বাংলাদেশ ছেড়ে কানাডা আসার আগে একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেছি নয় বছর। ‘সেক্টর হেড’ হিসেবে Social Development & Economic Justice সেক্টরের অধীনে মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবা, মানসম্মত মৌলিক শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক সুবিচারের তিনটি আলাদা আলাদা বিভাগের কর্মসূচি পরিচালনায় নেতৃত্ব দেয়াই ছিল আমার কাজ। আমি খুব সৌভাগ্যবান ছিলাম এইজন্য যে এই তিনটি খাতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তানভীর মুন্তাসিম, সর্দার আরিফউদ্দিন এবং মৌসুমী মহাপাত্রের মতো আমার প্রিয় তিনজন অসাধারণ মেধাবী সহকর্মী পেয়েছিলাম। তাদের সাথে আরো ছিলেন মজিবুর রহমান, ফারুক, আজিজ ভাই, জিনাত এবং ফরহাত আপা, রায়ান সহ অনেকেই। কলেবরে বিশাল না হলেও কর্মকান্ড পরিচানায় নূতনত্ব এবং পেশাগত দক্ষতায় আমার টিমের প্রত্যেকেই ছিলেন অসাধারণ। স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক সুবিচার আলাদা বিষয় হলেও আমাদের লক্ষ্য ছিল এই তিনটি ক্ষেত্রেই ‘Responsive Governance’ বা সুশাসনকে “Crosscutting Theme” হিসেবে প্রতিষ্টিত করা। এ সময় সুশাসনের সনাতনী, প্রথাগত কার্যক্রমের গন্ডি থেকে বের হয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক কিছু উন্নয়ন সংগঠনের যৌথ প্রচেষ্টায় সচেতন নাগরিক সমাজ, নাগরিক সেবার মান উন্নয়ন বিষয়ক রিপোর্ট কার্ড এবং সংসদ সদস্যদের নিয়ে ‘Parliamentary Caucus on Education’ এর মতো কিছু নুতন কার্যক্রমের সূচনা হয়। একই সময় আমরা জনকল্যানমুখী শাসন প্রক্রিয়ার কিছু কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতানির্ভর উদাহরণ সংগ্রহেরও প্রয়াস নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য যে দু একটি ব্যাতিক্রম ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি, ভালো উদ্যোগ খুব বেশি একটা খুঁজে পাইনি। সুশাসনের অন্নেষণ ছেড়ে কানাডায় এসে স্থায়ী হয়েছি প্রায় বারো বছর আগে। আনন্দের বিষয় হচ্ছে যে এখানে সুশাসন হারিকেন দিয়ে খুঁজে বেড়াতে হয়না। ধর্ম, বর্ণ, পেশা নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ এখানে নিজের অজান্তেই এই সুবিধাটুকু ভোগ করে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ। এই লেখা এরখম একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরারই প্রয়াস।
আমাদের ছেলে রাইফের বয়স তখন দেড় দুই বছর। আমি গাড়ি চালাচ্ছি। আমার স্ত্রীকে ‘United Way’ এর এক মিটিংয়ের জন্য নর্থ ইয়র্কের এক অফিসের ড্রাইভ ওয়েতে নামিয়ে দিয়ে ফিরে আসবো। পেছনের কার সিটে রাইফ বসা। গাড়ি ঘুরিয়ে ড্রাইভওয়ে পার হয়ে একটু সামনে আসতে না আসতেই রাইফের চিৎকার এবং গুঙ্গানিতে ভয় পেয়ে গাড়ি থামিয়ে দ্রুত পিছনের সিটে এসে দেখি বিস্কুট খেতে গিয়ে কোনো কারণে বিস্কুটের একটি টুকরো সে গিলতেও পারছে না আবার ফেলতেও পারছে না। অনেক কষ্টে সেটি বের করে এনে রাইফকে শান্ত করে এসে ড্রাইভিং সিটে বসতে না বসতেই দেখি পার্কিং এনফোর্সমেন্ট পুলিশ এসে হাজির। ফায়ার এক্সিট রুটে গাড়ি রাখার জন্য আড়াইশো ডলারের ফাইন। অনেক চেষ্টা করেও আমার জরুরি পরিস্তিতি তাকে বুঝাতে পারলাম না। নির্বিকারভাবে হলুদ কাগজের একটি টিকেট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো যে চাইলে আমি এই টিকিটকে কোর্টে চ্যালেঞ্জ করতে পারি। স্ত্রীর পরামর্শে সিদ্ধান্ত নিলাম কোর্টে এই আদেশ চ্যালেঞ্জ করবো। পরিচিত অনেকে পরামর্শ দিলেন এই জাতীয় বিষয়ে অভিজ্ঞ কারো সহায়তা নেবার। একসময়ে কোর্টে ডাক পড়লো। নিজের সমস্যা নিজেই ডিফেন্ড করবো, এই অভিপ্রায়ে কোনো কৌশুলীর সাহায্য ছাড়াই হাজির হলাম বিজ্ঞ বিচারকের সামনে। অবাক হয়ে দেখি সেই পার্কিং এনফোর্সমেন্ট অফিসার ও এসে হাজির। বিজ্ঞ বিচারক যখন জানতে চাইলেন ফায়ার রুটে গাড়ি পার্কিঙের পটভূমি কি, তখন সবিস্তারে ব্যাখ্যা করলাম সেই সময়কার পরিস্তিতি। হয়তোবা পরিস্থিতিগত নিরুপায়তাকে সঠিক, যৌক্তিক এবং দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছিলাম। মিনিট খানেকের পিনপতন নিস্তব্দতা, বিচারক এবং কোর্ট রিপোর্ট/রেকর্ড কিপারের অতি সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষে বিজ্ঞ বিচারক যা বললেন তা আজো ভুলিনি, “You did exactly what you were supposed to do at that moment. The very purpose of the rule of law is to keep people protected and saved, not to ignore them when their lives are at risk. This case is withdrawn. Mr Hasan, forget the fine. You are free to go.”। আমার চোঁখ দুটি ততক্ষনে ঝাপসা হয়ে আসছে। না, আড়াইশো ডলার সাশ্রয়ের আনন্দে নয়, সুশাসনের প্রথম অভিজ্ঞতা অর্জনের কৃতজ্ঞতায়। জীবনে এই প্রথম সত্যিকারভাবে উপলব্দি করলাম মানুষের জন্যই আইন, আইনের জন্য মানুষ নয়।
সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে