ফ্লোরিডা থেকে:-
আমি অসুস্থ তবে অসুখটা কি তা আমি জানিনা। শুধু জানি আমি সুস্থ নই । স্বপ্নভঙ্গতা কোন রোগ নয় কিন্ত সেই স্বপ্নভঙ্গতায় নিয়ত বাস করাটা রোগ,দুর্বিসহ রোগ।
আমি দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম এবং পৃথিবীর বহুদেশ দেখা সত্ত্বেও ,বহু সাফল্যের নাক ছুঁই ছুঁই করেও আমার মগজে এক অতলান্ত সমুদ্র গর্জন করে । আমি শূন্যতা ও সমুদ্র ঝড়ে লড়ে লড়ে ক্যাকটাসের বিছানায় পড়ে থাকি। আমার কান্নায় চোখ ফুলে ওঠে । একদিন “জননী জন্মভূমি স্বর্গদপী গরিয়সী !” মন্ত্রটি দ্রুত ধাবমান শুটিং স্টারের মত আমাকে অস্থির করে দেয়। আমি সেই অস্থিরতা ও শূন্যতাকে বুক পকেটে পুরে প্লেনে চেপে বসি জন্মভূমিকে দেখার জন্য।
একদিন আমি জন্মভূমির সর্বদক্ষিনে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যুক্তিবাদী মিসির আলীর কারিগরের “সমুদ্র বিলাসের” পাশে বসে বালু, পাথর, নারিকেল গাছ , হেতাল ও দিকচক্রবাল ছোয়া জল আর জলের দিকে তাকিয়ে মগজের নিজস্ব সমুদ্রে অবগাহন করছিলাম। এই সমুদ্রের দৃশ্যমান তল থেকে নেমে যাচ্ছিলাম গভীর থেকে গভীরতায়, অবচেতনের হাঙর তিমি বেলুগার সন্তরন সাম্রাজ্যে। আমি আমার কষ্ট গুলোর শিকড়ের সন্ধান পাচ্ছিলাম।
আমি মাত্র একদিন আগে মহেশখালীর মৈনাক পর্বতে আদিনাথ মন্দিরে পবিত্র আত্মার সাক্ষাত পেয়েছিলাম যে আমাকে বলেছিল : রাবন অমর হবার বর পেয়েও মৈনাক পর্বতে দৈহিক প্রয়োজনীয়তায় সারা দিতে যেয়ে অমরত্ব হারিয়েছিল, আশ্চর্য তার কথা শুনে আমার চট করে মনে পরে গিয়েছিল সুমেরের গিলগামেসের কথা কেননা ঠিক তেমনটাই ঘটেছিল গিলগামেসের ক্ষেত্রে , সে অসময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল বলেই তস্কর সর্পের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল অমৃত চুরি করে নেয়ার। এই রাবন এই গিলগামেসের গল্প গুলো একই রকমের হল কি করে সেই হাজার বছর আগে ? এবং কেন আমার রাবনের জন্য দু:খ হয় , দু:খ হয় গিলগামেসের জন্য ?
