আজিজ তিন বৎসরের MBA করার জন্য শিকাগো ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা গিয়েছে । সীমিত আয়ের স্কলারশিপ যা দিয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরানো অবস্থার মধ্যে সে রয়েছে । প্রথম ৬ মাস কাজের কোনো অনুমতি পায়নি । গত এক বৎসর ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে পার্ট টাইম কাজ করে । এত কঠোর পরিশ্র্রম যা করতে গিয়ে প্রথম দিকে সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাও রেস্টুরেন্ট থেকে ঠিক ভাবে তার পাওনা দেয়া হয় না । একটা প্লেট ভাঙলে এক ডলার কেটে রাখে। শুক্র,শনি এবং রবি এই তিন দিন কাজ করে । বাকি চার দিন ক্লাস করতে হয় এবং গত সেমিস্টারে কয়েকটি সাবজেক্টে সে মার্ক্স্ কম পাওয়াতে ডিপার্টমেন্ট থেকে ওয়ার্নিং দেয়া হয়েছে যে পরবর্তী সেমিস্টারে ভালো না করলে, স্কলারশিপ বন্ধ হয়ে যাবে ।
ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে কাজ করতে গিয়ে সে আজগুবি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। ১০০ পাউন্ডের আলুর বস্তা বেসমেন্ট থেকে কাঁধে করে কিচেনে আনতে হয়। রাত ২টা পয্যন্ত কাস্টমার সার্ভিস শেষ করে পুরা রেস্টুরেন্ট,কিচেন, ওয়াশ রুম, কার্পেট, টেবিল, ফ্লোর পরিষ্কার ও ধোয়া মুছা করা । এ সব কাজ করতে গিয়ে সে কয়েক বার অসুস্থ হয়ে পড়েছে । সব চেয়ে কঠিন কাজ হলো ডিশ ওয়াশার মেশিনে থালা বাসন পরিষ্কার করা। সে একজন লোক গেস্ট রুম, কিচেন হেল্প, ডিশ ওয়াশার , অবিরত বাস্কেট ভর্তি ডিশ নিয়ে আসে যা আজিজকে দিয়ে পরিষ্কার করানো হয়ে থাকে। কয়েকবার বাস্কেট হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে ফেলে এবং মালিক ১০ ডলার করে কেটে নিয়েছে।
এ নিয়ে তার রুম মেট পিটার এর সঙ্গে আলাপ করলে সে বলে আমি যে গ্রিক রেস্টুরেন্টে কাজ করি সেখানে তোমাদের দেশের ফ্লোরা নামে একটি মেয়ে ওয়েট্রেস হিসাবে সপ্তাহে দুই দিন কাজ করে। ওটা অনেক বড়ো রেস্টুরেন্ট, তুমি চাইলে আমি ফ্লোরার সঙ্গে কথা বলে দেখবো, যদি তাদের গেস্ট রুমে তোমাকে লাগিয়ে দিতে পারে।
তুমি কি নিশ্চিত যে সে বাংলাদেশি?
হ্যাঁ, সে আমাকে তাই বলেছিলো। সে বলেছিলো যে সে ঢাকা শহরের মেয়ে। সে ইকোনমিক্স নিয়ে আমাদের উনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করে। তাহলে,তুমি একবার আলাপ করে দেখতে পার। পিটার একদিন কাজে গিয়ে বলে ফ্লোরা তোমাদের ঢাকার একটা ছেলে MBA করে। সে এক জায়গায় কাজ করে, কিন্তু তার কাজ পছন্দ হয় না। তুমি কি ওকে ওয়েটার হিসাবে ঢুকাতে পারবে?
ফ্লোরা বলে আমি ম্যানেজারকে বলে দেখতে পারি, যদি কোনো শূন্যপদ থাকে বা হয় জানাবো ।
দেখো তোমাদের দেশীয় ছেলে অসুবিধায় আছে।
ঠিক আছে, আমি ম্যানেজারকে বলে দেখবো।
ফ্লোরা এক পর্যায়ে ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করে আমাদের গেস্ট রুমে কোনো লোক কি দরকার আছে ?
ম্যানেজার বলে কার জন্য ?
