আমি টরন্টো ডাউন টাউনে একটি চার তাঁরা হোটোলে কাজ করি। প্রায় নয় বছর আমি এই হোটেলে কাজ করছি। এখানে ম্যানেজমেন্ট খুব ভালো। তাই কাজের পরিবেশও সন্তোষজনক। সব ডিপার্টমেন্টের কর্মচারীদের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো। আমি এখন ফুড এন্ড বেভারেজ বিভাগে কাজ করি। সপ্তাহে দুই দিন ডে শিফট ও তিন দিন নাইট শিফট।
আমার সহকর্মী এক বন্ধুর নাম রিনালদো। তার বাড়ি ব্রাজিল। সাও পাওলোর ‘পোয়া’এলাকায় তার পৈতৃক বাড়ি। এছাড়া সাও পাওলো ডাউন টাউনের বিচ এলাকায় একটা ছোট এপার্টমেন্টও আছে…সে বছরের ৭/৮ মাস কানাডা ও বাকি সময় ব্রাজিল থাকে।
রিনালদো কে নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে। তার বয়স ৫৫ বছর। সে এখন ও অবিবাহিত। কেউ কেউ বলে সে নাকি একজন আন্য প্রকৃতির লোক…..তবে সে যাই হোক না কেন আমার দৃষ্টিতে সে একজন নির্লোভ ,আবেগপ্রবণ ও সৎ লোক বলে আমি মনে করি। তার সম্পর্কে আমার ধারণা আমার অন্য সহকর্মীর থেকে ভিন্ন। তার সম্পর্কে যতটুকু আমার জানা তাতে আমার মনে হয়েছে সে নিতান্তই একজন ভালো মানুষ।
কানাডায় আসার আগেই সে একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করত। তার বাবা মা গত হয়েছেন অনেক আগেই। তবে কিভাবে বা কি কারণে সে ব্রাজিলে শিক্ষক তা ছেড়ে কানাডায় এসে এই চাকুরী করে তা আমি এখনও জানি না। ব্রাজিলে তার বাড়ি ও অন্যানো সম্পত্তি দেখা শুনা করে একজন উকিল। তার ভাল মানসিকতার সুযোগ নিয়ে এই উকিলও নাকি তাকে পদে পদে ঠকায়।
রোনাল্দো একজন সৎ মানুষ। সে জীবনে কাউকে ঠকায়নি বলে সে দাবি করে। তার কথার স্বপক্ষে আমি এখানেও অনেক প্রমান পেয়েছি। সে যে বছরের সময়টা ব্রাজিল কাটায় টরোন্টোতে সে সময়ের পুরা বাড়িভাড়া সে আগাম দিয়ে দেয়। গত দশ বছরেও এর কোনো বাতিকক্রম হয়নি। সে এখানে একা থাকে,তার টরোন্টো বাসার কাছে যে রেস্টুরেন্টে সে নিয়মিত খেতে যায় সেখানেও সে আগাম বেশ কিছু ডলার ডিপোজিট করে রেখেছে।
রিনালদো একজন আবেগপ্রবণ বা মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ। আমি বেশ কয়েকবার তার মধ্যে এসব গুণাবলী লক্ষ্য করেছি। একদিন কাজে আসার পরে আমি দেখলাম তার চোখ মুখ বেশ একটু ঢুলু ঢুলু এবং সে খুব চুপচাপ। এক সময় আমি জিজ্ঞাসা করলাম,” কি খবর রিনালদো ,তুমি অসুস্থ নাকি ?” সে না ও হা পরে বলে কিছুক্ষন পরে বললো , গতরাতে তার ঘুম হয় নাই। আমি বললাম,বিশেষ কোনো খারাপ খবর ? নাকি কোনো শারীরিক অসুস্থাতা ? তখন সে বললো , “আমি গতকাল সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফেরার পথে আমার বাসার কাছে এক বৃদ্ধা মহিলাকে দেখলাম হুইল চেয়ারে করে রাস্তা পার হচ্ছে। রাস্তার মাঝখানে তার হুইল চেয়ারের চাকা হটাৎ লক হয়ে গেলে সে ঐ চাকা রিলিজ করতে বেশ অসুবিধায় পড়েছিল। ইতোমধ্যে সিগন্যাল লাইট গ্রীন থেকে রেড হলো। আমি রাস্তা পার হয়ে চলে এসেছি। ঐ মহিলা অনেক কষ্টে তার হুইল চেয়ারের চাকা আনলোক করে রাস্তা পার হয়েছিল। বাসায় এসে আমার মন আমাকে বার বার ধিক্কার দিলো ,কেন আমি ঐ বৃদ্ধাকে রাস্তা পারাপারে সাহায্য করলাম না! এ জন্য সারারাত আমি মানসিক যন্ত্রনায় কাটিয়েছি। যে কারণে আমি ঘুমাতে পারি নাই। “