রোমের সম্রাট কবি মার্ক অরেলিয়াসের ছিল এক মস্ত বড় ক্রীসেনথেমাম ফুলের মত মন , তিনি কবিতার সৌন্দর্য দিয়ে রোম শাসন করে গিয়েছিলেন মানুষকে ভালোবেসে ,কিন্তু তার মৃত্যুর পর সব হেঁটেছিল উল্টা পথে , আমার মার্ক অরেলিয়াসের জন্যও দু:খ হয়।
আর দু:খ হয় ভাভিলভ্ নামে এক স্বপ্নচারী সোনার মানুষের জন্য। তিনি হেঁটেছেন কন্টকময় এই পৃথিবীর পথে পথে ,তিনি ছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম শস্য দানা সিলেকশনারদের মধ্যে একজন ,সম্ভবত তিনি ছিলেন এই ফিল্ডের জনক, আজও পর্যন্ত তার বীজ ব্যাংক পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় । তিনি দেশে দেশে ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করতেন উঁচু মানের বীজ , যাদের ফলন হতো বাম্পার, যারা ছিল প্রতিকূল পরিবেশে টিকসই। তিনি বিশ্বাস করতেন যে তিনি একদিন এমন বীজ তৈরী করতে সক্ষম হবেন যা সমস্ত পৃথিবীর মানুষের খাদ্যাভাব ঘোচাতে পারবে। ভাভিলভ্ জানতেন না যে লিসেন্কো / স্ট্যালিনেরা স্বপ্নচারী নয় , তারা বাস্তব , তারা মেডুসার মত বহু মাথা ধারন কারী মেডুসারই সন্ততি দৌহিত্রগন এবং তাদের ধ্বংস করতে পারে যে পার্সিয়াস সে শুধু মিথ, অবাস্তবতার দস্তা মোড়ানো মিথ্। তাই ভাভিলভ্ দেশ ও সমাজতন্ত্রের শত্রু প্রমানিত হয় রক্তখেকো নেকড়েদের কোর্টে। মৃত্যু দণ্ডের রায় হয় । পরে বেশ কিছু বুদ্ধীজীবির অনুরোধে স্ট্যালিনীয় সমাজতান্ত্রিক মানবতা দেখিয়ে মৃত্যদণ্ড রদ করে নিক্ষেপ করা হয় কারাগারে , যেখানে লোক চক্ষুর আড়ালে অভুক্ত রেখে হত্যা করা হয় সে সূর্য সন্তানকে যে পৃথিবীর সব মানুষের খাদ্যন্বেষনে নিয়োজিত হয়েছিল।
মায়াকোভস্কীর ছিল এক অসামান্য মেধার মেগাফোন , তিনি দরাজ কন্ঠে সেই মেগাফোন ফাটিয়ে গেয়েছিলেন বিপ্লব ও সমাজতন্ত্রের গান কিন্তু সেই বিপ্লব ও সামাজতন্ত্রে
তিনি যখন আর শ্বাস নিতে পারছিলেন না তখন তিনি লিখলেন :”আমি জানি আমার এই পথ গ্রহনযোগ্য নয় এবং আমি আমার কমরেডদের বলবো তারা যেন কোন দিন এ পথ বেছে না নেয় ” , তারপর এক শটে উড়িয়ে দিয়েছিলেন সমস্ত মেধা ও যন্ত্রনার পাওয়ার হাউজটিকে। আমার সমাজতন্ত্র ও মায়াকোভস্কীর জন্য কষ্ট হয়।
ইতিহাস অনেক কথা বলে কিন্তু আমার দু:খ হয় ইতিহাস প্রায়শই সত্য কথা বলেনা বলে। নীরো কি আসলেই বাঁশী বাজিয়েছিল প্রাসাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন পুড়ছিল রোম ? নূতন ইতিহাস কিন্তু বলে অন্য কথা।
অগ্নিকান্ডের সময় সে রোমেই ছিলোই না, ছিলো মাতৃভূমি এন্টিয়ামে ( বর্তমান এন্জিও) । কিন্ত খবর পেয়ে হন্ত দন্ত চড়েছিল ঘোড়ার গাড়ীতে । সেই সময়ে জীবিত Tacitus এর মতে নীরো দরিদ্র প্রজাদের বাসস্থান দিয়েছে, দিয়েছে আর্থিক সাহায্য যাতে তারা পুনর্নির্মান করতে পারে বিধ্বস্থ শহর, সে বাস্তবায়িত করেছিল fire safety code !
