প্রিয় পাঠক,
এবারের রমজান মাস পালিত হচ্ছে একটি বিশেষ ক্রান্তি লগ্নে যেখানে বাংলাদেশ সহ সারা দুনিয়া হিমশিম খাচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের সুখ/দুঃখ হাসি কান্নায় কথা নিয়ে এবারের লেখাটিতে দেশের কিছুটা সমসাময়িক ঘটনা প্রবাহের ছটা নিয়ে আবারো হাজির হলাম আমার তিন কান্না লেখাটি নিয়ে। তিন কান্না নাম শুনে আবার ভেবে বসবেন না যেন বানান ভুল করে তিন কন্যা লিখতে যেয়ে তিন কান্না লিখেছি । নামের সার্থকতা বুঝতেহলে একেবারে শেষ পর্যন্ত পড়তে হবে । আমাদের যাদের শেকড় মধ্যবিত্ত পরিবারে, লেখাটি পরে ভালো লাগতেও পারে। কথা না বাড়িয়ে চলুন শোনা যাক মধ্যবিত্তের একটুকরো সুখ/দুঃখের গল্প কথা …

——————–
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীনউদ্দিন.
রেজিস্টার্ড সোস্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার, টরেন্টো, কানাডা
—–
তিন কান্না

আজিজুর রহমান সাহেব বাজারের একপাশে একটি বন্ধ দোকানের খুপরিতে থাকা টুলের উপর বসে উদাস ভাবে তাকিয়ে থেকে মানুষ জনের ব্যাস্ত মুখর বাজার করা দেখছেন। ছোট ছেলে মন্টু বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। অবশেষে নিরাবতা ভঙ্গ করে মন্টু বাবাকে বললো:
– আব্বা , চলেন বাসায় যাই , চিন্তা করে আর কি হবে। আজিজুর রহমান ছেলের কথা ঠিক শুনতে পারলেন বলে মনে হলো না, তবে উনার চোখের কোন বেয়ে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মন্টু বাবার কান্না দেখে কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বাবার হাত ভয়ে ভয়ে আস্তে করে স্পর্শ করলো। অগত্যা, আজিজুর রহমান খালি বাজারের ব্যাগ নিয়ে ছেলেকে নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরলেন।

এই কিছুক্ষন আগেও আজিজুর রহমান মন্টুকে নিয়ে কাঁচা বাজারে তরিতরকারি দরদাম করে মাংস দোকানে যেয়ে আড়াই কেজি গরুর গোস্তের অর্ডার দিয়েছিলেন । মন্টু সবেমাত্র ব্যাগ এর মধ্যে মাংস ভরেছে। আজিজুর রহমান টাকা দিতে যেয়ে দেখে পাঞ্জাবির পকেট কাটা । মানিব্যাগ নেই । অর্থাৎ মানি ব্যাগ চুরি হয়েছে । আজিজুর রহমান সাহেবের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। বাজারের প্লানটা ছিল কাঁচা বাজারে তরিতরকারি কিনে বড় দোকান থেকে রোজার বাজার অর্থ্যাৎ বুট, ময়দা, ব্যাসন, চিনি, চা পাতা, সয়াবিন তেল চিকন সিমাই ইত্যাদি কেনার পরে মাংসের দোকানে যেয়ে মাংস কিনে বাজার শেষ করবে । কিন্তু সকাল সকাল ভালো মাংস পাওয়া যাবে বলে আজিজুর রেহমান প্ল্যান একটু চেঞ্জ করেছিলেন। তাই, কাঁচা বাজার পাশ কাটিয়ে সরাসরি মাংসের দোকানে গিয়েছিলেন। তেষট্টি বছর জীবনে এরকম কেলেঙ্কারিরির মধ্যে আজিজুর রহমান সাহেব আগে কখনোও পড়েছেন বলে মনে হয় না।

বাড়িতে মেঝো মেয়ে রেবেকা, জামাই সহ প্রায় মাসখানিক হলো লোক ডাউনের কারণে আটকে পরে আছে। একটি মাঝারি ধরণের গার্মেন্টস ফ্যাক্টারীর হিসাব রক্ষক আজিজুর রহমান, ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকায় এপ্রিল মাসের বেতন পান নি। জমানো টাকা থেকে স্ত্রী অর্থ্যাৎ মোমেনা বেগম অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে কোনোরকমে টেনে টুনে সংসার চালাচ্ছেন। হাত একেবারে খালি। তাই, গতকাল রাতে রান্না ঘড়ে একটি বিশেষ জরুরী সভা ডাকা হলো। সভায় মেঝো মেয়ে রেবেকা, ও তার জামাই ছাড়া সবাই অর্থাৎ আজিজুর রহমান, মোমেনা বেগম, বড় মেয়ে আসমা, বড় ছেলে ইমরান, মেঝো ছেলে ইসতিয়াক, উপস্থিত ছিল। মন্টু ও শেফালী জুনিয়র গ্রূপে পরে বিধায় ওদেরকে সভায় রাখা হবে কি হবে না চিন্তা করেও একেবারে শেষ মুহূর্তে ওদের দুজনকে আজিজুর রহমান সাহেবের নির্দেশে সভায় রাখা হলো। সভার শুরুতে আজিজুর রহমান সাহেব সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের কারণে তার সংসারের অস্থায়ী আর্থিক অনটনের কথা জানালেন। ইমরান জানালেন তার পুরাতন ফার্নিচারের কেনা বেচার ব্যবসা সবেমাত্র জমে উঠেছিল। মার্চ মাসের শুরুতে হাতের সব জমানো টাকা দিয়ে পুরাণ ফার্নিচার কিনে দোকান ঘড় ভর্তি করেছিল, ঠিক এই সময় কোরোনার কারণে দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তবিল শুন্য । বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইসতিয়াক লেখা পড়ার পাশা পাশি টিউশনি চালাতো। মাস গেলে টিউশনির পুরো টাকা মায়ের হাতে তুলে দিতো। সভায় ইসতিয়াক জানালো, করোনা ভাইরাসের কারণে টিউশনি বন্ধ হয়ে মাস খানিক ধরে ঘড়েই বসে আছে। সভা চলার মাঝা মাঝি সময়ে মন্টু ও শেফালী কানে কানে কথাবলে দুজনে ঘর থেকে বেরিয়ে যেয়ে পর মূর্তেই দুইজন দ্রুত দুইটি মাটির ব্যাঙ্ক নিয়ে উৎসাহের সাথে বাবার হাতে দিয়ে বললো:

‘বাবা, এ দুটি ভাঙ্গলে অন্তত হাযার খানিক টাকা হবে।’
এ পর্যায়ে মা মোমেনা বেগম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললেন। বড় মেয়ে আসমা, মা কে সামলিয়ে বাবার হাত থেকে মাটির ব্যাঙ্ক দুটি নিয়ে মন্টু ও শেফালিকে ফেরত দিয়ে বললো:
– ‘এগুলো আর ভাঙ্গতে হবে না। আমার কাছে এযাবৎকালের সব বৃত্তির টাকা সেভিংস একাউন্টে রাখা আছে । কম করে হলেও সেটা হাজার সাতেক তো হবেই।’

আসমাকে এ বাড়ির সবাই কিছুটা ভয় পায়। বিশেষ করে, আসমাকে বিয়ের জন্য দেখতে এসে পাত্র পক্ষ যখন ছোটবোন রেবেকাকে পছন্দ করে বিয়ে করলো তখন থেকেই এ বাড়ির সবাই কিছুটা প্রায়শ্চিত্তে ও কিছুটা ভয়ে আসমাকে এড়িয়ে চলে। আসমা বাংলায় এম এ পাশ করে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়ায়। এ বাড়িতে দরকারি সিদ্ধান্ত সমূহ আসমার সাথে আলোচনা করেই সাধারণত নেয়া হয়ে থাকে । তাই, গত রাতে আসমার কথাকেই মেনে নিয়ে সভা শেষ করা হলো। আজ সকালে, আসমার ব্যাংকে যেয়ে সাত হাজার ছয়শত টাকা তুলে বাবার হাতে তুলে দিলেন । ভাগ্য ভালো যে পুরা টাকা আজিজুর রহমান বাজারে নিয়ে যায় নি। আসমার টাকার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা নিয়ে মন্টুকে সাথে করে আজিজুর রহমান সাহেব আজ রমজান মাসের বাজার করতে বাজারে এসেছিলেন।

রিকশায় আজিজুর রহমান ও মন্টু চুপ চাপ বাড়ির দিকে এগুতে থাকে। বাড়িতে কিভাবে মুখ দেখবেন মনে মনে ভাবতে যেয়ে আজিজুর রহমান সাহেবের মন বেশ খারাপ হয়ে যায়।

– ‘আব্বা, আপনার মন কি খুব বেশি খারাপ?’
আজিজুর রহমান মন্টুর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে পাল্টা মন্টুকে প্রশ্ন করে
-‘ হ্যা রে মন্টু, তুইতো সারাক্ষন বই পত্তর পড়িস, শুনেছি রোজার মধ্যে শয়তানকে বন্দি করে রাখা হয়, তাহলে রমজান মাসেও শয়তানের কার্যক্রম চলে কিভাবে? তোর কি মনে হয়?’

