ফ্লোরিডা থেকে:-

১.
কলেজে অধ্যাপনার কাজটাই হল সমুদ্র মহাসমুদ্র তোলপাড় করে অমৃত খোঁজার মত, তুমি আসলেই জ্ঞানের গভীরের ডুবুরী।
এবং অবশ্যই তুমি সুন্দর ।
না হলে লিখতামইনা।

আমার কাজটা অন্যরকম : এই যেমন-
“এই রোগের কারণ কি ?”
“কারণ এখনও অজানা।”
“পরিনতি কি?”
“বলা মুশকিল,ভালোও হতে পারে , আবার খারাপও।”
“চিকিৎসা আছে?”
“নাই , একটা ঔষধ আছে কিন্তু অফিসিয়ালি এপ্রুভড নয় ।”
“আমি আমার বাচ্চাকে অষুধ দিতে চাইনা।”
“সরি মেম, তাহলে আমার কাছে কেন এসেছেন? আমি এলোপ্যাথিক ডাক্তার ,অষুধের প্রেশক্রিপশন লিখাই মূলত আমার কাজ।”
“মাল্টি ভাইটামিন খেলে চলবে না?
“চেষ্টা করে দেখতে পারেন, চলতেও পারে। “প্লাসিবো এফেক্ট ” বলে একটা কথা আছে, যা কাজ করার কথা নয় , তা যদি কাজ করে আমরা তাকেই প্লাসিবো এফেক্ট বলি।”

এই হল ডাক্তারী, জানার চেয়ে অজানাই বেশী।
ঔষধের চেয়ে কথা। মানুষকে চিকিৎসা করতে হয় কথা দিয়ে।
এজন্যই রুশ ভাষায় ডাক্তারকে বলে “ভ্রাচ্”
আর এই কথার উৎপত্তি যে প্রাচীন শ্লাভিয়ান শব্দ থেকে তার নাম “ভ্রাত্”, মানে কথা বলা। আগে ডাক্তাররা মানুষকে চিকিৎসা করতো কথা দিয়ে । এখন আমরা কথা বলিনা, মুখ গোমড়া করে ঔষধের প্রেসক্রিপশন লিখি। ডাক্তররা রোগীর সাথে হাসলে গাম্ভীর্য্য কমে যায়, আর গাম্ভীর্য্য কমলে ঔষধ কাজ করেনা।
আমি প্রাচীনপন্থী এবং আমার আধুনিক ডাক্তারীতে মাথা ব্যথা হয়। আমি বলি, চিকিৎসা করতে হয় কথা দিয়ে, কারণ আদতে ছিল কথা। (যদিও ফাউস্ট বলে আদিতে ছিল কাজ)। বাইবেল এবং ফাউস্টের সিন্থেসিস করে প্রথমে রোগীকে রোগটা সম্পর্কে বুঝিয়ে ( কথা বলে ) ঔষধের প্রেসক্রিপশন লিখলে (কাজ) আমি দেখেছি ফলাফলটা ভালো হয়। অবশ্য এটা আমার দেখা।
আমার দেখা তোমার দেখার সাথে এক হবে এমন কোন কথা নেই। তবে হলে আমার মনে হয়, আমাদের গ্রহটির জন্য ভালো হতো।
২.
তুমি ডক্টর ,আমি ডাক্তার।
তুমি বলছো “আগে তোমার বুকে আমার স্থান ছিল, এখন যেন সিমেন্ট দিয়ে বেঁধে দিয়েছ। একটু ও ভালোবাসা আর বাকি নেই।”
আমি অজস্র বুকের ভেতরটা উন্মুক্ত হতে দেখেছি ডাক্তারী পড়তে যেয়ে। হৃৎপিন্ড, ফুসফুস, এওরটা, ইসোফেগাস, ট্র্যাকিয়া , ব্রন্কাই , এই তো বুকের ভেতর, আর কিছু তো দেখি নাই।
সব না হলেও ,তুমি অন্তত আমার এ কথাটা বিশ্বাস করতে পারো ।
সার্জারির বাইরে চোখ দিয়ে বুকের ভেতরটা দেখা যায়না। আমি যেমন পারিনা তোমার ভেতরটা দেখতে, তুমিও পারোনা আমার অন্ত:স্থলে দৃষ্টি বুলাতে।
আমাদের মুখে ভাষা আছে বলেই অনেক কথা বলি, বুকের কথাটা একটু বেশীই বলি। মানুষ হবার এ একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
বিড়াল কোন কথাই বলে না , সরাসরি চোখের দিকে তাকায় ,আর ম্যাও ম্যাও করে । সে কি বলছে অর্থটা আমাদের খুঁজে নিতে হয়।
ডাক্তারীতে বিজ্ঞানের চেয়েও আর্ট বেশী ,ঠিক ওই বিড়ালের চোখের মতই । নিজে নিজেই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হয়। বিড়াল কিছু চায়না কিন্তু রোগীরা খুব বেশী চায়। এজন্যই তারা রোগী, তা নইলে তাদেরকে পোষা বিড়াল বলা যেত।
ভাগ্যিস, তোমার পড়ুয়ারা বিড়ালের মত নয়।
৩.
লতা পাতা ফুলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কচি কুমড়োর মত দিনটি, ভালোবাসার দিন ১৪ ফেব্রুয়ারী । অথচ আমরা কাঁদছি ২৫ শে আগষ্ট থেকে শুরু করে। তাও সেই অনন্ত কাল যেখানে শুরু হয়েছে, সেখান থেকে।
যদিও দিন ক্ষণ পাঁজি পন্জিকা দেখে বিয়ে হত আদি কালে, ভালোবাসা সবসময়ই আসতো জোয়ারের মত । আর কুটার মত ভাসিয়ে নিয়ে যেতে।

