পৃথিবীর প্রায় সব দেশ ই এখন করোনা আক্রান্ত। আর তাই এটি এখন বৈশ্বিক অসুখ। এই পরিস্থিতিতে কানাডা সহ বিশ্বের সকল দেশ ই এখন এই বৈশ্বিক মহামারী মোকাবেলায় ব্যস্ত । আর তাই পৃথিবীতে এখন ইমিগ্রেশন সহ সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্থবির হয়ে পড়েছে। তবে এই পরিস্থিতিতে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ইতালি, সৌদি আরব সহ যেসব দেশে লোকজন স্টুডেন্ট ভিসা, ওয়ার্ক পার্মিট এবং অভিবাসন নিয়ে যেতে পারতো, সেই সব দেশ তাদের ইমিগ্রেশন পলিসিতে জরুরি ভাবে বিভিন্ন পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছে। একমাত্র কানাডা ছাড়া বিশ্বের সব দেশেই ইমিগ্রেশন, স্টুডেন্ট ভিসা, ওয়ার্ক পার্মিট দেয়া বন্ধ রয়েছে। ২০২০ সালের মার্চ এবং এপ্রিলের শুরুতেও কানাডার ইমিগ্রেশন মিনিস্টার মার্কো ম্যানডেচিনু এবছরেই ৩ লক্ষ ৭০ হাজার অভিবাসী আনার লক্ষমাত্রা ধার্য করেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা কোভিট–১৯ এর কারণে বিশেষভাবে বাধাগ্রস্থ হয়। এপ্রিলেই কানাডার ইমিগ্রেশন ৭৮% কমে যায়। এদিকে করোনার কারণে কানাডার প্রতিবেশী দেশ আমেরিকাতে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি আর এজন্য এবছর এপ্রিলেই দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া বন্ধ ঘোষণা করেন, আবার জুন মাসের ২৪ তারিখে সেদেশে সকল জব ভিসা দেয়াও স্থগিত করেন। আমেরিকানদের অর্থনৈতিক মন্দা এবং বেকারত্ব রোধ করা এই ঘোষণার মূল উদ্দেশ্য। ফলে আমেরিকাতে প্রতি বছর ৫ লক্ষ ২৫ হাজার বিভিন্ন ধরণের জব ভিসা দেয়ার প্রক্রিয়া আপাতত বন্ধ আছে। কিন্তু কানাডাতে ঘটেছে সম্পূর্ণ উল্টো ঘটনা। কানাডার ইমিগ্রেশন মিনিস্টার মার্কো ম্যানডেচিনু উদার আহ্বান জানিয়েছেন– কানাডা আসুন, কানাডায় আপনাদের স্বাগতম, আপনাদের মেধা ও দক্ষতা আমাদের বিশেষ প্রয়োজন। জুলাইয়ের ২৪ তারিখে কানাডার ফেডারাল, প্রভিন্সিয়াল এবং টেরিটোরিয়াল ইমিগ্রেশন মিনিস্টাররা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভার্চুয়াল মিটিং করেন। ফেডারেল মিনিস্টার মার্কো মেন্ডিচিনু এই মিটিং এর সভাপতি ছিলেন, নিউব্রান্সউইকের ইমিগ্রেশন মিনিস্টার ট্রেভর হোল্ডার ছিলেন এই মিটিং এর কো–চেয়ার। তাঁরা মূলতঃ কানাডার ইমিগ্রেশনে কোভিড –১৯ এর প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁরা সবাই কানাডাতে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালু রাখার জন্য বিভিন্ন ফেডারেল, প্রভিন্সিয়াল, রিজিওনাল, মিউনিসিপাল, এবং রুরাল পাইলট প্রোগ্রামের মাধ্যমে ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়াকে চালু রাখার এবং ত্বরান্বিত করার জোর সুপারিশ করেন। তাঁরা কানাডার বিভিন্ন প্রভিন্স, টেরিটরি, বড়ো , ছোট, রুরাল, রিজিওনাল ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গার সুনির্দিস্ট চাহিদা অনুযায়ী সারা বিশ্ব থেকে যোগ্য ইমিগ্রেন্ট এবং তাঁদের পরিবারকে কানাডায় নিয়ে আসার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যাক্ত করেন। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের উপর তাঁরা বিশেষ জোর দেন, ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের ট্রাভেল রেস্ট্রিকশন খুব তাড়াতাড়ি উঠিয়ে নেয়ার ইঙ্গিত দেন, আমেরিক্যান ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে কানাডা আসার ব্যাপারে কোনো রেস্ট্রিকশন নেই যদিও তাদের ভিসা মার্চ ১৮/২০২০ এর পরে হয়ে থাকে। গ্লোবাল ট্যালেন্ট স্ট্রিমের মাধ্যমে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা ইনফরমেশন টেকনোলজি সেক্টরের প্রার্থীদের ভিসা মাত্র পনেরো দিনে ইস্যু করার কথাও তাঁরা আলোচনা করেন। জুলাইএর ৮ তারিখে সবার জন্য উন্মুক্ত এক্সপ্রেস এন্ট্রি ড্র হয়েছে। এই ড্রর মাধ্যমে ৩৯০০ জনকে পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট হিসাবে বেছে নেয়া হয়েছে, সর্বনিম্ন স্কোর ছিল ৪৭৮। মার্চের ৪ তারিখের পর এটিই প্রথম সবার জন্য উন্মুক্ত এক্সপ্রেস এন্ট্রি ড্র হয়েছে। কানাডিয়ান এক্সপেরিয়েন্স ক্লাস ক্যাটেগরিতে জুলাই ২২ এবং ২৩ তারিখে এক্সপ্রেস এন্ট্রির পর পর দুটি ড্র হয়ে গেলো। এইসব প্রার্থী পোস্টগ্রাজুএট ওয়ার্ক পার্মিট বা ওয়ার্ক পার্মিট নিয়ে কানাডাতেই আছে। কোভিট–১৯ এর কারণে ট্রাভেল রেস্ট্রিকশন থাকায় কানাডার বাইরে থেকে লোকজন আসতে পারছে না বিধায় কানাডিয়ান এক্সপেরিয়েন্স ক্লাস এবং এবং পিএনপির মাধ্যমে মাত্রা ৪৩১ সিআরএস পয়েন্ট নিয়ে এক্সপ্রেস এন্ট্রি থেকে পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি দেয়া হয়েছে । কানাডা তার নিজস্ব প্রয়োজনেই ইমিগ্রেশনকে চালু রাখছে। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশটিতে মাত্র ৩ কোটি ৭৫ হাজার লোকজনের বসবাস। জন্মহার দেশটিতে শূন্য আর বয়স্ক লোকজনের সংখ্যা দেশটিতে অনেক বেশি। জন্মহার বৃদ্ধির আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও সফল হওয়া যায় নি। ২০৩০ সালের মধ্যে কানাডার ৯ লক্ষ বেবিবুমার যারা এখনও কর্মক্ষম আছে অবসর নিতে যাচ্ছে। করোনা ভাইরাস কানাডিয়ান পলিসি মেকারদের আবারো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো এদেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে, খাদ্যশস্য , মৎস এবং সীফুড, পোল্ট্রি, মাংস, ডিম্, দুধ, ফল ফলাদি উৎপাদন থেকে শুরু করে কানাডিয়ানদের প্লেটে খাবার পৌঁছে দেয়া, এদেশের স্বাস্থ্য খাতে সেবা প্রদানের জন্য, ক্রমবর্ধমান বয়স্ক লোকজনের কেয়ার নেয়ার জন্য ডাক্তার, নার্স, পার্সোনাল সাপোর্ট ওয়ার্কার, সাইকিয়াট্রিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট, পরিচ্ছন্ন কর্মী, ক্যাশিয়ার, গ্রোসারি ওয়ার্কার, সিকিউরিটি গার্ড, সমাজকর্মী, মেন্টাল হেলথ কাউন্সিলর সহ সকল ক্ষেত্রেই অনেক বেশি জনবল দরকার। আর সেজন্যই এই পান্ডেমিক এর সময়েও অন্টারিও, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কুইবেক, প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড, নোভাস্কোশিয়া , ম্যানিটোবা , সাস্কাচুয়ান, আলবার্টা , প্রভিন্সিয়াল নোমিনেশনের মাধ্যমে ইমিগ্রান্টদের পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট হিসাবে আবেদনের আমন্ত্রণ জানিয়েছে ।