এস এস সি তে গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া মন্টু একেবারে বড় মানুষের মতো লেকচার দেয়ার ভঙ্গিতে উত্তর দেয়:
-;আব্বা এটা বুঝতে হলে পদার্থ বিদ্যা আগে বুঝতে হবে। নিউটনের প্রথম সূত্রে গতি জড়তার কথা উল্লেখ আছে । খুব সাধারণ করে যদি বলি, ট্রেন থামার পরেও আমরা সামনের দিকে ঝুকে পড়ি , এর কারণ হচ্ছে , ট্রেন চলাকালিন সময় ট্রেনের সাথে আমরাও গতিশীল ছিলাম, কিন্তু সমস্যা হলো ট্রেনটি যখন হটাৎ করে থেমে যায় , তখন আমাদের শরীরের নিচের দিকের অংশ যেমন পা, যা ট্রেনের সাথে সংযুক্ত থেকে ট্রেনের সাথে সাথে সচল ছিল, তা চট করে ট্রেনের সাথে সাথে থেমে যায় কিন্তু শরীরের উপরের দিকের অংশ তখনও কিচুটা সচল থাকায় আমরা ট্রেন বন্ধের সাথে সাথে সামনের দিককে কিছুটা ঝুকে পরি।’

– ‘বুঝলাম তার সাথে রমজানের বা শয়তানের সম্পর্কটা বুঝলামনা বাবা!’
মন্টু কিছুটা হেসে বললো :
-‘আব্বা, এটাতো পানির মতো পরিষ্কার, যে আমরা বারো মাসের মধ্যে এগারো মাসেই প্রতিমুহূর্তে শয়তানের দ্বারা তাড়িত হই, এখন হঠাৎকরে সেই ট্রেনের মতো যদি শয়তান তার সমস্ত শয়তানি হুট্ করে থেমে দেয়, তাহলে আমরা বাকি এক মাস অর্থ্যাৎ রমজান মাসে দিব্বি শয়তানের প্রচনা ছাড়াই খারাপ কাজ করতে থাকি আব্বা, এতো, আমার কথা না আব্বা, এ হচ্ছে বিজ্ঞানের কথা।’

রিকশা বাড়ির পথে প্রায় মাঝা মাঝি চলে এসেছে। আজ ভোরের দিকে কিছুটা ঝড় বৃষ্টি হওয়ায় গরমের তীব্রতা কিছুটা কমেছে। বাবা ও ছেলের জ্ঞানের কথা/বার্তা চলতে থাকে। এক পর্যায়ে আজিজুর রহমান কিছুটা দীর্ঘ নিশ্বাসঃ ফেলে বলেন, আচ্ছা মন্টু, বুঝলাম তোর জ্ঞানের কথা , এসব বাদ দে, একটু ভালো কোনো খবর বল দেখি যাতে শুনে মনটা একটু ভালো হয়ে যায়। মন্টু তড়িৎ জবাব দেয়:
‘আব্বা, আমি আপনাকে তিনটি খুব ভালো খবর বলতে পারি। প্রথমটি হচ্ছে শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতি উপজেলার ভিক্ষুক নাজিমুদ্দিনের কথা যিনি এক সময়ে কৃষি কাজ করলেও দুর্ঘটনায় পা ভেঙ্গে যাওয়ার পর কাজ করতে না পারায় এখন ভিক্ষা করা শুরু করেন এবং ভিক্ষা করে জমানো ১০ হাজার টাকা যা ঘড় ঠিক করবেন বলে ঠিক করেছিলেন তা করোনা ভাইরাসের ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে দান করেছেন’।