আমার এক ফ্রেন্ড কাজ করতে চায়। ঠিক আছে কালকে নিয়ে এস, আমরা ওকে দেখবো,যদি পছন্দ হয় ট্রেন – আপ করবো। ফ্লোরা বলে পিটার তোমার বন্ধু খুব ভাগ্যবান, এখানে কাজ হবে, তুমি ওকে কাল নিয়ে এস। আচ্ছা ঠিক আছে আমি কাল ওকে নিয়ে আসবো।
রাতে কাজ থেকে ফিরার পর পিটার বলে, তোমার ভাগ্য ভালো, তোমার দেশীয় ফ্লোরা বলেছে কালকে তোমাকে যেতে। ওরা পছন্দ হলে তোমাকে ট্রেন-আপ করবে। ঠিক আছে আমি যাবো। পর দিন কাজে গিয়ে পিটার বলে ফ্লোরা আমি তোমাদের দেশীয় ছেলেকে এনেছি ।
সে কোথায়?
সে ওয়েটিং রুমে আছে। ফ্লোরা তার ম্যানেজারকে বলে তুমি বলেছিলে আমি ওকে এনেছি । ঠিক আছে চলো, ওকে দেখি। ওরা দুই জন্যে গিয়ে আলাপ করে, ম্যানেজার বলে তুমি ফ্লোরার সঙ্গে কাজ করবে। ইচ্ছা করলে আজ থেকেও শুরু করতে পারো ।
ওকে পুরা শিফট কাজ করিয়ে বলে তুমি আজ থেকে পয়সা পাবে , কাল থেকে তুমি আমার সঙ্গে কাজ করবে। আজিজ প্রথম দিকে কি ভাবে টেবিল সার্ভ করতে হয় ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে শিখেছে। ফ্লোরা বলে তোমাকে শিখানোর মতো কিছুই নেই। সে বলে আমি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে অনেক দিন কাজ করেছি এবং কিচেন থেকে আরম্ভ করে কাস্টমার সার্ভিস ও অন্যান্ন সব কাজই কিছু কিছু শিখেছি। ফ্লোরা বলে এটা বাংলাদেশ নয়, এখানে টিকে থাকার জন্য সব কাজই জানতে হয়। কাজ করলে পয়সা আসে। এ ভাবেই আজিজ ফ্লোরার সঙ্গে পরিচিত হয়।
ফ্লোরার বাবা ডাক্তার শাহরিয়ার ও মা ডাক্তার রৌশনারা ,ঢাকা বনানীর বাসিন্দা।ফ্লোরা চিটাগাং ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতি নিয়ে ভালো ভাবে পাশ করাতে তার বাবা মা ওকে আরো পড়াশুনার জন্য শিকাগো পাঠায় এবং সে ইউনিভার্সিটি থেকে স্কলারশিপ পেয়েছে।
ফ্লোরা ডোমে আর একটি চাইনিজ মেয়ে লি ফেং এর সঙ্গে একত্রে থাকে, ওরা দুই জন-ই ভালো বন্ধু । লি ফেং সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়া শুনা করে। ওর বাবা মা পিকিং এ সফটওয়্যার ব্যাবসায়ী। লি ফেং পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরে যাবে এবং নিজেদের ব্যবসা দেখা শুনা করবে। সে ফ্লোরাকে খুব পছন্দ করে আর করবে না কেন ?