তোমার মনে আছে যে আমাদের চোখের সামনে দিয়েই একজন ভেসে গিয়েছিল পদ্মা -শীতলক্ষ্যা হয়ে বঙ্গোপসাগরে , তারপরে নেভা -ভোলগা হয়ে লরেন্স- হাডসন- মিসিসিপির দিকে ? আর যে ছিল ডাঙায় সে হাত বাড়াবে কি বাড়াবেনা তা ভাবতে ভাবতেই সময় কাটিয়ে দিল । যে ভেসে গেল ,সে গেলই দৃষ্টির আড়ালে । আর সম্বিত হলো যখন , ডাঙার সেই নারী কাঁদে , আর কাঁদে, কেঁদে ভাসিয়ে দেয়, যে ভেসে গেছে তার জন্য।
তুমি আর আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ভাবি , ছিল বটে প্রেম, আহা! অথচ বর্তমানে কত উপায় আছে সেই সব ভুল শুধরে নেয়ার।
ম্যামথ ম্যামথই, কেঁদে কেঁদে বিলুপ্ত হয়ে যাবে তবু …..

তোমার মনে আছে তোমাকে আমি এপোলো আর ডাফনের গল্প বলেছিলাম ? যখন প্রেমিক এপোলো তার পেছনে ছুটেছিল, ডাফনে ভয়ে একটা লরেল গাছে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।
কেমন অবাস্তব তাইনা?

যে গল্পটা তোমাকে বলি নাই তা হল সিরিঙ্গা এবং প্যানের গল্প।
প্যান ছিল গবাদী পশু এবং তাদের ম্যানেজার রাখালদের রক্ষ- দেবতা।
দেখতে সে ছিল মানুষের মত কিন্তু তার মাথায় ছিল দুটো ছাগুলে শিং , মুখে দাড়ি , আর পা দুটোও সেই প্রানীটির মতই । এমন দেহ সৌষ্ঠব নিয়ে দেবতা যে , সে মাথা ঘুরিয়ে প্রেমে পড়ে গেল সিরিন্ঙ্গার । কিন্তু সিরিঙ্গা এত সুন্দর , তার কি এমন এক বিদঘুটে দেবতাকে ভালো লাগার কথা?
সিরিঙ্গা তাকে বললো,”আপনার কষ্ট করে বোর্ডে ফার্ষ্ট হবার দরকার নেই, আমি ভালোবাসার কোন প্রতিশ্রুতি দিতে পারবো না।”
প্যান খুব বিচলিত মনে বনে বনে ঘুরে বেড়াতে লাগল। কোথায় তার পশু পালন , কোথায় তার রাখালদের ভরণ পোষন বা বোর্ডে ফার্ষ্ট হবার পড়াশুনো ?
তার মন কাঁদে সিরিঙ্গার জন্য।
একদিন সে বনে সিরিঙ্গাকে দেখতে পায়, যেন কোন কানা ভোলার মায়াবী আকর্ষনে এগিয়ে যায় তার দিকে। সিরিঙ্গার চুলে বাংলার গ্রামের সোনালী লতার মত সোনার ঝিলি মিলি ,সেই চুল গুলো একটু শুঁকে দেখতে ইচ্ছে হয় । সিরিঙ্গার চোখে পদ্মা তীরের উদার মাদকতা , একটু সেই চোখের আলো নিয়ে আলোকিত হতে ইচ্ছে হয় । সিরিঙ্গার বুকে বাংলাদেশের বেলফুলের ঘ্রান, একটু সেই ঘ্রান নিতে ইচ্ছে হয়।