-‘বলিস কি রে মন্টু, এই না খবরে প্রত্যেকদিন শুনি চেয়ারমেন/মেম্বারদের ত্রান চুরির কথা। এই, ভিক্ষুককেতো উপজেলার চেয়ারম্যান বানিয়ে দেয়া উচিত। কি বলিস?’
-‘আব্বা, এসব হচ্ছে কথার কথা, আপনি ভালো করেই জানেন, ভোটের সময় এই জাতীয় মানুষ স্বতন্ত্র হয়ে ভোটে দাঁড়ালে পাগল বলে আমরা ভোট নষ্ট হওয়ার কথা ভেবে কিন্তু ওই চোর চেয়ারমেনদেরই ভোট দেই, তাই না আব্বা ?’
– ‘আচ্ছা, দ্বিতীয় ভালো খবর বল।’
– ‘দ্বিতীয়টি হচ্ছে, এবার বোরো মৌসুমে জানেনতো আব্বা ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তো এদিকে ব্যাচারা কৃষকরেতো লোকের অভাবে পাকা ধান না কাটতে পারার জন্য খুব বিপদে ছিলেন, এই অবস্থায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় কৃষকদের সাথে একজোট হয়ে স্কুল /কলেজের ছাত্র, পুলিশ বাহিনী এমনকি রাজনৈতিক কর্মীরাও মাঠে যেয়ে ধান কেটে দিচ্ছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এ এক নজিরবিহীন ঘটনা আব্বা ।’

ছেলের মুখে দেশের এসব ভালো খবর শুনে আজিজুর রহমান মন আসলেই বেশ ভালো হতে থাকে।

-‘খুবই ভালো খবর, এবার তিন নম্বর খবরটা বল দেখি।’

তিন নম্বর খবরটাও খুব ভালো খবর , তবে একটু বিতর্কিত।
– বিতর্কিত কেন, একটু খুলে বল দেখি ?’
মন্টু বিজ্ঞ লোকের মতো বলতে থাকে,
‘দেশীয় প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ কেন্দ্রে ড. বিজন কুমার শীলের নেতৃত্বে এক দল বিজ্ঞানী অত্যন্ত স্বল্প খরচে মাত্র ১৫ মিনিটে করোনা ভাইরাস সনাক্তক্ষম কিট আবিষ্কার করেছেন।’
কৌতূহল হয়ে আজিজুর রহমান সাহেব মন্টুকে বলে
-‘তো এর মধ্যে বিতর্কের কি দেখলি বাবা ?’
-‘আব্বা, এটি এখনো সরকারি অনুমোদন পাই নি।’
মন্টু হয়তো আরো কিছু বলার চেষ্টা করতো কিন্তু রিকশা বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছে। মন্টু রিকশা ভাড়া মিটিয়ে খালি বাজারের ব্যাগটি পিছনের দিকে একটু আড়াল করে ধরে বাবাকে নিয়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলো ।
বাড়িতে পা দিতেই বেশ হৈচৈ এর শব্দ শোনা যাচ্ছে। আজিজুর রহমান ও মন্টু একটু এগুতেই দেখে বাড়ির উঠানে বিশেষ জটলা। ছোট মেয়ে শেফালী বাবাকে দেখে দৌড়ে বাবার কাছে এসে জানালো,
-‘ আব্বা ! দুলাভাই বাজার থেকে আমার সমান এক চিতল মাছ কিনে এনেছে , সঙ্গে করে মাছ কাটার জন্য একটি লোককেও নিয়ে এসেছে’, শুধু তাই না আব্বা, দুলাভাই খাবার জন্য একটি বিরাট বড় রাজ-হাঁসও কিনে এনেছেন ।

আজিজুর রহমান ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা হকচকিয়ে যান। উঠানের মাঝ খানে মোমেনা বেগম চেয়ারে বসে থেকে নির্দেশনা দিচ্ছেন, আর একটি লোক ধারালো বটি দিয়ে ফালি ফালি করে প্রকান্ড চিতল মাছ কাটছেন । লোকটির মাথায় একটি লাল রঙ্গের গামছা বাঁধা। মাছ কাটতে যেয়ে টাটকা মাছের তাজা রক্তে হাত লাল হয়ে উঠেছে ।একেকটি মাছের চাকা কাটা হচ্ছে আর রেবেকার জামাই খুব ব্যাস্ততার সাথে লোকটির হাত থেকে কাটা মাছের টুকরোগুলি পাটির উপর বিছিয়ে রাখা খবরের কাগজ এর উপর রাখছে। ইমরান আর ইসতিয়াক সেখান থেকে আবার মহা উৎসাহে ছোট ছোট পোটলা করে মাছের টুকরাগুলিকে ছোট ছোট পলিথিন বাগে ভরাচ্ছে। আসমা ও রেবেকা পাখা হাতে মা কে বাতাস দিচ্ছে ।একটি মস্ত বড় সাদা ধব ধোবে রাজ-হাঁস কে উঠানের ডান দিকে পেয়ারা গাছের গোড়ায় বেঁধে রাখা হয়েছে। ব্যাচারা হাঁস টি হয়তো ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছে তার পরিণতির কথা, কমলা রঙ্গের ঠোঁট বেকিয়ে কদাচিৎ গাই গুই করে যেন হাঁস টি পৃথিবীতে আরোও কয়দিন বেঁচে থাকার আকুতি জানান দিচ্ছে।