ফ্লোরা মা বাবার অতি আদরের মেয়ে যাকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশুনা করিয়ে উনিভার্সিটিতে পাঠিয়েছে। সে অতি সুদর্শনা, স্মার্ট, ভালো ছাত্রী, সব সময় ভালো রেজাল্ট করেছে । মা বাবা দুইজনই ডাক্তার এবং জীবনে কোনোদিন অভাব দেখে নি। মা বাবা ফ্লোরাকে ডাক্তারি পড়াতে চেয়েছিলো। কিন্তু সে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশুনার আগ্রহ ,সে জন্য মেয়েকে বাধা না দিয়ে সাহস দিয়েছে।
লি ফেং ভালো ইংরেজি বলতে পারে না , তবে ম্যাথ এবং সায়েন্সে অত্যধিক ভালো। ফ্লোরা জানে কি ভাবে বন্ধু বানাতে হয়। গত বৎসর সে লি কে ঢাকা নিয়ে এসে এক সপ্তাহ ঢাকা, কক্স বাজার ঘুরিয়ে পিকিং পাঠিয়েছে। পিকিং যাওয়ার সময় বাংলাদেশের কত কি সুন্দর সুন্দর এটা সেটা গিফট ওর মা বাবা ও ভাইয়ের জন্য দিয়েছে।
ফ্লোরা ও লি সেকেন্ড ইয়ার উঠে ডোম ছেড়ে দিয়ে ইউনিভার্সিটি পাড়ায় ওয়াকিং ডিস্টেন্সের মধ্যে একটা ছোট্ট বাসা নিয়েছে। ওদের কোনো বাহিরের বন্ধু নেই এবং দুই জন-ই ইউনিভার্সিটি আর লাইব্রেরি নিয়ে ব্যস্ত । ফ্লোরা ও লি দুই জনে জাস্ট ফর ফান কয়েক ঘন্টা এই গ্রিক ডিনার রেস্টুরেন্টে ওয়েট্রেস হিসাবে কাজ করে। লি ও ফ্লোরা দুইজনে আজিজকে কাজে সাহায্য করে এবং সব সময় ওর কাজ ধরে রাখার জন্য স্বচেষ্ট থাকে। লি ও ফ্লোরা বলে এ দেশের মানুষ কারো চেহেরার দিকে না তাকিয়ে হাতের দিকে তাকায়। হাত যত বেশি ফাস্ট চলে , ততই দক্ষ মনে করে।
আজিজ বলে ফ্লোরা ও লি আমি তোমাদের সাহায্য পেয়েছি , তবে কাজ ধরে রাখার জন্য আমাকে স্বচেষ্ট হতে হবে এবং পরিশ্রম করতে হবে।
লি বলে আজিজ তুমি কি সপ্তাহের যে কোনো দিন কাজ করতে পারবে?
না,আমি উইকএন্ডের বেশি কাজ করতে পারবো না, কারণ আমি পড়াশুনা করে নিজেকে উনিভার্সিটিতে টিকে রাখতে চাই ।
লি বলে ,ঠিক আছে ওদের অন্য লোক আছে।
আজিজ বাসা বদলিয়ে আরো দুটি ছেলের সঙ্গে শেয়ার করে থাকে। তাদের দুই জনই ইরানিয়ান ফারজাদ ও ফাহাদ রান্না ও ঘর পয় পরিষ্কারে বেশ পটু । সবাই কাজ করে পড়াশুনা করে । আজিজ বাংলাদেশি খাবার তৈরী শিখিছে এবং ইরানিয়ানরা রুটি ও মাংস বেশি খায় । তাছাড়া যেহেতু সবাই রেস্টুরেন্টে কাজ করে অনেক সময় খাওয়া এনে শেয়ার করে ।
ছোট্ট তিন বেড রুমের বাসা ১০ মিনিট হাঁটলেই উনিভার্সিটিতে যাওয়া যায় । এ দেশে ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে । যে কোনো সময় লাইব্রেরি গেলে মনে হয় যেন লোকে লোকারণ্য । সবাই যার যেই কম্পিউটার, ইন্টারনেটে ও বই নিয়ে পড়াশুনায় ব্যস্ত । তাছাড়া ২৪ ঘন্টা রেস্টুরেন্ট, কফি শপ খোলা এবং ছেলে মেয়েরা খাওয়া দাওয়া করে । আজকাল আজিজ, ফ্লোরা ও লি সব সময় একত্রে লাইব্রেরি ওয়ার্ক করে এবং ২-৩ ঘন্টা কাজ করার পর একত্রে বিরতি নিয়ে অরেঞ্জ জুস, ম্যাংগো জুস অথবা চা, কফি এবং তার সঙ্গে যার যা খুশি মাফিন, ব্রেড বা অন্য কিছু নিয়ে খেয়ে বা গল্প করে পুনরায় লাইব্রেরিতে ঢুকে । কম্পিউটার ল্যাব ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে, অনেকে এসাইনমেন্ট সাবমিট করে দিন বা রাতে তার সময় মতো । এ ভাবেই এরা মিলে মিশে পড়া শুনা করে । আজিজ লাজুক ধরণের ছেলে, সে কখনও ওদের সঙ্গে বাড়তি কথা বলে না ।