কিন্তু সিরিঙ্গা ডাফনের মতই ভয় পেয়ে ছুটতে থাকে।
প্যান আর কি করে , সে ও ছোটে তার পিছে পিছে।
এটা পুরুষের একটা রিফ্লেক্স , নারী দৌড়ালে পুরুষ তার পিছে না ছুটে পারেনা।
অথচ থেমে গেলেই হয়, বললেই হয় থাক্ আমার ভালোবাসার বেদনায় আমি তোমাকে জড়াবোনা, কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি।
সিরিঙ্গা ছোটে, ছোটে আর ছোটে , আর তার পিছে প্যান, পদ্মায় গুণ টানা নৌকার মত । সিরিঙ্গা বুঝতেই পারেনা যে ভালোবাসার এক অদৃশ্য গুণে সে-ই প্যানকে টেনে নিয়ে চলেছে পিছু পিছু । কিন্ত সে যাবে কই? তার রাস্তা রোধ করে শুয়ে আছে রোদ পোহানো পাইথনের মত খরস্রোতা নদী। সে সিংহের মত গর্জায় ।
এই বুঝি প্যান ধরে ফেলে তাকে। সে নদীর দেবতাকে সাহায্যের জন্য ডাকে।
সব দেবতা নদীর দেবতার মত এত করিতকর্মা হলে বাংলাদেশের সমস্যা গুলো কত আগে সমাধান হয়ে যেত ।
প্যান সিরিঙ্গাকে দু হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করতে যায়, কিন্তু হায়! তার উষ্ণ আলিঙ্গনে সিরিঙ্গা নয় , কতগুলো নরম ও খস খসে নল খাগড়া । প্যানের বুক ভেঙ্গে যায় বেদনায়, নলখাগড়ার দোলার শব্দে সে যেন শুনতে পায় সিরিঙ্গার মাদকি কন্ঠস্বর । যেন বর্ষার বালিগাঁওয়ের জলে ডোবা বিস্তীর্ণ মাঠের ধন্চে পাতার ফিসফিস , কি যেন সে বলতে চায়, কি যেন কিন্তু প্যান শাহাবের মত নির্বোধ বুঝতেই পারেনা…..।সে তখন কয়েকটি নলখাগড়া কেটে বাঁশী বানায় এবং ভালোবেসে সেই বাঁশীর নাম দেয় সিরিঙ্গা।
সেই থেকে নির্জন বনে, পাহাড়ে বা নদী তীরে প্যান বসে বসে বাঁশী বাজায় আর অশ্রু ফেলে এবং আর তার মিষ্টি সুরের বাঁশীর শব্দ নৈশব্দের বুক চিরে অনুরণিত হয়।
৪.
আসলে ২৫ আগস্ট একটা অতি পুরানো ও ধুসর দিন। ১৪ ই ফেব্রয়ারীর রংটা রামধনুর রংয়ের মত সুন্দর। দিনটাও যৌবনবতী , তার বয়েস বাড়েনা, চামড়ায় জমেনা বলি রেখার কুন্চন । ভালোবাসার অনবদ্য অভিকর্ষনের ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ডে তোমাকে ভীষন লাগে এই দিনে।
ঐসব এপোলো- ডাফনে, প্যান- সিরিঙ্গা, শাহাব – নদীদের গল্প গুলো হল অবাস্তব আষাঢ়ে গল্প। তোমার গল্পই সর্বাধুনিক ও সুন্দর।
কাক ডাকে কা কা করে, করুক। ওই ডাকে যদি শূন্যতা থাকে, থাকুক; বিরক্ত লাগার চেয়ে যদি কস্ট বেশী হতে চায়,তাকে প্রশ্রয় দিওনা।
আমার এখানে ঘুঘু ডাকে অষ্টপ্রহর ,আমি কানে আঙুল দিয়ে রাখি। ঘুঘুর ডাকের বিরহের প্রতিধ্বনী শুনতে আমার ভালো লাগেনা।

তুমি বুঝে উঠতে পারোনি, আমার বুকে পাথর নয় , মেরু প্রদেশের বরফের মহাসাগর, যেখানে বিশাল বিশাল বরফের চাঙর ভেসে বেড়ায় । আমি বহু কষ্টে তাপমাত্রা হিমান্কের নীচে রাখি , উষ্ণতা বেড়ে গেল বরফ গলে মহা প্লাবন হয়ে যাবে।
মহাপ্লাবন মানেই , কষ্ট ভীষন কষ্ট!

মনে আছে ,হেরোড কন্যা সালোমে খুব সুন্দর নাচতো ? কিন্তু সেই নাচের পরিনতি যদি হয় একজন মানুষের ছিন্ন মস্তক ,যত সুন্দরই হোক , তুমি কি মানবে যে সেই নাচ না নাচাই ভালো ?

শাহাব আহমেদ

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন