মেঘলা আকাশ, বিকেলের হালকা বাতাসে উনিভার্সিটির ছেলে মেয়েরা এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউবা রেসকোর্স ময়দানে বসে ফেরিওয়ালার নিকট থেকে বাদাম কিনে খোসা ছড়াচ্ছে, কেউবা হোম ওয়ার্ক নিয়ে ব্যাস্ত , আবার কেউ বা দেশের পারিপার্শিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা করছে ।
চিহ্নমূল একটা বিকলাঙ্গ ভাঙা পাত্র নিয়ে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে । সাকিলা তার ব্যাগ থেকে দুটি টাকা ও কয়েকটা বাদাম দিয়ে বলে চলো এখানে বসা যাবে না । অদূরেই রমনা পার্ক, বিকালটা লোকে গিজ গিজ করে যেন তীর্থস্থান । এটা অতি পরিচিত জায়গা এবং এখানেই বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়ে থাকে । ইতি আর সুলতানার মতো অনেক বন্ধুদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হলে প্রাণ খুলে কথা বলা যায় । গত দুই মাস বাসায় মনে হচ্ছে বন্ধি খাঁচায় আবদ্ধ হয়ে পড়েছি, কোনো রকমে বের হতে পারলেই বেঁচে গেলাম ।
দিনের তিনটা বাজে ইউনিভার্সিটি পাড়ায় এসেছি , এখন সন্ধ্যা ৬টা, বাসায় না ফিরলে আম্মু ও আব্বু দুঃশ্চিন্তা করবে, তাছাড়া আজ লাঞ্চে বাসায় যাই নি । ইতি বলে আর একটু বস, তুইতো টেলিফোন করে বলেছিস কোথায় আছিস । হ্যাঁ, বলেছি । তথাপি আমি রাত করে ঘরে ফিরি না। ঠিক আছে না হয় TSC থেকে একটা টেলিফোন করে দে। টেলিফোন করার পর রেবেকা বলে সাকিলা তুই কোথায় ?
আম্মু, আমি ইতি ও সুলতানার সঙ্গে ইউনিভার্সিটি পাড়ায় । এত দেরি করার কি দরকার?
আম্মু আমি এখন-ই আসতেছি। সুলতানা আর ইতি বলে আন্টি রাগ করবে ,তুই একটা রিক্সা নিয়ে চলে যা। সুলতানা বলে আমি রাতে কল দেব তোকে । ইতি ও সুলতানা আর একটু বস,আর একটু বস বলে কিছুটা দেরি করে ফেলেছে । সে রিক্সা নিয়ে এলিফ্যান্ট রোড দিয়ে সাইন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে আসার পর জ্যামে পড়ে, এখানে প্রতি নিয়তই ভিড় থাকে । ভিড় ঠেলে বাসার নিকট আসার পর দেখে আবিদ রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে । ওকে দেখেই সাকিলা ভিতরে ভিতরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে , কিন্তু মেজাজ শান্ত করে মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটাতে চেষ্টা করে । সাকিলাকে দেখে আবিদ হাত উঠিয়ে বলে আমি তোমাদের বাসায় গিয়েছিলাম এবং অনেক সময় তোমার জন্য অপেক্ষা করে চলে যাচ্ছি। আমি তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই। কি কথা বলবেন?
আমার অনেক দেরি হয়েছে বাসায় ফিরতে, আমি ইউনিভার্সিটি গিয়েছিলাম। আবিদ মন থেকে দুঃখ পেয়ে বলে তোমার আজ সময় না থাকলে আর একদিন বলবো। সাকিলা কোনো কথার হ্যাঁ বা না জবাব দিয়ে রিক্সাওয়ালাকে বলে যাও।
সাকিলার পিছনে পিছনে মোশারেফ আসতেছিল । সে আবিদ ও সাকিলাকে দেখে দাঁড়ায় । সাকিলা বলে ভাইয়া তুমি বাসায় যাবে তো এস রিক্সায় । সে বলে না, তুমি যাও আমি হেটে যাবো এই বলে সে হাটতে থাকে। আবিদ সাকিলাকে পেয়ে ও কথা বলতে না পেরে হতাশ হয়ে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে সাইন্স ল্যাবরেটরির দিকে হাটতে থাকে। রিক্সাওয়ালা গেটে নামিয়ে দিলে ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে বাসার গেট খুলে দেখে রহমান ও রেবেকা বাগানে পানি দিতেছে। রহমান সাকিলাকে দেখে হেসে বলে আসছো?
হ্যাঁ ,আব্বু আমি ক্লাস থেকে আমার বান্ধবী ইতি ও সুলতানার সঙ্গে ইউনিভার্সিটি গিয়েছিলাম ।
বেশ করেছো ।
পিছনে পিছনে মোশারেফ বাসায় ঢুকে রহমান ও রেবেকাকে সালাম দিয়ে বলে মামী দেখতে দেখতে বাগানের ফুলের গাছ তো সুন্দর হয়ে উঠছে। রেবেকা বলে যত্ন নিতে পারি না। সাকিলা ঘরে ঢুকে কাপড় ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে বাহিরে এসে বলে ভাইয়া তুমি কেমন আছো ?
ভালো আছি।
তোমার চাকরি কেমন চলছে?
চলছে কোনো রকম।
তুমি কি ভাবে খাওয়া দাওয়া করো ?
আমি নিজেই রান্না করে খাই।
তুমি রান্না করতে পারো?
ডালচাল মিশিয়ে একটু পিয়াজ , কাঁচা মরিচ তেল লবন দিয়ে সিদ্ধ করি।
প্রতিদিন কি তাই করো?
হ্যাঁ, তাই করি। মাঝে মধ্যে হোটেলে খাই ।
উহ! তোমার অনেক কষ্ট হয়। আমি উইকেন্ডে গিয়ে তোমাকে কিছু রান্না করে দিয়ে আসবো এবং জায়গাটাও দেখে আসবো। সবাই হাসে এবং রহমান বলে যাক, তোমার রান্নার সমস্যা সমাধান হলো । মোশারেফ বলে তোমার রান্না করতে হবে না , তবে দেখতে চাইলে মোস্ট ওয়েল কাম। তাছাড়া তোমাদের একটা চাইনিজ ও পাওনা রয়েছে। এস চাইনিজ শোধ করে দেব। সাকিলা বলে তোমার এখন চাইনিজ খাওয়াতে হবে না। তুমি বিয়ে করলে, ভাবীর হাতের রান্না খাবো, তাতেই শোধ হয়ে যাবে। মোশারেফ হেসে বলে এই চাকরি করে বিয়ে করবো?
কেন মাসুদ আংকেল ভালো পয়সা দেন না?
যা দেয় তা থেকে মাসে ১০০ টাকা বাড়িতে দিয়ে নিজের পকেট খরচ চলে।
কেন শুনেছি মাসুদ আংকেল কর্মচারীদের অনেক টাকা বেতন দেন ?
জানিনা কাকে কি দেয়, তবে আমাকে যা দেয় এতে কোনও রকমে চলে ।
সে যাই হোক, তুমি বেশিদিন বেকার থাকো নি এবং তোমার কিছু এক্সপেরিয়েন্স হচ্ছে। সে জন্য আমি মামীর নিকট কৃতজ্ঞ । মামী সাহায্য না করলে আমি রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতাম ও অফিসে অফিসে গিয়ে ধর্ণা দিতে হতো। এখন আমি কাজ করি আর আমার বন্ধুরা রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে । রেবেকা বলে আস্তে আস্তে বেতন বাড়াবে ও প্রমোশন হবে । তাছাড়া তুমি সরকারি চাকুরীর জন্য চেষ্টা করো। মামা অবসর নিয়েছেন এবং আমাকে একটু সাহায্য করলে ভালো হবে । রহমান বলে আমি ছোট খাটো কাজ করেছি এবং আমার বেশি জানা শুনা নেই ।
মোশারেফ রাতে টঙ্গী চলে যাওয়ার পূর্বে রেবেকা বলে তুমি কি তোমার অফিসে আবিদ বলে কাউকে চীন?