অনেক সময় আমেরিকার ইউনিভার্সিটি গুলিতে আমাদের দেশ থেকে আসা ছেলে মায়েদের ইংরেজি ভাষা নিয়ে সমস্যা হয় । আমাদের দেশের উনিভার্সিটিতে পড়াশুনা নিজস্ব ভাষায় হয় যে জন্য ওরা বিদেশে পড়াশুনার উদ্দেশ্যে আসতে চাইলে ইংরেজি ভালো ভাবে পড়তে হয় এবং IELT টেস্ট দিয়ে ভালো স্কোর করতে হয় । এতে করে ছেলে মেয়েদের সময় বেশি লাগে । আজিজ দেশে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশুনা করেছে, তাছাড়া সে অ্যাডভান্সড পড়াশুনা করেছে যে জন্য ভাষা নিয়ে কোনো সমস্যা হয় নি । ফ্লোরা ইংলিশ মিডিয়ামে এ লেবেল করেছে এবং ইউনিভার্সিটি জীবনে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশুনা করেছে, তার ও কোনো অসুবিধা হয় নি ।
আজিজের আম্মু রেবেকা অনেক দিন থেকে অসুস্থ । আম্মুর কথা মনে পড়লেই ওর দু চোখ দিয়ে আপনা আপনি জল এসে যায় । সে কিছু পয়সা জমিয়েছে এবং তিন সপ্তাহের জন্য আম্মুকে দেখতে বাংলাদেশে ছুটিতে যাবে বলে ঠিক করেছে । কিন্তু রহমান ও রেবেকা নিষেধ করেছে এবং বলে তুমি পড়াশুনা শেষ করে একবারে চলে এস । অযথা ডলার খরচ করে আসা ঠিক হবে না । রেবেকার ভয় ও দেশে এসে আমার অবস্থা স্বচক্ষে দেখলে হয়তো আর ফেরত যাবে না ।কিন্তু আজিজ বলে আম্মু আমি তিন সপ্তাহের জন্য তোমাকে দেখতে আসবো । সাকিলা বলে ভাইয়া তুমি তো জানো যে আম্মু অসুস্থ এবং কিমো নেয়াতে মাথার চুল উঠে গেছে । তুমি আম্মুকে দেখে মন থেকে ভেঙে পড়বে, সে জন্য আমরা চাই না যে তুমি এসে মন খারাপ ও কান্না কাটি করো । তুমি পড়াশুনা শেষ করে আসলে , ওই সময়ের মধ্যে হয়তো আম্মু সুস্থ হয়ে উঠবে এবং ভালো লাগবে। আজিজ বলে না আমি আসবো, টিকেট বুকিং দিয়েছি ।
ফ্লোরা বলে আজিজ তুমি কবে দেশে যেতে চাও?
আমি এখনও টিকেট কন্ফার্ম করিনি , তবে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে যাবো বলে ভাবছি ।
আমি তোমাকে কিছু গিফট কিনে দিতে চাই ,তুমি কি নিতে পারবে?
আমার লাগেজ একটা ও ভর্তি করতে পারবো না । আমি দুইটা লাগেজ নিতে পারি, তুমি ইচ্ছা করলে একটা লাগেজ ভর্তি করে যা যা দরকার দিতে পারো ।
ফ্লোরা বলে ঠিক আছে আমি একটা লাগেজ ভর্তি করে তোমাকে দেব ।
দেশে যাওয়ার দুই দিন পূর্বে, ফ্লোরা একটা লাগেজ ভর্তি করে বলে আমার লাগেজটা তোমাকে দেখিয়ে দিতে চাই । ফ্লোরা গিফটের লিস্ট তৈরী করে একটি একটি করে দেখিয়ে বলে এ গুলি সবই সাকিলা, দিনা, রেনু ও বাবা রহমান সাহেবের জন্য কেনা হয়েছে এবং সামান্য কয়েক টি আইটেম ফ্লোরার পরিবারের জন্য দিয়ে বলে তুমি আব্বু আম্মুর সঙ্গে দেখা করে দিয়ে আসবে । আজিজ বলে তুমি সবই আমার পরিবারের জন্য কেন কিনেছো?
