নরওয়ে থেকে:-
জীবনটা খুবই ছোট,, কি বিচিত্র ছোট্ট এই জীবন জুড়ে চারিদিকে অপ্রাপ্তি হতাশা , না পাওয়া আর ব্যার্থতার কাহিনী !! দায়িত্ব আর কাজের চাপে ঘুমানোরই সময় পাইনা। তার পরও নিজের অর্জণ গুলোর দিকে থাকালে সব কিছু শুন্য মনে হয়। সারাদিন কাজে থাকি,, মোবাইলে মেসেজের পর মেসেজ আসে, সব গুলো পড়ে দেখারও সময় হয়ে উঠেনা। সামান্য কিছুক্ষন আগে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি সুমিতের ইনভাইটেশন। সুমিত আমার বন্ধু , ও ভারতীয় /নরওয়েজিয়ান, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার , বয়স আনুমানিক ২৯, এই বয়সে সুমিত একজন সফল মানুষ ,, নিজের যুগ্যতা আর কর্ম দক্ষতায় এই বয়সেই ও অনেক সাফল্যের মাইলফলক অর্জন করেছে। গত দুই বৎসর আগে ওর অফিসের প্রায় সবাই কাজ হারালেও সুমিতের কাজ যায়নি। ওর প্রতিষ্টান ওর মতো কর্মীকে হারানোর মতো সাহস দেখতে পারেনি ।ওকে দেখলে সত্যি হিংসা হয়। ওর কর্ম দক্ষতা সত্যি দেখার মতো। বৎসর খানেক আগে সুমিত ও শিখার বিয়ে হয়। খুবই সুখী সংসার ওদের। সময় হয়ে উঠেনা তার পরও সুমিত ও শিখার আমন্ত্রণে ওদের বাসায় প্রায় সময় দাওয়াত খেতে গিয়েছি , সুখী সংসার, বড়ো চাকরি , অনেক ধন দৌলতের মালিক তাই সুমিত পরিবারে সব সময় পার্টি লেগেই থাকতো। এখনো মনে আছে কয়েক মাস আগে kristiansander এক রেস্টুরেন্টে খাবার পর আমরা সবাই মিলে অনেক গুলো ছবি তুলেছিলাম। সুমিত অনেক অনেক টাকার মালিক তাই সব সময় কেমন জানি মোহের মধ্যে থাকতো , শিখার সাথে বিয়ে হবার পর ওর জীবনটা অনেক পাল্টে যায় ,,ওরা দুজনই অনেক সুখী ছিল। সুমিতের সুখী সংসার দেখে ভালো লাগতো,, . ওদের বাসায় গেলে শিখার হাতের ভালো ভালো দেশীয় খাবার খাওয়া যেত।
মাস খানেক আগে সুমিত শিখার একটা ছেলে হয়। ছেলেকে পেয়ে পুরো পরিবার জুড়ে ওদের কিযে খুশি। ভারত থেকে ওর মা বাবা ভাই ভাবি সবাই নরওয়েতে বেড়াতে আসেন খুশির সময় ভাগাভাগি করবার জন্য . আপনারা অনেকেই হয়তো জানেন , সুমিত আমার প্রিয় বন্ধুদের একজন, নরওয়ে জীবনের সবচে ভালো সময়গুলো আমি সুমিত ও তার পরিবারের সাথে কাটিয়েছি। ও আমার নিজের ভাইয়ের মতো। ওর বৌয়ের দিকে থাকলে আমার নিজের বড়ো বোন মান্নার কথা মনে পড়তো।দেখতে অবিকল আমার বোনের মতো, টিপিকাল সাউথ এশিয়ান মেয়ে। সুশীলা, বিনয়ী, কর্মঠ ও দায়িত্ব পরায়ণ। সুমিতের পুরো পরিবার আমার ফ্যান, যেকোনো কারণেই হোক ওরা আমাকে অনেক অনেক ভালোবাসে ও শ্রদ্ধা করে,, তাই সুমিত ও তার পরিবারের প্রতি আমার আলাদা একটা টান আছে। সুমিতের জীবনের একেক খারাপ সময়গুলোতে আমি ওর এবং ওর পরিবারের পাশে ছিলাম। বন্ধু হিসেবে বন্দুর প্রতি দায়িত্ব পালন করেছি ,, ওর প্রথম স্ত্রীকে হারানোর পর মানুষিক সাপর্ট দিয়েছি ,, ও যখন প্রথম স্ত্রীকে হারিয়ে মানুসিক রুগীর মতো ছিল , এক বৎসর ওর পাশে থেকেছি। মাস খানেক আগেও সুমিতের পুরো পরিবার আমাকে দেখতে মান্দালে এসেছিলো। ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড ছেড়ে আসার পর থেকে সুমিতদের সাথে বেশি একটা দেখা হয়না। আজকে ঘুমানোর আগে সুমিতের কাছ থেকে ইনভাইটেশন পেলাম। মরদেহ দহন করতে যাবার ইনভাইটেশন। কিছু বুঝে উঠতে না পেরে সুমিতকে কল দিলাম। ও কথা বলতে পারছে না শুধুই কাঁদছে , অনেক কষ্টে বলল যে গত ৩ দিন আগে শিখা মারা গেছে ,, মরদেহ অসলো সেন্ট্রাল হসপিটালে আছে , আগামী মঙ্গলবার ওর শেষকৃত্ত হবে , যদি সময় থাকে আমি যেন উপস্থিত থাকি। ভীষণ চাপের মাঝে দিন যাচ্ছে, তার মাঝে শিখার মৃত্যুর খবর শুনে মনটা হটাৎ করে অনেক খারাপ হয়ে গেলো। অনেক কষ্টে সুমিতের কান্না থামালাম, বললাম যে সময় করে উঠতে পারলে অবশ্যই আসবো । আর যেকোন যা দরকার লাগবে আমাকে জানাবি ও প্রয়জন পড়লে আমার বাসায় কয়েক দিনের জন্য চলে আসবি।
আমরা সবাই দিন রাত যে জীবনের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছি তার ঠিকানা কোথায়?? শিখাও আমাদের মতো দিনরাত পরিশ্রম করেছে। বাবা মা, শশুর শাশুড়ি, স্বামী সন্তানের জন্য কিই না করেছে ও। পেশায় ও নার্স ছিল। ওর রুগীরা ওকে এত বেশি পছন্দ করতো যে অসলোর যে হসপিটালে ও কাজ করতো সেখান থেকে ওকে ছুটি দিতে চাইতো না। আজ তার কর্মস্থলের বিল্ডিংয়েই ও নিজেই মরদেহ হয়ে শুয়ে আছে ,,শিখা ছিল ওর বাবা মায়ের হাতের লাটি, ওর উপার্জনেই দেশে ওর বাবা মা ভাইয়ের সুখী জীবন যাপন। জানিনা শিখাকে হারিয়ে তাদের কি অবস্থা এখন ?? অত্যন্ত পরিশ্রমী শিখা দিনরাত কাজ করে , স্বামী, সংসার, দায়িত্ব , স্বামীর দেওয়া পার্টি সবগুলো কিভাবে সামলাতে তা ভেবে পেতাম না, তাই সুজুগ পেলেই ওকে বেঙাতাম, বলতাম শিখা তুমি কি রোবট নাকি মানুষ ?? ও শুধু মৃধু হাসতো। , যা মন প্রাণ থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে চাই তা কেন জানি বারেবারে ফিরে আসে তাইনা ?? যা মনপ্রাণ দিয়ে চাই , তাই আমাদের পেছনে ঠেলে দিয়ে দূরে চলে যায়। সুমিতকে বললাম ধর্য ধরতে, শক্ত হয়ে থাকতে, জানি ওর বর্তমান পরিস্তিতিতে আমার কথাগুলোর তেমন কোনো যুক্তিকথা নাই। তার পর বললাম ,, কেননানা ওর সদ্য জন্মনেয়া ছেলেটা ওর প্রাণ প্রিয় মাকে হারিয়েছে। সুমিতের দায়িত্ব হলো সে যেন তার ছেলেকে মা বাবার ভালোবাসা দিয়ে বড়ো করে তুলে। আমরা সবাই এগিয়ে যেতে চাই ,, সামনে কত যে অন্ধকার তা তারাই শুধু অনুধাবন করতে পারে যারা সে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আছেন. বন্ধু সুমিত ও ওর ছেলের জন্য হৃদয় অন্তস্তল থেকে ভালোবাসা।
আমাদের সবার হাতে সময় খুবই কম। যতদিন বেঁচে আছেন ভালো থাকার চেষ্টা করবেন, পরিবার পরিজন, বন্ধু বান্দবীদের সাথে ভালো সময় পার করবার চেষ্টা করবেন। ছুট্ট এই জীবনে সামান্য কিছু দিন ভালো থাকার চেয়ে মূল্যবান আর কিছুই নাই।
সবার জন্য শুভ কামনা রইলো।