আমাদের অফিসে?
আবিদ তোমাদের হেড অফিসে এক্সেসিউটিভ অফিসার হিসাবে কাজ করে। এই ছেলের সঙ্গে সাকিলার বিয়ের প্রস্তাব আছে?
মামী,আমি তো ফ্যাক্টরি অফিসে কাজ করি। আমি হেড অফিসে যাই না। তবে আপনি বললে আমি খোঁজ নিয়ে জানাতে পারি। সাকিলা তার ঘর থেকে এসে বলে ভাইয়া তুমি দেখো নি, এই সেই ছেলে আমাকে রিক্সা দাঁড় করিয়ে কথা বলতেছিলো।
হ্যাঁ, দেখেছি তবে চিনি না ।
মজিদ অফিসের কাজে চিটাগাং থেকে ঢাকা এসেছে । রাতে মজিদ ঘরে ঢুকার পথে উঁকি মেরে সাকিলার ঘরে দেখে সাকিলা মন খারাপ করে বসে আছে । মজিদ কাছে গিয়ে বলে সাকিলা তোমার শরীর কি ভালো নেই?
সাকিলা কিছুই বলে না ।
মজিদ রেবেকাকে বলে আম্মু সাকিলার কি হয়েছে?
তুই চুপ করে থাক ।
সাকিলা রাত ঘুমাতে পারতেছে না । সারা রাত এ এপাশ ওপাশ করে কাটিয়েছে। সকালে স্কুলের জন্য তৈরী হয়ে নাস্তা না করে বলে আম্মু আমার খিদে নাই এই বলে ঘর থেকে চলে যায়। রেবেকা রহমানকে বলে দেখো মেয়েটার কি রকম মেজাজ ,সে এখনও matured হয় নি। যে রকম মেজাজ,তাকে কি ভাবে বিয়ে দিবে, বিয়ে দিলেও সংসার করবে কি না সন্দেহ। রহমান বলে বিয়ে দিলে সবই ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ভয় পেও না।
মজিদ বলে আম্মু ও যখন রাজি হয় না, অযথা সময় নষ্ট করো না ।
রহমান রেবেকাকে জিজ্ঞেস করে আজ কি সীমা আসবে?
হ্যাঁ। তাইতো বলেছে ।
মজিদ বলে সীমা আন্টি কেন আসবে?
ভালো করে সাকিলাকে জিজ্ঞেস করে সিদ্ধান্ত নেবে ।
কখন আসার সম্ভবনা ?
আসলে হয়তো বিকেলের দিকে । আমার মনে হয় না যে সাকিলা সে সময় ঘরে আসবে। কাজেই না করে দেয়া ব্যতীত আমি আর কোনো পথ দেখছি না। ওর মতের বিরুদ্ধে আমাদের কোনো কিছু করা ঠিক হবে না। ছেলেটা আমাদের খুব পছন্দ এবং তার নিজের ও খুব আগ্রহ।
রাফাতের সঙ্গে তার ছোট সময় থেকেই একত্রে উঠা বসা , রেনু তুমি কি মনে করো যে সাকিলার রাফাতের সঙ্গে সম্পর্ক আছে?
না, আমার সে রকম কিছু মনে হয় না । আমি ওকে জিজ্ঞাসা করেছি, সে বলে রাফাত আমার ছোট কালের ক্লাসমেট এর বেশি কিছু চিন্তা করি না। তাছাড়া রাফাত পড়াশুনা করে নাই ,ইদানিং বি .এ পাস্ করেছে। ছোটোখাটো কি কাজ করে।
সাকিলা স্কুলে যাওয়ার পথে এক রেস্টুরেন্ট থেকে রুটি ও হালুয়া এবং ডিম্ ভাজি নিয়ে স্কুল টিচার্স রুমে গিয়ে বসে নাস্তা করে বেয়ারারকে দিয়ে চা আনিয়ে খেয়ে পত্রিকায় নজর দিয়ে দেখে আজকের কি তাজা খবর । হেডমিস্ট্রেস রোকেয়া বেগম বলেন কি ব্যাপার সাকিলা তুমি আজ বাসায় নাস্তা করার সময় পাও নি ?
আপা আমার সকালে নাস্তা করার মতো খিদে ছিল না । আম্মু খেয়ে আসার জন্য বার বার বলে ছিলেন। কিন্তু আমার খেতে ইচ্ছা হয় নি। তোমার দিকে তাকালে মনে হয় রাত ভালো ঘুম হয় নি। ঠিক বলছেন, আমার কেন জানি রাতে ভালো ঘুম হয় না। সে বিজ্ঞাপন বিভাগটা দেখেই শিউরে উঠে! সরকারি কলেজে টিচার নেবে! অনেক পোস্ট খালি আছে। সে হেডমিস্ট্রেসকে জিজ্ঞেস করে আপা আমার অনার্সে ভালো মার্ক্স্ আছে, ফাইনাল রেজাল্ট তো এখনো আসে নি, আমি কি দরখাস্ত দিতে পারি ?
হেডমিস্ট্রেস বলে তুমি অনার্স রেজাল্টের কাগজ দিয়ে দরখাস্ত করো এবং দরখাস্তে উল্লেখ করবে এম. এ পরীক্ষার রেজাল্ট আসলে সার্টিফিকেটের সত্যায়িত কপি পাঠাবে । সাকিলা বলে আমি তাই করবো। কাগজ পত্র কয়েক মাস লাগবে প্রসেস করতে এবং এর মধ্যে রেজাল্ট এসে যাবে ।
লাঞ্চে সাকিলা বাসায় না এসে রেস্টুরেন্ট থেকে পরোটা,সবজি এবং চা আনিয়ে খেয়ে লাইব্রেরিতে বসে অন্নান্ন টিচারদের সঙ্গে গল্প করে ক্লাস নিয়ে বের হয়ে ইউনিভার্সিটি মহসিন হল গিয়ে বেয়ারারকে দিয়ে খবর পাঠায় আরিফ রুমে আছে কিনা। আরিফকে পাওয়া গেলো এবং সে নিচে এসে বলে সাকিলা কি মনে করে তুমি আসলে?
এমনি-ই আসলাম । তোমাকে অনেক দিন দেখি না,সে জন্য আসলাম। তুমি বস , আমি দশ মিনিটের মধ্যে তৈরী হয়ে আসি এবং চলো ক্যান্টিনে গিয়ে চা খাবো। দুই জনে ক্যান্টিনে গিয়ে বসে বসে চা ও সিঙ্গারা নিয়ে খেতে খেতে সাকিলা বলে তুমি কি সরকারি কলেজে দরখাস্ত করবে?
আরিফ বলে আমাদের রেজাল্টতো এখনো আসে নি। সাকিলা বলে দরখাস্ত দিয়ে দেব এবং বলে দেব রেজাল্ট আসলে সার্টিফিকেট পাঠাবো । ঠিক আছে , আমিও দরখাস্ত দেব ।
তুমি দুপুরে কি খেয়েছো ? হলে তো লঙ্গর খানার খাওয়া ,একটা তরকারি ,মোটা ভাত আর তলানি ছাড়া ডাল। ওটা আমাদের হলেও ছিল। ডাল শেষ হয়ে যাবে সে জন্য বাবুর্চি পানি গরম করে ডালে মিশিয়ে দেয়। আরিফ বলে, তুমি আজ দুপুরে কি খেয়েছো?
আমি আজ বাসায় যাই নি ,রেস্টুরেন্ট থেকে খাওয়া এনে টিচার্স রুমে বসে খেয়েছি। কেন বাসায় যাও নি ?
ভালো লাগে নি তাই যাই নি। আমার খুব টেনশন লাগে, রেজাল্ট কেমন হয় ?
আরিফ বলে সবার ক্ষেত্রেই এক রকম।
সাকিলা বলে আরিফ তুমি তো ফার্স্ট ক্লাস পাবে ?
বলতে পারি না , তবে পরীক্ষা ভালোই হয়েছে। আমার মনে হয় তুমি পেয়ে যাবে এবং উনিভার্সিটিতে চান্স হবে তোমার। সে দেখা যাবে। আপাতত আমি একটা প্রাইভেট কলেজে যোগদান করবো আগামী সপ্তাহ থেকে। কোন কলেজে যোগদান করবে ?
তেজগাঁও কলেজে চাকরি পেয়েছি। তুমি তো স্কুলে কাজ করো এবং সরকারি কলেজের টিচিং জবের জন্য দরখাস্ত করবে । রেস কোর্সে খানিকটা ঘুরে আরিফ বলে চলো আমি ফার্ম গেট যাবো এবং তোমাদের রাস্তার মোড়ে নেমে যাবো। ফার্ম গেট কেন যাবে?
আছে, আমাদের গ্রামের একজনের সঙ্গে দেখা করবো।
আকাশ মেঘলা, খানিকটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে । রিক্সার হুট উঠিয়ে দিয়ে দুইজনে বসে বাহিরের দিকে তাকাচ্ছে । রিক্সাওয়ালা প্লাস্টিকের কভার দিয়ে দুইজনের গা ও পা ঢেকে দিয়ে রিক্সা চালানো শুরু করেছে। সাকিলা চুপ করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। অনেক দিন পর আরিফ ও সাকিলা দুই জন্যে রিক্সায় উঠেছে। সে জিজ্ঞেস করে সাকিলা তুমি কি কিছু বলতে চেয়েছিলে?
না , কি আর বলবো ।
আমি শুনেছি তোমার বিয়ে নিয়ে কি সব সমস্যা যাচ্ছে?
আমি প্রতিদিনই বাসায় কিছু না কিছু সমস্যায় পড়ি, সে জন্য ভাবছি কাজ পেলে দূরে কোথায় ও সরে পড়বো । আরিফ ফিক করে হেঁসে উঠে।
কাজ চাইলেই কি পাওয়া যায়?
তা ঠিক পাওয়া যায় না, আবার পাওয়া যায় ও। না, এর জন্য অনেক চেষ্টা করতে হয় । আমরা কেবলই পরীক্ষা দিয়েছি । পরীক্ষার রেজাল্ট হোক তার পরে আস্তে আস্তে চেষ্টা করবো । তুমিতো বাবা মায়ের হোটেলে, থাকা বা খাওয়ার সমস্যা নাই। আমি হলে থাকি, টুইশনি করে নিজের খরচ বহন করি। আজ টুইশনি করতে যাই নি।তুমিতো আমার আগেই স্কুলে চাকুরী নিয়ে নিজেকে ব্যাস্ত রেখেছো । না, সে দিক দিয়ে ঠিক আছে । ধান মন্ডি তিন নম্বর রোডের মাথায় আরিফ নেমে বলে তুমি যাও আমি আর একটা রিক্সা নিয়ে ফার্ম গেট যাবো । সময় পেলে উইকেন্ডে ইউনিভার্সিটি পাড়ায় আসবে । ঠিক আছে ।
সাকিলা মনে মনে ভাবে সুলতানা নিশ্চয়ই আরিফকে আমার ব্যপারে কিছু বলেছে। সে অনেক স্মার্ট ছেলে এবং গ্রামে গঞ্জে মানুষ হলে ও অনেক পরিশ্রমী। আমাদের সবারই নাড়ির টান গ্রামের সঙ্গে, গ্রামের মানুষ হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে শহরের মানুষের জন্য । আমরা গ্রাম থেকে সব কিছু পেয়ে গ্রামের মানুষকে অবজ্ঞা করি,বলি ” গেয়ে ভুত”, গ্রামের মানুষ দেখলে আমরা নাক সিঁটকাই, এটা নেহায়েত অন্যায়।
রাফাতকে আজকাল দেখা যায় না , সে হয়তো নিরুৎসাহিত হয়ে সরে পড়ছে। ওর সঙ্গে আমার মাখা মাখির জন্য এই সমস্যা হয়েছে। বাসার সবাই আমাকে অবিশ্বাস করে। রিক্সাওয়ালা বাড়ির গেটে এসে বলে আপা নামেন। আমি এতক্ষন তাহলে কি স্বপ্নের রাজত্বে বিচরণ করেছি ?