মন্টুকে দেখে জামাই মশাই উত্তেজিত ভাবে চেঁচিয়ে বললেন :

মন্টু, হা করে দাঁড়িয়ে থেকো না, একটু ঘাসের ব্যাবস্থা করো, রাজ হাঁস হচ্ছে তৃণ ভুজি , এরা ঘাস /আগাছা এসব খেয়ে বেড়ায়। দুই এক দিন ঘাস খেয়ে মোটা তাজা হোক , তারপরে শুক্রবারে ওর জবাই হবে।’

আজিজুর রহমান সাহেবের ধারণা, তার বাজার না করার ব্যাপারটি বোধ হয় ধামাচাপা পরে গেলো । বলতে না বলতেই মেঝো মেয়ে রেবেকা তড়িৎ বেগে বাবার কাছে এসে বললো:
-‘বাবা, আমার সাথে একটু ঘরে চলতো তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।’
-তোর মুখটা কেন জানি শুখনা দেখাচ্ছে রে মা, কিছু হয়েছে ?’
– ‘বাবা. চলো ঘড়ে যেয়ে বলছি’ ।
আজিজুর রহমান অনেক দুঃচিন্তা নিয়ে মেয়ের পিছন পিছন হেটে মেয়ের ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।

আকাশে আবারো কিছুটা কালো মেঘ করেছে। এরই মধ্যে জামাই মন্টুকে নিয়ে আবার কাছে কোনো দোকানের দিকে যাচ্ছে জিরা মসলা আনার জন্য। আজ ইফতারির পরে রাতের খাবারের জন্য টাটকা চিতল মাছের ঝোলের রান্নার পর্ব চলছে । জামাই নিজে রান্নার তদারকি করতে যেয়ে দেখে বাসায় জিরা নাই। এদিকে মাছের ঝোলের উপর একটু ভাজা জিরার গুঁড়া না দিলেই না । বাটা মসলার দিয়ে ভালো করে কোসে নিয়ে মাছের টুকরা গুলি ইতিমধ্যে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বাতাসে মাছের তরকারির সুঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে । ঝোলের তরকারি ছাড়াও চিতল মাছের পেটির দিককার কয়েকটি টুকরা মসলা দিয়ে মেখে আধা ভাজা করে রেখে দেওয়া হয়েছে , খাবারের আগে আবার খানিকটা ভেজে পরিবেশন করা হবে । শেষ রাতের সেহেরীর জন্য মেনু ঠিক করা হয়েছে মুগের ডাল দিয়ে চিতল মাছ আর টমেটো দিয়ে বেগুন ভর্তা। তারাবির নামাজের পরে আজিজুর রহমান সাহেবের কিছুটা মিষ্টি জাতীয় খাবারের শখ। মোমেনা বেগম পায়েস রাধার জন্য আতপ চাল বের করে রেখেছেন। জামাই এর এর বিশাল বাজারের প্রভাবে আইজুজুর রহমান সাহেবের বাড়িতে একটি আলগা উৎসব উৎসব ভাব বিরাজ করছে । কে বলবে এ বাড়িতে গতকাল রাতে অর্থিক অনটন বিষয়ক সভা হয়ে ছিল এবং আজ সকালে আজিজুর রেহমান সাহেবের পাঞ্জাবির পকেট কেটে সাড়ে তিন হাজার টাকা সহ মানি ব্যাগ চুরি হয়েছে।

