“আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের ‘পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে
প্রভাত-পাখির গান।
না জানি কেন রে এতদিন পরে
জাগিয়া উঠিল প্রাণ।”
রবিবাবু “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” না ঘটালেও আজ প্রভাতে ঘুম ঘুম চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি-
“নীল নবীনের আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।”
মনে হল আমার হৃদপিন্ড “ঝপাত” করে বুকের থেকে পেটের মাঝে পরে গেল।বৃষ্টি- প্রেমিক এক খাঁটি বাঙালীর বৃষ্টি দেখে এহেন মর্মব্যাথার কারন আর কিছুই না, আমাদের “তৃতীয় সম্মিলিত বাংলা মেলা” হওয়ার কথা আজ। ডেনটোনিয়া পার্কের মত খোলা জায়গায়। অনেক রাতে ঘুমুতে যাবার পরেও সাত সকালে ঘুম থেকে উঠেছিলাম অতি উৎসাহের সাথে আমাদের তারকা এস. আই. টুটুলকে রিসিভ করতে যাওয়ার জন্য।শুনতে ছ্যাবলামি মনে হলেও আমার মত তুচ্ছ মানবীর কাছে সেলিব্রেটীদের দেখা পাওয়া খুবই আনন্দের ব্যাপার। আরিফ ভাই, রনি ভাই ও নাজমা আপু সহ সবাই মিলে অভিনন্দন জানিয়ে নিয়ে আসলাম মাটির মানুষ অমায়িক এই ভদ্রলোককে।যাত্রাপথে সকলের মাঝে ঐ একটিই উদ্বেগ লক্ষ্য করলাম- বৃষ্টি যদি হয় তবে আমাদের দর্শকরা আসবেন কিভাবে? গত দুটি মাস ধরে যে অক্লান্ত পরিশ্রম বাংলা মেলার টিম করে যাচ্ছে -তা কি ভেস্তে যাবে? এতদূর থেকে আসা শিল্পী গান কি গাইতে পারবেন? আরও কত কি?
এবার গান গাইবার সময়ে এস. আই. টুটুল ভাইয়ার (ভাইয়া বললে মনে হয় এই “তারকা” আমার বহুদিনের চেনা) একটি লাইন কোট করতে ইচ্ছা করছে-
“দর্শকদের দেখে মনে হচ্ছে এ যেন একটি ছোট্ট বাংলাদেশ।”
দর্শকের উপচে পরা ভিড়ে শেষের দিকে আসা সকলে বসার জায়গাও পান নি। যদিও তাদের জন্য খারাপ লাগা উচিত কিন্তু লাগছে না কারন এই ভিড়ই প্রমান করে এটি নি:সন্দেহে ছিল একটি সফল আয়োজন।
দুই দেশের জাতীয় সংগিত শুদ্ধভাবে পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হয় অর্ধদিনব্যাপি এই আয়োজন। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে একেবারে সময়মত শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। “প্রমিনেন্ট প্রত্যয় কানাডার” একটি ছোট আয়োজনে কামরান, মম কাজী, রাইসা, মাইসা ও পলি পরিবেশন করেন নাচ, গান ও আবৃত্তি। বাংলাদেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির কথা মাথায় রেখে সাজানো হয়েছিল এই পর্বটি। এরপর একে একে দর্শকদের মন জয় করতে আসেন ফারুক, ফারহানা জয়, মৌসুমী, আইরিন আলম, সাবু শাহ, নোবেল, রিংকু ও মুক্তা সারোয়ার। এরা প্রত্যেকেই তাদের স্বপ্রতিভার চমৎকার দৃষ্টান্ত