নীরো ছিল নির্দয় ও নষ্ট : সে এই অগ্নিকান্ডের দায় চাপিয়েছিল সদ্য উদ্ভুত খৃস্টানদের ওপর এবং শুলে চড়িয়েছিল পিটার পল সহ অন্যান্য নেতাদের। অথচ নীরো পরবর্তী রোম হল খৃষ্টান শাসিত রোম । তার মৃত্যুর দেড়শ বছর পরে Cassius Dio প্রথম বাঁশী বাজানোর প্রসঙ্গটির অবতারনা করে । নীরোর রোমের সিনেট ও এক্সিকিউটিভ ক্ষমতায় বসে ছিল যেই সব তস্কর ও ইঁদুরেরা তাদের সমবেত শক্তির কাছে সম্রাটের শক্তি ছিল অপ্রচুর। নীরো এদের ক্ষমতাকে ভুল নিক্তিতে পরিমাপ করে কায়েমী স্বার্থের দুর্গে হেনেছিল আঘাত। সে তাদের চুরির পথ বন্ধ করে দিয়েছিল এবং তাদের ওপর করারোপ করে নিজের প্রাসাদের অদূরে তৈরী করেছিল এক বিশাল শৌচাগার যেখানে হাজার হাজার দরিদ্র প্রজা স্নান করতে পারতো, খুলে দিয়েছিল পার্কের অর্গল যেখানে তারা বিশ্রাম করতে পারত। এমনকি সে তার প্রজাদের তার প্রাসাদ পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। দেবতাদের নিষিদ্ধ শহর অচ্ছুতদের জন্য খুলে দিয়ে নীরো ক্ষেপিয়ে তুলেছিল এস্টাবলিশমেন্টকে । তার ওপরে সে পরিকল্পনা করছিল এক অবিশ্বাস্য স্বাপ্নিক প্রজেক্ট ।সে খনন করতে চেয়েছিল সেই সময়ের তিলোত্তমা পম্পেইয়ের সাথে রোমের সংযোগকারী একটি খাল এবং তার অর্থায়ন করার জন্য ধনীদের ওপর আরোপিত করতে চেয়েছিল অতিরিক্ত কর । যারা স্বেচ্ছায় কর দিতে চাইতোনা তাদেরকে দুদকের মাধ্যমে ধরে এনে ব্যবস্থা করেছিল বড় অংকের জড়িমানার। সেই একই নীরো যে ছিল পিওর ব্লাড রোমান, ছিল অত্যন্ত শ্রদ্ধাবান মানব সভ্যতায় গ্রিকদের অবদানের জন্য , এবং “রোম গ্রিকদের করারোপ করার অধিকার রাখেনা” এই কথা বলে গ্রীসকে করে দিয়েছল বেকসুর কর মুক্ত। ।
প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে , প্রতিটি দাস ও চাকরকে ক্রয় করার মাধ্যমে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয় যে নীরো বাধ্য হয় আত্মহননে। তারপরে লিখা হয় ইতিহাস , নষ্ট নীরোর ইতিহাস , যে ইতিহাসে উহ্য থাকে তার ভালো কাজ গুলো কিন্ত বহু গুন বাড়িয়ে লেখা হয় তার অপকর্ম । আমার মিথ্যা ইতিহাস ভালো লাগেনা এবং ইতিহাস যেহেতু লেখা হয় বিজয়ীদের দ্বারা, আমার কেন জানি মনে হয় ইতিহাস সত্য কথা বলার ভান করে মাত্র, সত্য কথা বলেনা ।
আমি গত দুই সপ্তাহ বাংলাদেশের পাহাড় , পর্বত , নদী ,মাঠ বৃক্ষ , সভ্যতা , গোরস্থান , শ্মশ্মান চষে বেড়িয়েছি কোন এক যুক্তিহীন ঘোরের মধ্যে । কোটি কোটি বছরের ত্রিকালদর্শী নেস্টর যে পাহাড় , যে নদী, যে সাগর আমি তাদের বলেছি : আমি থাকবোনা কিন্তু ইথারের রেকর্ডারে রয়ে যাবে আমার কন্ঠস্বর এবং মানুষ যখন অতীতের কন্ঠস্বর গুলো ডাউনলোড করতে শিখবে তারা যেন আমার কন্ঠস্বরটি চিনিয়ে দেয় , তারা যেন বলে এই সেই অগোছালো শিহাব যে সমুদ্র কাঁধে নিয়ে হেঁটেছে পথে পথে , ইতিহাসের পাতায় পাতায় ঘুরে ঘুরে চিহ্নিত করতে চেয়েছে সেই তাদের যারা মানবতার শত্রু এবং সেই তাদের যারা এই পৃথিবীকে শুধু মাত্র বাসযোগ্যই করে যায়নি বরং সতত কাজ করেছে এই গ্রহকে আরও ভালো করে যেতে ।
এই সেই শিহাব যে কেবল ভালোবাসে।
ফেব্রুয়ারী ৭,২০১৬ সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, বাংলাদেশ ।
পাদটিকা :
নীরো- “Rome’s bad boy Nero rises from the ashes” National Geographic, September 2014, fascinating Article by Robert Draper
পার্সিয়াস – গ্রীক বীর মেডুসা গরগোনিয়াকে হত্যা করেছিল
নেস্টর- সফোক্লিসের ইডিপাসের চরিত্র