কভিড–১৯ এর পান্ডামিকের সময় কানাডার সকল স্তরের এবং সকল দলের রাজনৈতিক নেতারা, সকল সাধারণ কানাডাবাসীরা যেভাবে মানবিকতা এবং বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে তা সমগ্র বিশ্বে কানাডার ভাবমূর্তি বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক গুন্। কানাডিয়ানদের যেভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে চার্টার প্লেন দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে, ইমার্জেন্সি রেসপন্স বেনিফিট দিয়ে সকল মানুষ, সকল বিসনেস, ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদেরকে যেভাবে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, যারা কানাডায় টেম্পোরারি রেসিডেন্ট হিসাবে আটকা পড়েছেন তাদের যেভাবে থাকতে দেওয়া হয়েছে, ভাইরাস মোকাবেলায় ডাক্তার–নার্স, পার্সোনাল সাপোর্ট ওয়ার্কার এবং সকল সাস্থকর্মীসহ সকল এসেন্সিয়াল সার্ভিস ওয়ার্কারদের নিয়ে যেভাবে সম্মিলিত ভাবে চেস্টা চালানো হচ্ছে – (বিজ্ঞান এবং মানবিকতার সমন্বয় ঘটিয়ে), কূটনৈতিক ভাবে প্রতিবেশী দেশ আমেরিকা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, চায়না সহ সকল দেশের সঙ্গে যে সুসম্পর্ক কানাডা বজায় রাখতে পেরেছে, তা সারা বিশ্বের মানুষ প্রশংসা করছে ।
কভিড–১৯ কানাডার পলিসি মেকারদের ভুলত্রুটিগুলোও চোখে আঙ্গুল দিয়ে আবারো দেখিয়ে দিয়েছে। তাই কানাডা তার স্বাস্থ্য খাত সহ লং টার্ম কেয়ার হোম, বর্ণবাদ, পুলিশ রেফরমেশন সহ অন্য সব ক্ষেত্রেই আরও ভালো পরিবর্তন আনবে এটাই প্রত্যাশা। এসব ক্ষেত্রে উন্নত সেবা প্রদান করার জন্য কানাডা তার নিজস্ব প্রয়োজনেই অনেক বেশি ইমিগ্রেন্টদের স্বাগত জানাবে।
ক্যানাডিয়ান ভিসা এবং ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত যেকোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাকে ইমেইল করুন; ভালো থাকুন সবাই, ভালো রাখুন সবাইকে।
জুলাই ২৪/২০২০, শুক্রবার কানাডিয়ান ফেডারেল, প্রভিন্সিয়াল এবং টেরিটোরিয়াল মিনিস্টার দের ভার্চুয়াল মিটিং (ছবিটি ইমিগ্রেশন মিনিস্টার মার্কো মেন্ডিচিনুর টুইট থেকে নেয়া)
লেখক : প্রিন্সিপাল কনসালট্যান্ট, ক্যানবাংলা ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস , টরেন্টো , শিক্ষক ও সমাজকর্মী। সাবেক সহযোগী অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ও কিং খালেদ বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব। [email protected]