রাখেন এবং দর্শক মাতিয়ে তোলেন। নৃত্যকলা কেন্দ্র নিয়ে আসে অসাধারন সব নাচের পরিবেশনা। সুদূর নিউ ইয়র্ক থেকে আগত শ্রদ্ধেয় আব্দুল আলিম তনয়া নুপূর আলিম স্টেজ মাতান মাটির গান দিয়ে। এবং সর্বশেষে এস. আই. টুটুল তার জাদুকরী কন্ঠে কখনও দর্শকদের হাসান, কাঁদান এবং নষ্টালজিক করে ফেলেন। তার অসাধারন গানের পরিবেশনায় মুগ্ধ হয় গোটা টরন্টো।
মেলায় ছিল নানা রকম স্টল। চা, ঝালমুড়ি, সমুচা, ফুচকা, চটপটি, বিরিয়ানী, চিকেন ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্যের সাথে সাথে ছিল নানা রকম তৈরীপোশাক, গহনা, ব্যাগ, তৈজসপত্র, ঘর সাজানোর জিনিসের বিশাল সমারোহ। ছোট্ট বন্ধুদের জন্য ছিল বাউন্সিং ক্যাসেল।বিশেষ রেফেল ড্র এর ব্যাবস্থা ছিল আকর্ষনীয় পুরস্কার সহ।
বাঙালীর ডেনটোনিয়া পার্কের এই প্রানের “সম্মলিত বাংলা মেলায়” উপভোগ করতে, যোগ দিতে এবং সমর্থন করতে একে একে আসেন এবং বক্তব্য রাখেন-রিমা বার্নস ম্যাকগাওণ- এম.পি.পি.ডলি বেগম- এম.পি.পি.মারিয়া সারাস- এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর- ন্যাশনাল এথনিক প্রেসজিম ক্যারিগিয়ানিস- সিটি কাউন্সিলরমাইকেল চ্যাটু- এম.পি.পি.সালমা জাহিদ- এম.পি.আহমেদ হোসেন- সম্মানিত মিনিস্টার অব ইমিগ্রেশন।তাঁরা সকলেই উদ্যাক্তাদের অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানান।
মেলার আয়োজকদের পক্ষ থেকে কমিউনিটির গুরুত্বপূর্ণ কিছু বাছাই করা মানুষদের সার্টিফিকেট ও এ্যাওয়ার্ড প্রদানের মাধ্যমে সন্মানিত করা হয়। এই সময়ে মেলার কনভেনর আখলাক হোসেন ও চেয়ারপার্সন নাজমা হক তাদের মূল্যবান বক্তব্য রাখেন।তারা যাকারিয়া চৌধুরী, আরিফ আহমেদ, মাহবুব চৌধুরী রনি, আলমগির হোসেন, নিশোসহ আরোও অনেককে বিশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
মেলার সবচেয়ে বিশেষ আকর্ষন ছিল অত্যন্ত মেধাবী ও রূপসী শাড়ী পরিহিতা দুই উপস্থাপিকা যারা খুব সুন্দরভাবে অনুষ্ঠানকে উপস্থাপন করেছেন। ফারহানা ও আসমা তাদের জাদুকরী কথায় সকলকে মাতিয়ে রেখেছিলেন।
গত একমাস যাবত আমি কাজ করছি এই টিমের সাথে। এই শহরে এ ধরনের একনিষ্ঠ একদল মানুষ পাওয়া বড় দায়।কর্মবীর এক একজন মানুষ আসলেই এক একটি প্রতিষ্ঠান। আর তাইতো বৃষ্টিবিঘ্নিত এই দিনে কোনও তোয়াক্কা না করে সকলে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন এখানে। মেলার পুরোটা সময়ে উপচে পড়া বাঙালিদের ভিড় দেখে নিজের অন্দরের বাঙালী জেগে উঠছিল বারংবার। ছোট্ট আমার দেশটা কতদূর ফেলে রেখে এসেছি। আর এ ধরনের কিছু অনুষ্ঠান একটুখানি স্বাদ দেয় সেই বাংলাদেশের। আমরা আবার নতুন করে বাঙালী হয়ে উঠি।