ফ্লোরা বলে আমার মনে চাইলো তাই কিনে দিলাম, তোমার কোনো আপত্তি আছে কি?
আপত্তি নাই ,তবে অবাক হয়েছি ! তুমি আমাকে কেনার আগে জিজ্ঞেস করলে হয়তো না করতাম । আমি জানি,সে জন্য জিজ্ঞেস করি নি । আজিজ এক দৃষ্টিতে ফ্লোরার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে তুমি এত ভালো মানুষ, আমি জানতাম না । ফ্লোরা বলে,দুনিয়াতে অনেক ভালো মানুষ আছে যারা পরের জন্য কিছু করার মধ্যে আনন্দ পায় । আজিজ অনেক দিন থেকে মনে মনে ফ্লোরাকে ভালোবাসে, কিন্তু বলার সাহস পায় নি, ফ্লোরাকে জড়িয়ে ধরে বলে , ” আমি তোমাকে ভালো বাসি ।” ফ্লোরা বলে,”আমিও” ।
সকালে আজিজ শিকাগো এয়ারপোর্ট টার্মিনালে যাবে। বাসার নিকটেই সাবওয়ে । শিকাগো শহর থেকে অতি সুন্দর সাব ওয়ে ট্রেন ব্যবস্থা এয়ারপোর্ট যাওয়ার। সে ও ফ্লোরা দুইটা লাগেজ টেনে টেনে নিয়ে ট্রেনে উঠে এয়ারপোর্ট টার্মিনালে গিয়ে উপস্থিত । ওরা প্লেন ছাড়ার তিন ঘন্টা পূর্বে লাগেজ বুকিং দিয়ে এয়ারপোর্ট কফি শপে বসে দুই কাপ কপি নিয়ে গল্প করে এক সময় আস্তে আস্তে সিকিউরিটি গেটে আজিজকে বিদায় দিতে গিয়ে দুই জনে একে ওপরের চোখে চোখে চেয়ে থাকে । আজিজ ফ্লোরাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে । ফ্লোরা বলে সেফ জার্নি । আজিজ সিকিউরিটি পার হয়ে হাত উঠিয়ে ফ্লোরাকে বিদায় জানিয়ে চেকিং পয়েন্ট পার হয়ে এগোতে থাকে । ভিতরে লাউঞ্জে আরো ৪৫ মিনিট বসে থাকতে হবে ।
সে ফ্লোরাকে ফোন করে বলে তুমি কোথায়?
ফ্লোরা বলে আমি ট্রেনে বাসার দিকে রওয়ানা হয়েছি । আজিজ বলে আমাকে আরো খানিক লাউঞ্জে বসে থাকতে হবে । কপি শপ থেকে আর একটা অরেঞ্জ জুস নিয়েছি । আরও দুইটা বাঙালি পরিবারের সঙ্গে দেখা হয়েছে । ওরা ও ঢাকা যাবে । ফ্লোরা বলে, খুব ভালো সময় কাটবে । ঠিক আছে ছেড়ে দেই, গেট খুলে দিয়েছে, সবাই প্লেনে উঠতেছে । ফ্লোরা বলে খোদা হাফেজ । সে আস্তে আস্তে আরব আমিরাত প্লেনে ঢুকে উইন্ডো সিট নিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে ভাবে হয়তো ফ্লোরা এখন বাসায় পৌঁছে গেছে । আজ তার মনে হলো ফ্লোরা ছাড়া এখানে আমার আর আপন জন কেউ নাই । আজিজের দুই চোখে ফ্লোরা অতি সুন্দর হয়ে দেখা দিয়েছে ।
পাশের সিটে একজন ইন্ডিয়ান ভদ্র লোক এসে বসেছে,সে দুবাই হয়ে বোম্বে, ইন্ডিয়া যাবে । আলাপ পরিচয় করে জানা যায় যে এই লোক বিদেশি জাহাজ থেকে নিউ ইয়র্ক নেমে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান এর সময় এগ্রিকালচার ফার্মার হিসাবে কাজ দেখিয়ে এ দেশের গ্রীন কার্ড নিয়েছে । ১৯৮৬-১৯৮৭ সনের দিকে প্রেসিডেন্ট রেগান জেনারেল অ্যামনেস্টি দিলে লক্ষ লক্ষ বেআইনি লোক এই সুবিধা নিয়ে গ্রীন কার্ড বানায় । সে বলে এ দেশে যারা পড়াশুনার জন্য আসে তারা সাধারণত কাগজ না তৈরী করে ফেরত যায় না । America is a land of opportunity । এখানে পড়াশুনা শেষ করার পর কাজ পেয়ে যাবে এবং কয়েক বৎসর থাকলে রেসিডেন্সি ও পাবার সম্ভাবনা আছে । তুমি অনেক পড়াশুনা জানা লোক, তোমার জন্য এখানে কাজ পাওয়া কঠিন হবে না । আজিজ বলে দেখা যাক কি হয় ।
এয়ার হোস্টেজ এর মধ্যে এসে দুপুরের খাওয়া দেয়া শুরু করেছে ।
খাওয়া শেষ করে আজিজ টেলিভশন খুলে ওর পছন্দের ইন্ডিয়ান মুভি দেখছে। প্লেন চলছে একটানা এবং মাঝে মাঝে ধমকা বাতাসের সতর্কতা দিচ্ছে সিট বেল্ট বাধার জন্য । হোস্টেজ দৌড়াচ্ছে এবং বলতেছে সিটবেল্ট বাধার জন্য । আজিজ টেলিভিশন অফ করে চোখ বন্ধ করে ঘুমাতে চেষ্টা করছে । কিন্তু ইকোনমি ক্লাসে সিটগুলি এত কনজেস্টেড যে নড়া চড়ার কোনো সুযোগ নেই । সামনের প্যাসেঞ্জার সিট দাবিয়ে আরাম করে শুয়ে পড়েছে এবং এতে তার নড়া চড়া কষ্ট হচ্ছে । সে যতই সামনের সিট সরাতে চেষ্টা করছে, কাজ হচ্ছে না। সে হোস্টেজকে অনুরোধ করেছে সামনের সিট সরাতে । এতে কিছুটা কাজ হয়েছে, সে কিছুটা আরাম পাচ্ছে । কিন্তু প্লেন ভ্রমণে কি আর ঘুম হয়?
এতো ব্যর্থ প্রচেষ্টা এবং সে তাকিয়ে দেখে তার পাশের লোক আরামচে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে । আবার কখনও কখনও ডানে বামে ফিরে ঘুমাইতে চেষ্টা করছে । পেছনে দুইজন জোরে জোরে কি সব কথা বলতেছে, ” টেলিফোনে পোলা এইডার মাত হুইন্চি , চোহে দেখি নি , অহন দেশে যাইতাছি, যদি হছন্দ হয় … । ”
দুবাই এয়ারপোর্টে তিন ঘন্টা বিরতির পর পুনরায় আমিরাতের প্লেনে উঠে সিট নিয়ে বসবো । সমস্ত বাংলাদেশি ঢাকা যাচ্ছে , প্লেনে তিল ধারনের জায়গা নেই ।
লম্বা জার্নি শেষে করে ঢাকা এয়ারপোর্টে পৌঁছার পর ইমিগ্রেশন ও কাস্টম ক্লিয়ার করতেই দুই ঘন্টা লেগে গেলো । বের হয়ে দেখি সাকিলা ও আব্বু আমাকে রিসিভ করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে । আব্বু আমাকে জড়িয়ে ধরে ইমোশনে কেঁদে ফেলে,বলে কেমন আছিস?
