প্রিয় পাঠক , ইদানিং লেখালিখির সময়ই পাচ্ছি না। অনেকদিন থেকেই ভাবছি, লেখা হচ্ছে না, লেখা হচ্ছে না, কি যেন একটা শূণ্যতা রয়েই যাচ্ছে। আপনারা ভালো আছেন আশা করি। গতকালের একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করি। আমার একজন প্রাক্তন সহকর্মী, যিনি বাংলাদেশের একটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, এখন টরেন্টোতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। তিনি গতকাল হঠাৎ ফোনে জিজ্ঞেস করলেন– রুমা, কানাডায় কমপক্ষে প্রতি বছর তিন লক্ষ লোক দরকার, এখানে সবাই বুড়া হয়ে গেছে এজন্য নাকি ২০১৯ সাল থেকে কানাডায় আসা খুব সহজ হয়ে যাবে? আইএল্টস ফাইলটস কিছুই আর লাগবে না?আমি রীতিমতো হকচকিয়ে গেলাম। ভাই কে বললো আপনাকে? আমার তো ঠিক জানা নেই , আমি তো শুনি নি। কানাডার ফেডারেল ইমিগ্রেশন মিনিস্টার আহমেদ হোসাইন গত ৩০ মে অটোয়াতে ইমিগ্রেশন সম্মেলনে দৃঢ় কণ্ঠে ২০২০ সালের মধ্যে কানাডার এজিং পপুলেশন বাড়ার কারণে শ্রম সংকট মোকাবিলার জন্য প্রতিবছরই .০৯ % হারে ইমিগ্রেশন বাড়াচ্ছেন এবং বাড়াবেন একথা জানিয়ে দিয়েছেন। কনফারেন্স বোর্ড অফ কানাডার সুপারিশ অনুযায়ী কানাডার অর্থনীতি সচল রাখতে প্রতি বছর কমপক্ষে তিন লক্ষ অভিবাসী আনা দরকার একথা শুধু আমি কেন মোটামুটিভাবে সবারই জানা আছে। কিন্তু এজন্য ২০১৯ সাল থেকে আইএল্টস ছাড়াই কানাডা লোক নেবে একথা আমার একদম জানা নেই। কানাডা একটি বাইলিঙ্গুয়াল দেশ– ইংরেজী এবং ফ্রেঞ্চ এদেশের অফিসিয়াল ভাষা। আইএল্টস ছাড়াই নাকি আমার সহকর্মীর একমাত্র ভাই যিনি একজন তরুণ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এবং বাংলাদেশ খুব ভালো চাকরি করছেন ২০১৯ সালে এক্সপ্রেস এন্ট্রি তে কানাডা চলে আসতে পারবেন। আর তাই এবছরের এই কয়েকটা মাস সে অপেক্ষা করবে। ছেলেটি এখবর পড়েছে বাংলাদেশের কোনো একটি সংবাদ পত্রে। এমতোঅবস্থায় কলম না উঠে কি আর পারে? থাকুক শত ব্যাস্ততা, লিখতেই হবে। এধরণের প্রোপাগান্ডা বাংলাদেশের যারা কানাডায় আসতে চাইছেন তাদেরকে শুধুমাত্র মিসগাইড করছে। আসুন তাহলে কানাডার একদম সাম্প্রতিক অভিবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে একটু আলোকপাত করা যাক।
শুরুতেই আসি এক্সপ্রেস এন্ট্রি বিষয়ে। ২০১৮ এর মে মাসের ২৩ তারিখে সর্বশেষ ড্রতে ৩৫০০ জন আইটিএ পেয়েছে, সর্বনিম্ন সিআরস স্কোর ছিল মাত্র ৪৪০। ২০১৮ তে এপর্যন্ত সর্বমোট ২১০০০ জন আইটিএ পেয়েছে। আইটিএ হচ্ছে ইনভিটেশন টু এপ্লাই , অর্থাৎ এক্সপ্রেস এন্ট্রি পুল থেকে পিআর হিসাবে আবেদনের সুযোগ। টেক ওনলি ক্যাটাগরিতে কানাডার যোগ্য এমপ্লয়াররা মাত্র দুই সপ্তাহে যোগ্য আইটি প্রফেশনালদেরকে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে বাছাই করে কানাডা নিয়ে আসছে। মার্চ, ২০১৭ তে চালু হওয়া এআইএনপির মাধ্যমে আটলান্টিক তীরের চারটি প্রভিন্সে প্রথম বছর দুই হাজার, এই বছর তিন হাজার অভিবাসী আনছে যা ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ৪০০০ এ। আটলান্টিক ইমিগ্রেশন পাইলট প্রোগ্রামের মতো নর্দার্ন ওন্টারিওতে খুব শিগ্রী একটি পাইলট প্রোগ্রাম চালু হচ্ছে যার মাধ্যমে সাডবারী , সেন্ট মারী( Sault Ste. Marie ), টিমিন্স , থান্ডার বে সহ নর্থার্ন অন্টারিওর যেকোনো জায়গায় আসলে অভিবাসীরা বিশেষ সুযোগ সুবিধা পাবে।
এবার আসি প্রভিন্সিয়াল নমিনী প্রোগ্রাম বা পিএনপি বিষয়ে। একমাত্র সাস্কাচুয়ান ছাড়া সব প্রভিন্সই শুধুমাত্র এক্সপ্রেস এন্ট্রি ক্যান্ডিডেট, অথবা যাদের কানাডার ভ্যালিড জব অফার আছে, বা যারা কানাডাতে টেম্পোরারি ফরেন ওয়ার্কার বা ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হিসাবে কাজ করছেন তাদেরকেই নোমিনেশন দিচ্ছে। অন্টারিও, নিউব্রান্সউইক , কুইবেক, প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড সহ অন্যান্য সব প্রভিন্সই ফ্রেঞ্চ ল্যাংগুয়েজ স্পিকার দের জন্য , যাদের কানাডিয়ান প্রফেশনাল লাইসেন্স আছে, যাদের আপন ভাই বোন কানাডাতে আছে তাদেরকেই নোমিনেশন দিচ্ছে। সাস্কাচুয়ান যে হারে বিসনেস এন্ট্রেপ্রেনিউরদের নোমিনেশন দিচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে তারাও অচিরেই এক্সপ্রেস এন্ট্রির ক্যান্ডিডেট ছাড়া আর নোমিনেশন দেবে না। তবে কানাডা ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট দের ভিসা অনেক সহজ করে দিয়েছে এবং তারা যাতে পড়াশুনা শেষ করে খুব দ্রুত চাকরি পায় এবং পিআর হতে পারে সেজন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। কানাডা ২০১৮ সালে কমপক্ষে ৫০০০ ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট ভিসা ইসু করবে– একথা আইআরসিসি থেকে জানানো হয়েছে।