আজকাল আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি । রিক্সাওয়ালা বিদায় করে গেট খুলে দেখি সীমা আন্টি এখনো আমার জন্য অপেক্ষা করছেন । আমার ইচ্ছা হয় না সামনে যেতে, আমি কি গেট খুলে দৌড়ে পালাবো?
এই যে সীমা আন্টি হাসতে হাসতে আমার দিকে আসছেন । কেমন আছো, সাকিলা?
আমি ভালো, আপনি কেমন?
উত্তেরের অপেক্ষা না করে সাকিলা নিজের ঘরে ঢুকে, কাপড় ছেড়ে কয়েক মিনিট বসে থেকে হাত মুখ ধুয়ে বাহিরে এসে দেখে আবিদের আম্মু ও ওর জন্য অপেক্ষা করছে। সে কিছু না বলে নিজের ঘরে গিয়ে বসে থাকে। রেবেকা ঘরে গিয়ে বলে আমি ও তোর আব্বু ওদের বুঝিয়ে বলেছি তোর এখন বিয়ের মত নেই। তুই কিচ্ছু বলবি না, কেবল গিয়ে ওদের সঙ্গে এক কাপ চা খাবে। ঠিক আছে এই বলে সাকিলা দুই হাত দিয়ে চোখ মুছতে থাকে। রেবেকা বলে তুই নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে এসে বসে থাক। সাকিলা আর একবার বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে মিরর দিয়ে নিজেকে দেখে আস্তে করে ড্রয়িং রুমে ঢুকে সালাম দিয়ে ওর আম্মুর পার্শে বসে। আবিদের আম্মু এসে সাকিলাকে চুমু খেয়ে বলে ,” তোমাকে আমরা অনেক পছন্দ করি । তুমি আমাদের ফিরিয়ে দিও না। সাকিলা কিছু না বলে নিচের দিকে চেয়ে থাকে। ওরা ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ১০ মিনিটের মতো বসার পর সীমা বলে আচ্ছা তুমি তোমার ঘরে যাও। ও উঠে তার রুমে গিয়ে বেডে শুয়ে পড়ে । ওরা কিছু সময় আলাপ আলোচনা করে বলে ওর পরীক্ষার রেজাল্ট পয্যন্ত দেখেন এবং একটু সময় দেন এই বলে চলে যায়। রেবেকা ওদের গেট পয্যন্ত এগিয়ে বিদায় দিয়ে ঘরে ঢুকে। সাকিলা ভাবে ভাগ্গিস আমি আরিফকে বাসায় আসতে বলিনি ।
সন্ধ্যার পর রহমান ও রেবেকা টেলিভশন দেখার সময় সাকিলা তার রুম থেকে এসে বলে আজ নিউস পেপারে সরকারি কলেজে টিচার নেবে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে । আমি দরখাস্ত দেব । রহমান বলে ঠিক আছে দাও ।
কাজের মেয়ে টেবিলে রাতের খাওয়া দিয়ে বলে খেতে আসেন । রেবেকা জিজ্ঞেস করে তুই সকালে কিছুই খাস নি এবং দুপুরে ও খেতে আসলি না । আম্মু আমি সকালে যাওয়ার পথে রেস্টুরেন্ট থেকে নাস্তা নিয়েছি এবং শরীর ভালো না থাকায় দুপুরে বাসায় না এসে রেস্টুরেন্ট থেকে রুটি আর সবজি নিয়ে খেয়েছি । রেবেকা বলে খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম করলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে । রাতের খাওয়ার পর সবাই ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসে টেলিভশন দেখে যার যেই রুমে চলে যায় ।