আমাদের একজন ম্যানেজার গত কয়েক মাস আগে ফ্রেইড এলিভেটর দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এ খবর টরোন্টোর সব টিভি চ্যানেল ও প্রচার মাধ্যমে বেশ ফলাও করে প্রচার হয়েছিল। তিনি একজন মুসলিম ছিলেন। তাকে ইয়র্ক সিমেট্রি তে দাফন করা হয়। আমি এ সময় দেখেছি রিনালদো কিভাবে কাঁন্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল। তার কাঁন্না আমি ছাড়াও আরো অনেকের হৃদয় স্পর্শ করেছিল।
রিনালদো সম্পর্কে আর একটি বিষয় উল্লেখ করলে তার চরিত্র আরও পরিষ্কার বোঝা যাবে। সে প্রতিবারই ব্রাজিল যাবার সময় কাউকে না কাউকে তার সাথে নিয়ে যায় ব্রাজিল বেড়ানোর জন্য। গত দশ বছর এখানে কাজ করছে সে। তার কারণে আমার কর্মস্থলের ২৫ জন সহকর্মী এ পর্যন্ত ব্রাজিল ভ্রমণ করার সুযোগ পেয়েছে। এ বছর আমাদের ডিপার্টমেন্টের ৪ জন ও ১ জন কিচেন স্টাফ কে সে ব্রাজিল নিয়ে যাচ্ছে। এদের যাতায়াত প্লেনের ভাড়া ও সাও পাওলোতে তার বাসায় থাকার যাবতীয় খরচ সে বহন করবে। তবে ব্রাজিলের অভ্যান্তরে অন্য শহর বা যে কোনো টুরিস্ট আকর্ষণীয় এলাকায় যাতায়াত খরচ সকলে মিলে বহন করবে। রিনালদোর এ কাজে প্রতি বছর তার কানাডিয়ান ডলার প্রায় দশ হাজার পর্যন্ত ব্যায় হয়।
আমার কর্মস্থলের সবাই রিনালদোর এ উদ্যোগ কে ‘রিনালদো চ্যারিটি’ বলে। সে এটা শুনলে ভীষণ ভাবে লজ্জায় সংকুচিত হয়ে পরে। এ বছর আমাদের ডিপার্টমেন্টের ৪ জনের মধ্যে আমি ব্রাজিল যাচ্ছি। আগামী মার্চের ৮ তারিখ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত আমরা ব্রাজিল থাকবো। সাও পাওলো সহ রিও ডি জেনেরিও ,ব্রাজিলিয়া ,ফ্লোরিয়ানাপোলিস ,ইগুয়াজু ফলস ( ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়ে ল্যান্ড বর্ডার) ও ব্রাজিলের আরো কিছু বিখ্যাত শহর আমরা সফর করবো বলে পরিকল্পনা করেছি।
রিনালদোর এ উদ্যোগকে আমার অনেকটা পাগলামি মনে হয়। আসলে এ দেশের সাদাদের মতো মানসিকতা এখনো গড়ে উঠে নাই বলেই আমার কাছে তার এ কর্মকান্ডকে পাগলামি মনে হয়। সাদারা তো এখানে কোনো কিছু ফ্রি পেলে খুশিতে একেবারে গদ গদ। আমি একবার জিজ্ঞসা করেছি ,”তুমি প্রতি বছর এভাবে নিজের টাকা খরচ করে কেন এতো লোকজন নিয়ে যাও ব্রাজিল? তোমার কি লাভ হয় এতে ?” সে মৃদু হেসে বলেছে , ” এসব কর্মকান্ডের কোনো সুনিদৃষ্ট কারণ নেই।,কেউ আমার কিছু অর্থে ও পরিশ্রমে যদি একটু আনন্দ পায় তবে নিশ্চয়ই ‘গড’ আমার উপর খুশি হবেন!!” তার কথা শুনে আমি তো একেবারে ‘থ’ !! বলে কি লোকটা ?
যাইহোক , রিনালদো সম্পর্কে আলোচনা আর দীর্ঘায়িত করতে চাই না। পৃথিবীতে তো কত প্রকৃতির মানুষই সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেছেন। কেউ কেউ কে তিনি বিশেষ কিছু গুণাবলী দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যা দেখে অন্যরা অনুপ্রাণিত হতে পারে। রিনালদো ও ব্রাজিল সম্পর্কে আরো কিছু লিখতে পারবো ব্রাজিল থেকে ঘুরে আসার পরে। ততদিন অপেক্ষা করতে সকল কে অনুরোধ করছি।