেকে নিঃসঙ্গ বোধ করতে থাকবেন। বন্ধুহীন মানুষ টাকার বিছানায় ঘুমালেও শান্তিতে থাকতে পারেনা। আর নিজ দেশ ছেড়ে অন্য কোনো দেশে থাকলে এবং সেখানকার ভাষা যদি না জানেন তবে আপনাকে নিঃসঙ্গ অবস্থাতেই জীবন কাটাতে হবে।
আমরা যে উদ্দেশ নিয়ে ভাষা শিক্ষার ক্লাসে গিয়েছিলাম , এখন পর্যন্ত আমাদের মধ্যে ৯০% ই সে ব্যাপারে সফল। নরওয়েজিয়ান ভাষা শিক্ষাটা আমাদের সবাইকে সামনে এগিয়ে যাবার রাস্তাটা খুলে দিয়েছিলো। সবাই নিজেদের সুশিক্ষা, দক্ষতা ও অদম্য ইচ্ছা দিয়ে সামনে এগিয়ে গেছে। ৭ বৎসর আগে আমরা সবাই যে উদ্দেশ্যের পিছনে দৌড়িয়ে ছিলাম প্রায় সবাই তাতে সফল। ভিক্টরের বৌ দাঁতের ডাক্তার, নরওয়েতে আবার দাঁতের ডাক্তারদের খুবই ডিমান্ড। ভিক্টর ও তার বৌ মিলে নিজেদের ক্লিনিক ব্যবসা করেছে ,, লিনা আগে থেকেই সফল ছিল , বর্তমানে ইন্ডিয়াতে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান, খ্যাতিমান লেখিকা এবং ইন্ডিয়ার পুনেতে বিবিসি সংবাদের গেস্ট আলোচক। আমি এখনো প্রানপন চেষ্টা করছি পায়ের উপর দাঁড়ানোর। ক্লাসের যে ১০% এখনো সফল হতে পারেনি , আমিও তাদের মধ্যে একজন। আমার প্রতি ও বাংলাদেশের প্রতি লিনার খুব স্নেহ ও আগ্রহ ,, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় লিনার বাবা ইন্ডিয়ান আর্মির মেজর জেনারেল ছিলেন ,, উনি মুক্তিবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে দিনাজপুর , রংপুর অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। লিনা ওর বাবার কাছ থেকে বাংলাদেশের গল্প শুনতে শুনতে ছো টবেলা থেকেই বাংলাদেশের প্রতি খুবই আগ্রহী। সময় পেলেই বাংলাদেশ কেমন আছে ? আমার মা ,ভাই বোনেরা কেমন আছে তা জিজ্ঞেস করতো। লিনার স্বামী নরওয়েতে এক জাহাজ কোম্পানিতে চাকরি করেন, ওর মেয়ে ইন্ডিয়াতে পড়ালেখা শেষ করে এখন নরওয়েজিয়ান এক উনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করে। লিনা প্রতি ৬ মাস পর পর নরওয়েতে স্বামী ও মেয়েকে দেখতে আসে। নরওয়েতে আসলেই আমাকে দেখতে আসে ,, তখন আমি ভিক্টরকেও আসতে বলি। তিন বন্ধু মিলে আবার আগের মতো আড্ডা দেই.., নিজেদের বর্তমান সময়ের সব ভুলে গিয়ে আগের মতো আড্ডায় মেতে উঠি। স্বার্থপর এ পৃথিবিতে ভালো মানুষ, ভালো সঙ্গী আর ভালো বন্ধু মিলানো খুবই কঠিন। ভালো বন্ধু আর ভালো সঙ্গী ছাড়া সবকিছু কেমন জানি খালি খালি মনে হয় । তাই ভালো বন্ধুরা যেন পাশে থাকে এবং বেঁচে থাকে অনাদিকাল।