বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশে উল্লেখ্যগ কিছু পরিবর্তন দেখা দিতে থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশে তখনও হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়নি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখনও নোবেল প্রাইজ পাননি। বিশ্বব্যাপী প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের দামামা তখনও বেজে ওঠেনি । এরকম এক সময়ে বাংলায় বাঙালিরা যে এক বৃহৎ শক্তি এটি বুঝতে পেয়ে ভাইসরয় লর্ড কার্জন সাহেবকে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে দেখা যায়। তিনি ‘বঙ্গভঙ্গ ‘ নামে বাঙালিদের মধ্যে বিভক্তির দেয়াল তুলতে ব্যস্ত। এই যখন অবস্থা তখন পূর্ব বাংলার বগুড়া জেলা শহর থেকে প্রায় ৫/৬ মাইল দক্ষিণ পূর্ব দিকে বর্তমানের শাজাহানপুর উপজেলার মাদলা ইউনিয়নের ‘ঢাকন্তা’ নামক গ্রামের এক কোনায় একটি আনন্দদায়ক ঘটনা ঘটলো। দরিদ্র কৃষক ঈমান উদ্দিনের পরিবারে একটি শিশুর জন্ম হলো । এরকম হরহামেশাই এই পৃথিবীতে প্রতি সেকেন্ডে লক্ষাধিক শিশুর জন্ম হয়। তা নিয়ে গল্প লেখার কিছু নেই । তবে, এই শিশুটি বেশ আলাদা । পরবর্তীতে এই শিশুটি প্রচন্ড মেধার স্বাক্ষর রেখে ধীরে ধীরে বিকশিত হতে থাকেন, লোকচক্ষুর অন্তরালে । ক্ষণজন্মা অত্যান্ত মেধাবী এই ব্যাক্তি-টি আমার বাবা, মোঃ নাজির উদ্দিন বি এস সি কেমিস্ট।
সাধারণতঃ বগুড়া নামের সাথে যেসব ঐতিহাসিক ব্যাক্তিত্বের নাম চলে আসে তাঁরা হচ্ছেন : বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, সাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শিক্ষাবিদ সাদত আলী আখন্দ, কবি আজিজুল হক, রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান, ভাষা সৈনিক গাজীউল হক প্রমুখ বিখ্যাত ব্যাক্তির নাম। এই লিষ্টে আমার নিরীহ বাবা মোঃ নাজির উদ্দিন বি এস সি কেমিস্ট সাহেবের নাম নিতান্তই থাকার কথা না। তবে বগুড়ার মাদলা ইউনিয়নের ঢাকন্তাবাসীরা, শহরের রহমান নগরের কিছু এলাকাবাসীরা এবং সেই সঙ্গে গুটিকয়েক প্রবীণ ব্যাক্তিবর্গ ওনার নাম দীর্ঘদিন মনে রেখেছেন। এনাদের মধ্যে অনেকেই গত হয়েছেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় বগুড়া সরকারি সরকারি আজিজুল হক কলেজের প্রবীণ শিক্ষক আব্দুল খালেক স্যার, মারফত আলী স্যার, জলেস্বরী তলার ডাঃ ইয়াসিন, ডাঃ মোজাফ্ফর, পিটি আই মোড়ের ডাঃ হায়দার এই কেমিস্ট সাহেবের নাম দীর্ঘদিন মনে রেখেছিলেন। কারণ, এনারা একই সঙ্গে ধর্ম ও আধুনিক শিক্ষায় দীক্ষিত এই মানুষটিকে অনেক কাছ থেকে দেখেছিলেন।
আমার বাবাকে নিয়ে অনেক বড়ো একটি উপন্যাস লেখার আমার দীর্ঘ বছরের স্বপ্ন। আমার ইচ্ছা আমার আজকের এই লেখাটিকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে ১০/১২ ফর্মার একটি উপন্যাস হিসাবে দাঁড় করানো। দেখা যাক কতদূর কি করতে পারি। আমার মেধাবী বাবার নামের শেষের এই বি এস সি কেমিস্ট এর পেছনে রয়েছে বিরাট ইতিহাস, বিরাট রহস্য। আমি সেই রহস্য উম্মোচন পর্বটি মূল উপন্যাসের জন্য রেখে দিয়ে এই বাবা দিবস প্রাক্কালে ওনাকে নিয়ে গুটিকয়েক কিছু কথা লিখতে বসেছি :
জীবনের প্রথম ভাগে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি তৎকালীন আধুনিক শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে মাদ্রাসা শিক্ষাকে ইস্তফা দিয়ে নিজ উদ্যোগে তিনি সেই ঢাকন্তা গ্রাম থেকে ৫/৬ মাইল পায়ে হেঁটে বগুড়া সেন্ট্রাল হাই স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। অখণ্ড ভারতীয় উপমহাদেশে ৫ম শ্রেণীতে বৃত্তি, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উর্তীণ হয়ে ফিজিক্স, ম্যাথমেটিক্স, বায়োলজি সাবসিডিয়ারি রেখে কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে জগন্নাথ হলে তিনি থাকতেন। সম্ভবত উনি ঢাকা ইউনিভার্সিটির প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। ইংরেজিতে বিশেষ দখলের কারণে সে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শেক্সপিয়ারের নাটকের ইংরেজি সংলাপে ওনার ডাক পড়তো। পরবর্তীতে, আমাদের ছেলেবেলায় আমরা দশ ভাই-বোন ওনার কাছ থেকে সেসব সংলাপ শুনতাম, জ্ঞানের কথা শুনতাম, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম।
কেমিস্ট্রির সম্পূর্ণ Periodic table ওনার মুখস্থ ছিল। মেন্ডেলের প্রথম ও সেকেন্ড সূত্র সহ বিজ্ঞানের বিভিন্ন সূত্র, ফিটকিরি, পিকরিক এসিড ইত্যাদি কেমিস্ট্রির জটিল জটিল সব যৌগের রাসায়নিক সংকেত, উনি যে কোনো সময় চট করে বলে দিতে পারতেন। ইংরেজি, বাংলা, উর্দু, ফার্সি প্রভৃতি ভাষায ওনার সমান দখল ছিল। ছোটবেলায় দেখেছি প্রতিবেশী এক বিদূষী মহিলা আব্বার কাছে ফার্সি ভাষা শিখছেন। অনর্গল ইংরেজিতে বিদেশিদের এক্সেন্টে উনি কথা বলতে পারতেন। ডিকশনারিতে থেকে এমন কোনো শব্দ নেই উনি মানে জানতেন না। ওনার পড়াশুনা শেখানোর কৌশল ছিল অদ্ভুত। মুখে মুখে জটিল জটিল সব অংক বুঝিয়ে দিতেন। আবার আমরা যাতে মনে রাখতে পারি সে জন্যে সুকৌশলে ছন্দের আশ্রয় নিতেন। আমার এখনো মনে আছে উনি আমাকে ছন্দের মাধ্যমে শিখিয়ে ছিলেন ” As well as first, not only but also last. ” অর্থাৎ কোনো বাক্যে একাধিক সাবজেক্ট থাকলে এবং সেখানে যদি As well as থাকে তবে সেই বাক্যের প্রথম সাবজেক্ট অনুযায়ী verb বসবে। যেমন: He as well as his brothers goes to school. কিন্তু, বাক্যে যদি Not only but also থাকে তবে শেষের সাবজেক্ট অনুযায়ী verb বসবে। যেমন: Not only he, but also his brothers go to school.
আমাদের পরিবারে বাবা মা -কে যথাক্রমে আব্বা আম্মা সম্বোধনে ডাকার বিধান ছিল। ক্লাস নাইনের আগে পর্যন্ত আমার এডুকেশন এর পুরোটাই আব্বার সহচর্যে ছিল। এরপরে ক্লাস নাইন থেকে আমি প্রাইভেট টিউটরের শরন্নাপন্ন হলেও আব্বার সাথে আলজেব্রা, পাটিগণিত, ফিজিক্স , কেমিস্ট্রির নানান বিষয় নিয়ে আলাপ করতাম, নিউটনের সূত্র, আর্কিমিডিসের সূত্র ইত্যাদি নিয়ে আলাপ করতাম, আইন ষ্টাইনের সেই বিখ্যাত E = mc2 এর সাথে আমাদের রসূল (সা:) এর শবে মেরাজের কাহিনীকে মেলানোর চেষ্টা করতাম ।
আব্বা সকালে উঠে ফজর নামাজ পড়ে আমাদেরকে বাইরে মর্নিং ওয়াক করতে বাধ্য করতেন, মাথার নিচে থেকে বালিশ কেড়ে নিতেন। স্বাস্থ্য সচেতন এই মানুষটি সবসময় স্বাস্থ্য রক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতেন, মাইলের পর মাইল হাঁটতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন,’ একবার নবী মুসা (আঃ) আল্লাহকে বলেছিলেন , হে আল্লাহ, ধরো তুমি মুসা, আমি আল্লাহ, বলো, তুমি আমার কাছে কি চাও ? মহান আল্লাহ তখন তিন বার বলেছিলেন, ‘স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্য। খাবার সময় আব্বা প্রায়ই বলতেন, Chew as many times as you have teeth কারণ বেশিক্ষন চিবালে খাবারগুলি স্যালাইভার সাথে ভালোভাবে মিশ্রিত হওয়ার সুযোগ পাবে।
আমার সেই আব্বাকে নিয়ে ‘মোঃ নাজির উদ্দিন বি এস সি কেমিস্ট’ উপন্যাসে অনেক অনেক তথ্য, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করবো। আশাকরি আপনাদের ভালো লাগবে ।
“হে আল্লাহ আমার আব্বা আম্মাসহ আমাদের সবার যাদের বাবা মা’ রা গত হয়েছেন সবার বিদেহী আত্মার প্রতি রহমত বর্ষণ করো, ওনাদেরকে বেহেস্তবাসী করো। আর যাদের বাবা-মা বেঁচে আছেন তাঁদের সন্তানরা যেন নিছক লোক দেখানো খোঁজখবর না করে আক্ষরিক অর্থে বাবা মায়ের সুখে দুঃখে পাশে থাকেন সেই তৌফিক দান করো।”
জগতের ৩৬৫ দিনই বাবা দিবস হোক !! মা দিবস হোক !!আমিন।”