আজিজ স্কলারশিপ নিয়ে শিকাগো ইউনিভার্সিটি, USA গত সপ্তাহে চলে গেছে। মজিদ ভালো চাকুরী করে , রেনুকে পছন্দ করে বিয়ে করেছে । রেনুকে বাসার সবাই পছন্দ করে এবং তাদের পছন্দ অনুসারে ছোট খাটো করে অনুষ্ঠান করেছে ।
রেবেকার শরীর ভালো যাচ্ছে না । ডাক্তার আজমল মাঝে মধ্যে এসে দেখে যায় এবং কিছু টেস্ট করার জন্য বলেছেন । সাকিলা বলে তুমি অবসর নিয়েছো ,এখন আরাম করো, দুইজনে বাসায় থাকো এবং বাসা দেখো। খামাকা আমাকে নিয়ে চিন্তা করে অসুস্থ হওয়ার দরকার নেই । রহমান বলে ঠিক আছে মা তুমি যেভাবে ভালো মনে করো।
আজ আমার অনেক হালকা লাগে। এই কয়েক মাস আমার ঘুম হতো না। আজ আমার ঘুম হবে। কাজের মেয়ে মশারি খাটিয়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে যেন কত দিন না ঘুমিয়ে ছিল । রাতে এক দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে যায়। সে কাঁপতে থাকে এবং অতিরিক্ত পানির পিপাসা পেয়েছে। মেয়ে টেবিলে পানি ও গ্লাস রেখেছে এবং দরজা ভিজিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার মনে হইতেছে কেউ তাকে রাতে গলা টিপে মেরে পেলতে ছিল। সে ঘুম থেকে উঠে পানি খেয়ে চারিদিকে দেখে নিয়েছে এবং বিছানার নিচে দেখে পুনরায় শুয়ে পড়েছে। কিন্তু না কিছুতেই ঘুম আসতেছে না। মনে হয় কেউ যেন বাহিরে হাঁটা হাঁটি করতেছে এবং পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে । এ দিকে বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে,হালকা বাতাসের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে ।
সাকিলা ঘরের আলো নিবিয়ে পুনরায় ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে । কিন্তু ঘুম আসে না। হঠাৎ শুনে জানালায় ঠক ঠক আওয়াজ হচ্ছে। সে চিৎকার করে বলে কে কে ? কিন্তু কোনো আওয়াজ নেই। পাশের ঘর থেকে রেবেকা এসে বলে সাকিলা !সাকিলা ! সে বলে, হুঁ। কি হয়েছে বল আমাকে ?
না, কিছু হয় নি । আমাকে বল কি দেখে ভয় পেয়েছিস?
আম্মু আমি শুনি কে যেন জানালায় ঠক ঠক আওয়াজ করছে । এত রাতে কে আওয়াজ করবে?
বাহিরে বৃষ্টি এবং ধমকা বাতাস বইতেছে ।
তথাপি রহমান বিল্ডিং এর চারি দিকে ঘুরে এসে বলে আমি কিছু দেখছি না। তবে বৃষ্টি হচ্ছে এবং তার সঙ্গে হালকা বাতাস। হয়তো বাতাসে দরজা জানালায় আওয়াজ হচ্ছে। রেবেকা বলে ঠিক আছে আমি তোর কাছে ঘুমাবো। সাকিলা বাকি রাত মাকে জড়িয়ে ধরে ছোট বাচ্চার মতো ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে রেবেকা বলে তুই আজ স্কুলে যাস না । না আম্মু, আমার শরীর ভালো লাগছে, আমি স্কুলে যাবো । তাহলে দুপুরে ছুটি নিয়ে ঘরে চলে আসবি । ঠিক আছে আমি ঘরে এসে লাঞ্চ করবো।
রেবেকা বলে ও কেন ভয় পেলো আমার ভালো লাগছে না। রহমান বলে আরও দুই চার দিন যাক দেখি হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।
(ক্রমশ)