কিছুটা বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মন্টু দোকানে যাওয়ার আগেই বুদ্ধি করে রাজ্-হাঁসটিকে রান্না ঘরের পাশেই টিনের শেডে খুঁটির সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে রেখেছিলো। তারপরও ব্যাচেরা ওখান থেকেই সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত পশু পাখিদের এক ধরণের বাড়তি ইন্দ্রিয় থাকে যা থেকে আগে থেকে কিছু পূর্বাভাস পেয়ে থেকে। কি বিচিত্র এ জগৎ, যে প্রাণীটি জানে দুই একদিনের মধ্যে তাকে জবাই করে মাংস খাওয়া হবে সেই প্রাণীটি মানুষদেরকে চেঁচিয়ে ঝড়ের পূর্বাবাস জানান দিচ্ছে। হয়তো তা নাও হতে পারে, হয়তোবা, ঝড়ে ভয় পায়ে সে চেচাচ্ছে। বলতে না বলতেই প্রচন্ড জোরে মুষুলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এদিকে, জামাই আর মন্টু কাক ভেজা হয়ে জিরা মসলা নিয়ে দোকান থেকে বাসায় ফিরলো। ইমরান ও ইসতিয়াক সামনের দিকের ঘড়ে রমজান মাসের অলস দুপুরে বসে বসে কেরামবোর্ড খেলছে । বৃষ্টির বেগ বেড়েই চলেছে। পাশের ঘড়ে রেবেকা বাবার সাথে নিচু গলায় কিছুটা অভিজোগের সুরে বললো:

-‘আব্বা, বিয়ে হয়ে গেছে বলে আমি কি পর হয়ে গেছি ? বাড়িতে এত অভাব অনটন যাচ্ছে আপনেরা আমাকে কিছুই জানানোর প্রয়োজন মনে করেন নি ?
কথা বলতে বলতে রেবেকা ডুকরে কেঁদে উঠে বিলাপের সুরে বলতে থাকে:
“আব্বা, শুনলাম বুবু তার বৃত্তির জমানো সব টাকা তুলে আপনাকে দিয়েছে বাজার করতে, মন্টু ও শেফালী নাকি ওদের মাটির ব্যাঙ্ক ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করছে আর এতসব হচ্ছে আমি কিছুই জানলাম না আব্বা!’
বাবাকে কোনোরকম কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রেবেকা বিলাপ করতেই থাকে,
‘তোমাদের জামাই কি এটি খারাপ , আব্বা, ওকে কি আপনেরা নিজের ছেলে হিসাবে নিতে পারলেন না ?’

এরই মধ্যে আসমা রেবেকার ঘড়ে ঢুকে পরে । বাবার দিকে চেয়ে আসমা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে:
-‘আব্বা আপনে আর মন্টু দেখলাম বাজার না করে খালি ব্যাগ নিয়ে বাজার থেকে ফিরলেন?কোনো সমস্যা হয়েছে আব্বা ?’

বৃষ্টিতে সাথে দমকা বাতাস শুরু হয়েছে । বাতাসে ইলেকট্রিক তারের সাথে তার ঘষা লেগে কাছে কোথাও বিকট শব্দে ট্রান্সফরমার বোধহয় জ্বলে গিয়ে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলো। মুষলধারে বৃষ্টি পরেই চলেছে। আজিজুর রহমান সবিস্তারে দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে মেয়েদেরকে সকাল বেলার মানিব্যাগ চুরির কাহিনী বলা শুরু করলেন । একপর্যায়ে, আজিজুর রহমান কথা বলতে যেয়ে বাচ্চা ছেলের মতো কেঁদে ফেললেন

,-‘মা রে, তোর জমানো বৃত্তির টাকা যে এভাবে নষ্ট করলাম! একটা গয়না টয়নাও কিনতে পারতি, বিয়ের সময় কাজে দিতো!

বাবার সাথে সাথে একসময় আসমাও কেঁদে ফেললো । রেবেকা আগে থেকেই বাবার সাথে কথা বলতে যেয়ে কাঁদছিলো । অবশেষে, এক ঝড়ের বিকেলে ইলেক্ট্রিসিটি বিহীন একটি অন্ধকার ঘড়ে তিনটি মানুষ নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে । কান্নার দমকে একেকজনের শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে , অথচ কেউ কাউকে অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছে না । একেক জনের কান্নার কারণ একেক রকমের । রেবেকা কাঁদছে অভিমানে, আসমা কাঁদছে বাবাকে কাঁদতে দেখে আর আজিজুর রহমান কাঁদছে প্রায়শ্চিত্তে। তিন কান্নার ধরণ ও কারণ ভিন্ন হলেও একটি জায়গায় অভিন্ন, তিন কান্নায় উৎসারিত হয়েছে তিনটি প্রাণীর একেবারে গভীর অন্তরের অনেক দিনের লুকানো ক্ষত থেকে । বারান্দার টিনের চালের বৃষ্টির শব্দে এই তিন কান্নার আওয়াজ বাড়ির সকলের কাছে অজ্ঞাতই থেকে গেলো ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযখন পীরের মুরিদ ছিলাম – পর্ব ২
পরবর্তী নিবন্ধসাদা ঘোড়া – ২য় পর্ব
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন