এক ধরণের শূন্যতা সর্বদাই ঘিরে থাকে আমাদের। আর অবচেতন মনেই এখানকার সব কিছুকে বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করে চলি।
এখন আমাদের এখানে ফল বা শরৎশুরু হয়েছে। এখনো বাগানে গাছ-পালা আছে , পাতা কেবল রঙ্গীন হতে শুরু করেছে। শীতপ্রধান দেশ কানাডাতে চার মাসের মতো গরম থাকে। এই সময়টা আমরা দারুন ভাবে উপভোগ করি। স্কুল-কলেজেও থাকে সামারের বন্ধ। বিভিন্ন ধরণের আউটডোর প্রোগ্রাম চলতেই থাকে। পিকনিক,মেলা, বিভিন্ন দেশের কালচারাল প্রোগ্রাম, ফেস্টিভ্যাল লেগেই থাকে। কানাডা মাল্টিকালচারাল দেশ- হেনো কোনো দেশ নেই যে দেশের মানুষ এখানে নেই। সামারে কানাডা এক বর্ণিল সাজে সেজে ওঠে। সামারে আমাদের অনেকটা সময় কাটে আমাদের বাড়ির বাগানে। বাংলাদেশে থাকতে আমরা সবাই বাগানী না হলেও এখানে কিন্তু আমরা সবাই কম বেশি বাগানী। ফুলে ফুলে ভোরে যায় আমাদের বাড়ির সামনে পিছনে। শাক-সবজি তরি-তরকারিতে ভরে ওঠে আমাদের ব্যাকয়ার্ড। বাগান করতে যেয়েও আমরা ভুলি না দেশের শাক-সবজি আর ফুল ফলের কথা। তাই এখানেও আমরা লাগাই দেশি ফুল গাঁদা, গন্ধরাজ, বেলি, রক্ত করবি, হাসনা হেনা , কলা ফুল, নয়ন চারা। আর সবজি বাগানে থাকে দেশী পুঁই শাক, পাট শাক, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, ধুন্দল, দেশী সিম। বরফের দেশ কানাডায় কিন্তু গাছপালা লাগিয়ে বাঁচিয়ে রাখা বাংলাদেশের মতো এতো সহজ নয়। এখানকার মাটি বা আবহাওয়া কোনোটাই কিন্তু বাংলাদেশের মতো ভালো নয়। তাই অনেক পরিশ্রম, সময় দিয়েই এদেশে বাগানে ফুল ফোটাতে হয়। আর বাংলাদেশের মতো নামমাত্র মূল্যে এদেশে সাহায্যকারী পাওয়াও দুস্কর। তাই এখানে শত ব্যাস্ততার মধ্যেও আমাদের নিজেদের বাগান নিজেদেরই করতে হয়। সামারের শুরুতেই আমরা বাংলাদেশী গ্রোসারি স্টোর থেকে বীজ আর চারা সংগ্রহ করা শুরু করি।কেউ কেউ আবার বাংলাদেশ থেকেও বীজ আনেন। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আপু তাঁর একটা লেখায় লিখেছিলেন-স্যুটকেসে ইমিগ্রেশনকে লুকিয়ে হাস্নাহেনা আর গন্ধরাজ ফুলের চারা এনেছিলেন আর সেইসব গাছে ফুল ফুটেছে: বুঝতেই পারছেন কতটা আবেগ, ভালোবাসা আর মায়ায় ঘেরা তাঁর লেখা। আসলে আমরা কানাডায় থাকলেও দেশকে, দেশের ফুল, পাখি, লতাপাতা আমরা সব সময়ই মনে করি। পুরো সামার জুড়ে চলে লাউ আর বিভিন্ন দেশী শাক-সবজি ফুল ফলের আদান প্রদান, চড়ুইভাতি চলতে থাকে উইকেন্ড গুলোতে। মনেই হয়না আমরা টরোন্টোতে আছি। বরং এখানকার ব্যাকয়ার্ডএ বসে মনে হয় আমরা সুদূর বাংলাদেশের কোনো ছায়া সুনিবিড় গ্রামেই আছি। বিভিন্ন ধরনের পাখিরা বাসা বাঁধে পুরো বাড়ির আর বাগানের চারিদিকে, পাখিরা ডিম্ পাড়ে, বাচ্চাও হয়। খরগোশ, কাঠবিড়ালি, রাকুন, কোনো কোনো বাড়িতে হরিণও আসে। সামারে এখানকার ট্রেইল বা হাঁটার পথ ধরে আমরা চলে যাই লেকের পাড়ে, পার্কে তো যাইই। লেকের পাড়ে চলতে থাকে বারবিকিউ পার্টি।সামারে বাইকিংও করে অনেকেই। আলবার্টা, ব্রিটিশ কলাম্বিয়াতে সন্ধ্যার পরে বেশ সাবধানেই হাঁটাচলা করতে হয়; ওখানে অনেক ভল্লুক থাকে, মাঝে মাঝে গাড়ির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমাদের টরেন্টোতে ভল্লুক নেই তবে বুনো শেয়াল বা কায়টি দেখা যায় ।
পেটিওতে বসে একা একা চা খাচ্ছিলাম আজ। রবিন পাখির বাচ্চাগুলো যখন ডাকছিলো মনে পড়ছিলো আমার শৈশবের ফেলে আসা স্মৃতি। আব্বা তখন সাতক্ষীরাতে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন আর আম্মা ছিলেন টাউন গার্লস হাই স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। আমাদের অফিসের বাড়িটা ছিল অনেক জায়গার উপর,বিশাল একটা পুকুর ছিল। আম, জাম, জামরুল, খেজুর, তাল, কদবেল, বেল,কাঁঠাল এইসব নানারকম গাছপালা দিয়ে ভর্তি ছিল বাড়িটি। বাড়ির চারিদিক ঘিরে ছিল দেবদারু গাছের সারি- অদ্ভুত এক প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘিরে ছিল পুরোনো জমিদারদের এই বাড়িটি। পুকুর ভর্তি ছিল তেলাপিয়া মাছ – ছোট্ট আমি ভাবতাম ওগুলো সব কৈ মাছ। আমাদের রান্না করার খালা ময়না তাঁর মেয়েদের নিয়ে গামছা দিয়ে ছেঁকে ছেঁকে তেলাপিয়া মাছ ধরতো , আব্বার অর্ডারলী পিয়ন শহিদুল ভাই জাল দিয়েও মাছ ধরতো।
মাঝে মাঝে আসল জেলেরা এসে বড়ো বড়ো জাল দিয়ে রুই, কাতলা, তেলাপিয়া সহ অনেক বড়ো বড়ো মাছ ধরতো। ওই বাড়িতে আমার আম্মার গরু, ছাগল হাঁস, মুরগি, রাজ্ হাঁস, চীনা হাঁস, তিতি মুরগি, কবুতর সবই ছিল।কানাডার ফার্ম হাউসগুলোতে যখন যাই, আমাদের সাতক্ষীরার ওই বাড়িটার কথা, ওই সব আপন লোকগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। আমাদের ওই বাড়িতে অনেক কুল, বরই, খেজুর, জামরুল, কদবেল, নারকেল, কাঁঠাল, আম, জাম, একটা মেহেদী গাছও ছিল। শহীদুল্লা ভাই, জয়নাল ভাই আর মাঝে মাঝে সশ্রম কারাদণ্ড পাওয়া কয়েদীরাও আমাদের বাগান করতে সাহায্য করত। কাঁদি কাঁদি খেজুর, তাল, আম, কাঁঠালে ভর্তি থাকতো আমাদের বাড়ি আর উঠান, বিশেষ করে জ্যৈষ্ঠ মাসে। শাহানার মা খালা, আম্বিয়া খালা, ময়না খালা আমাদের হাঁস, মুরগি গরু ছাগলের যত্ন নেয়ার কাজে আমার আম্মাকে অনেক সাহায্য করতো। আমাদের গরুর দুধও হতো। আব্বার অফিসের আর্দালী পিয়ন শহীদুল্লা ভাই আর জয়নাল ভাই বড় জালায় করে গুড় বানাত। নারকেল শুকিয়ে তেল বানানো হতো, পাকা তাল থেকে আম্বিয়া খালা বের করে তালের পিঠা বানাতো। আমরা তালের শাঁসও খেতাম – শহীদুল্লাহ ভাই তাল কেটে শাঁস উঠিয়ে দিতো, পাকা তালের আঁটি থেকে পরে আবার আর এক ধরণের শাঁস খেতাম নারকেলের ফোপোলার মতো।
একদিন খুব ভোরে আমাদের একটা বড়ো বেগুন গাছের পাতায় ছোট্ট দুটো তুলো ফুগদি পাখির বাচ্চা দেখলাম। কদিন পরেই বাচ্চা দুটো মায়ের সঙ্গে উড়ে গেলো।
আরো এক দিনের কথা মনে পড়ছে। আমাদের একটা পাতি হাঁস সন্ধ্যায় পুকুর থেকে আর ঘরে আসতো না। সকালে আবার বাড়িতে এসে কুঁড়া, গম, শামুক খেয়ে পুকুরে চলে যেত। একদিন সন্ধ্যায় আম্মা স্কুল থেকে ফেরার পর আমি আর আম্মা হাঁসটার পিছু নিলাম। দেখলাম ঝোপের মধ্যে অনেকগুলো ডিম নিয়ে তা দেয়। এরপর থেকে আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় ঝোপের মধ্যে ওই ডিমগুলো দেখতে যেতাম। দিনে দিনে ওই ডিমগুলো থেকে সাতটা হাঁসের বাচ্চা বেরোলো। আমি আম্মাকে ওই ঝোপে নিয়ে দেখিয়ে দিলাম- আম্মা আর আমি খুব খুশি হয়ে বাসার সবাইকে ডেকে নিয়ে গেলাম। এসব স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম-কলিং বেলের শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেলাম, দৌড়ে সামনে চলে আসলাম।
ধন্যবাদ সবাইকে।