এবার আসি এইমুহূর্তের ভীষণ বিতর্কিত রেফিউজি পরিস্থিতি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। নভেম্বর ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৪০,০৮১ জন সিরিয়ান রেফুজিদের কানাডা স্বাগত জানিয়েছে। এই সমস্ত রেফুজিদের সার্বিক পুনর্বাসনের দায়িত্ব কানাডা সরকার নিয়েছে। কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রী ক্ৰিষ্টিয়া ফ্রীল্যান্ড সম্প্রতি বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেছেন এবং কানাডায় তাদের কিছু সংখ্যকের পুনর্বাসনেরও ইঙ্গিত দিয়েছেন। ইসরাইল সম্প্রতি ৩৮০০০ আফ্রিকান রেফুজিদের বের করে দিলে, এদের কিছু সংখ্যক কেও কানাডা আশ্রয় দিচ্ছে।
ট্রাম্পের অভিবাসন নীতিমালার কারণে আমেরিকা থেকে এযাবৎ কালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বিতাড়িত রেফিউজি কানাডায়, বৈধ এবং অবৈধ পথে ঢুকে পড়েছে। আর একারণে ফেডারেল গভর্নমেন্ট এবং কুইবেক সরকার যৌথভাবে টাস্কফোর্স গঠন করে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার চেষ্টা করছে। ২০১৮ এর এপ্রিল পর্যন্ত ৬০০০ রেফিউজি আমেরিকা থেকে কুইবেকে অনুপ্রবেশ করেছে। ২০১৭ সালে আমেরিকা থেকে সর্বমোট ২৫০০০ রেফিউজি কুইবেক সীমান্ত দিয়ে কানাডা ঢুকে পড়ে। আর এজন্য দেশে বিদেশে কানাডা ভীষণ সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছে– বলা হচ্ছে কানাডা তার নিজস্ব বর্ডার সুরক্ষা করতে জানে না। কিন্তু আসলে বিষয়টি সেরকম নয় – বর্তমান সরকার রেফুজিদেরকে সমস্যা মনে না করে রিসোর্স হিসাবে দেখে। কারণ তারা মনে করে কানাডার এজিং পপুলেশনের অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে অভিবাসীদের দরকার আছে। কানাডা একটি ওয়েলফেয়ার স্টেট, এখানে যত রেফিউজি ঢোকে তাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা সব কিছুরই দায়িত্ব সরকারের। বর্তমান প্রধান মন্ত্রী জাস্টিন ট্র্রুডু তার বাবা পিয়ের ট্র্রুডুর মতোই রেফিউজি এবং অভিবাসীদের জন্য কানাডার দ্বার এখনো খোলা রেখেছেন।
কিন্তু এই এতো রেফুজিদের ভরণ পোষণ চলছে বা চলবে কি করে? সরকার চলে মূলত জনগণের ট্যাক্সের টাকায় ; রেফিউজি যতই বাড়ুক না কেন জনগণকে তো সেবা দিতে হবে ষোলো আনাই তাই না? তাই প্রভিন্সগুলো উঠে পড়ে লেগেছে তাদের নিজস্ব ইনকাম বাড়াতে, ফেডারেল সরকারও চায় তাদের ইনকাম বাড়াতে। কুইবেক সরকার তাদের প্যাসিভ ইনভেস্টর প্রোগ্রামের মাধ্যমে ইনভেস্টরদের নিয়ে আসে। আর এখন অপেক্ষাকৃত কম টাকায় সব প্রভিন্সই প্রতিযোগিতায় নেমেছে কিভাবে বিসনেস ইমিগ্র্যান্ট এবং ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের আন্তে পারবে। আর এক্সপ্রেস এন্ট্রি, টেক অনলি, এআইএনপি প্রোগ্রামগুলো চালু আছে হাইলি স্কীলড লোকজনদের জন্য যাদের কানাডার লেবার মার্কেটে সত্যি ব্যাপক চাহিদা আছে। কাজেই চটকদার বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ না হয়ে , নিজেদের স্কিল বাড়িয়ে কানাডায় আসার সূযোগ নিতে হবে। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হিসাবে , বিজনেস উদ্যোক্তা হিসাবে অথবা আপনি যদি জেনুইন রেফিউজি হয়ে থাকেন তাহলেই কানাডায় আসতে পারবেন।
কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন বিষয়ে আপনার যেকোনো জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে আমাকে ইমেইল করুন, [email protected]
মাহমুদা নাসরিন, আরসিআইসি & কমিশনার অফ অথস , ক্যানবাংলা ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস, ৩০৯৮ ডানফোর্থ এভিনিউ, টরেন্ট, অন্টারিও, কানাডা।