সাকিলা বলে ভাইয়া তোমার শরীর আগের চেয়ে সুন্দর হয়েছে । ওরা দুই জনেই আমার লাগেজ নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । বাসায় পৌঁছার পর রেবেকা আজিজকে দেখে অনেক কষ্টে নিজের ইমোশন কন্ট্রোল করে বলে লম্বা জার্নি করে এসেছিস, কাপড় ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নিয়ে আরাম কর,পরে কথা বলবো । আজিজ আম্মুকে দেখে মন খারাপ করে বলে, আম্মু তুমি অনেক দুর্বল হয়ে গেছো । না , আমি ঠিক আছি, তুই আমার জন্য চিন্তা করিস না । সাকিলা লাগেজ দেখে বলে ভাইয়া মনে হয় তুই অনেক জিনিস এনেছিস । আজিজ মনে মনে হাঁসে এবং বলে চল বাসার খাওয়া অনেক দিন মিস করেছি ।
হাসু এই বাসায় অনেক দিন থেকে আছে । আজিজ হাসু ও তার মা বাবার জন্য কিছু গিফট এনেছে এবং ওটাই আগে দেবে বলে ভাবছে, সে আম্মুর যথেষ্ট যত্ন করে । সাকিলা টেলিফোন করে বলেছিলো ,” তুই কারো জন্য কিছু না আনলেও হাসুর জন্য কিছু আনতে ভুল করবি না । এই মেয়ে আম্মুর অনেক যত্ন করে । সে পুরা বাসার কাজ করে, আমরা সে হিসাবে তাকে কিছুই দেই না । ”
রাতের ডিনারের পর সাকিলা লাগেজ খুলে প্রথমেই হাসু ও তার মা বাবার গিফট তার হাতে দিয়ে বলে এগুলি তুমি নিজে ও তোমার মা বাবাকে দেবে । কিছুক্ষনের মধ্যে ফ্লোরা টেলিফোন করে এবং সাকিলা টেলিফোন উঠিয়ে বলে হ্যালো । ফ্লোরা সালাম দিয়ে বলে আজিজ কি ঠিক ভাবে পৌঁছেছে?
সাকিলা বলে ,হ্যাঁ।তুমি ধরো আমি ভাইয়াকে ডেকে দেই । আজিজ বলে আমি জার্নি সিক, তবে ঠিক ভাবে পৌঁচেছি । আমি কাল বা পরশু তোমাদের বাসায় যাবো , তোমার দেয়া গিফট বাসার সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছি । রেবেকা বলে দেখি ফ্লোরার সঙ্গে কথা বলবো । ফ্লোরা সালাম দিয়ে বলে আন্টি তুমি কেমন আছো?
আছি এক রকম , তুমি এতো জিনিস আমাদের জন্য দিয়েছো । আন্টি ও কিছুই না, আপনারা ভালো থাকেন । ফ্লোরা টেলিফোন রেখে দেয় ।
পর দিন আজিজ কোথায় ও যায় নি, সারা দিন বাসায় রেস্টে থেকে আম্মুর খোঁজ খবর নিয়েছে । আজিজ বলে আমাকে আরও দুই বৎসর পড়াশুনা করতে হবে । একটা সেমিস্টারে আমি ভালো করতে পারি নি । ডিপার্টমেন্ট থেকে আমাকে ওয়ার্নিং দিয়েছে । কিন্তু পরের সেমিস্টারে আমি অত্যধিক ভালো করেছি । রেবেকা জিজ্ঞেস করে তুই কি কারো সঙ্গে শেয়ার করে থাকিস?
হ্যাঁ, আম্মু আমি আরও দুইটা ইরানিয়ান ছেলের সঙ্গে শেয়ার করে থাকি । ওরা খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং আমাকে বাসায় বেশি কাজ করতে দেয় না । ফ্লোরা কত দূরে থাকে?
ও উনিভার্সিটির কাছেই আর একটা চাইনিজ মেয়ের সঙ্গে শেয়ার করে থাকে ।
ফ্লোরার মা রৌশনারা একজন গাইনির ডাক্তার এবং বাবা শাহরিয়ার প্রাইভেট প্রাক্টিশনার ।দুজনের চেম্বার তাদের বনানীর বাসার নিচের তলায় । শনি ও রবি দুই দিন তাদের ছুটি । আজিজ ছুটির দিনে কল দিয়ে ওদের বাসায় গিয়ে সালাম দিয়ে ফ্লোরার দেয়া গিফট পৌঁছে দেয় । ওর বাবা মা ওকে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে নিয়ে এন্টারটেইনমেন্ট করিয়ে বাসায় পৌঁছে দিয়ে চলে যাইতে চাইলে ও অনুরোধ করে বাসায় চা খাইয়ে বিদায় দেয়। ওরা যাওয়ার পূর্বে রেবেকাকে দেখে বলে ঠিকই চিকিৎসা নিচ্ছেন,ভালো হয়ে যাবেন ।
ক্রমশ :