পার্ট টাইম হলেও ডিপার্টমেন্ট ষ্টোরে কাজ করতে বেশ ভালোই লাগত। আমরা বিশজন কর্মচারী। তিনটে করে শিপট, এক এক শিপ্টে আমরা ছ’জন কাজ করতাম। আর এক ইটালিয়ান ভদ্রলোক ছিলেন ষ্টোরের ম্যানেজার। বছরখানিক পর দেখলাম, নতুন সাজ-সজ্জায় এবং সুন্দর ব্যবস্থাপনায় ষ্টোরের চেহারা সম্পূর্ণ বদলে গেল। বদলে গেল ক’য়েকজন কর্মচারী এবং ম্যানেজার। ভাবলাম, ষ্টোরের মালিক পুরোনো কর্মচারীদের বিদায় দিয়ে নতুন লোক হায়ার করছেন। কিন্তু মাসখানিক কেটে যাবার পরও তেমন কোনো নোটিশ আমরা পেলাম না। নতুন ম্যানেজারের মতিগতীও কিছু বোঝা যাচ্ছিল না। মনে মনে ভীষণ টেন্শনে থাকতাম।
একদিন হঠাৎ নতুন ম্যানেজার এ্যন্থনি লরেন্স আমাকে আর্জেন্ট ডেকে পাঠালেন। আমি তো শুনেই ঘাবড়ে গেলাম। একেই নতুন মানুষ। দরাজ গুরু গম্ভীর তার কন্ঠস্বর। যেমন দৈত্যের মতো বিশাল লম্বা চেহারা, তেমনি হ্যান্ডসাম, গৌরবর্ণের উজ্জ্বল সুদর্শণ মার্জিত পুরুষ। একবার চোখ পড়লে আর পলক পড়ে না। বেশ হৃদয়াকর্ষক চেহারা। অথচ তার সন্নিকটে গিয়ে দাঁড়ালেই গা কেঁপে উঠতো।
গেলাম মন্ত্রের মতো জপতে জপতে, এবার আমাকেও বোধহয় বিদায় করে দেবেন। এই আশংক্ষায় হৃৎস্পন্দনটা আরো দ্রুতগতীতে ধুক্ ধুক করতে থাকে। কিন্তু গিয়ে দেখি, অফিস ঘরের দরজাটা আলতোভাবে বন্ধ। ভিতর থেকে ভেসে আসছে মহিলা কন্ঠস্বর। হাসি-কলোতান। কখনো হাস্যরোলের ধ্বনী প্রতিঃধ্বনীত হয়ে বদ্ধ দরজা ভেদ করে বেরিয়ে আসছে বাইরে।
আমি থমকে দাঁড়াই। হতভম্ভের মতো হাঁ করে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি। মনস্থির করতে পাচ্ছিলাম না কি করবো। ভিতরে বেশ জমিয়ে আড্ডা চলছে, বোঝা যাচ্ছে। ডিষ্টার্ভ করাটা কি ঠিক হবে! নাঃ ফিরেই যাই, ভাবলাম মনে মনে। কিন্তু পরক্ষণেই স্বভাবসুলভ কারণে উক্ত মহিলাটিকেও স্বচোক্ষে দেখবার বড় কৌতূহল হলো, কে এই মহিলা! হাসির ফোয়ারায় একেবারে দেওয়াল কেঁপে উঠছে। রীতিমতো আড্ডাখানা তৈরী হয়ে গিয়েছে। পাড়ার ক্লাবঘরও হার মেনে যাবে।
মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে দরজাটা নক্ করে ঠেলে ঢুকে পড়লাম ভিতরে। ঢুকেই চমকে উঠি। স্তম্ভিত হয়ে যাই বিস্ময়ে। বোবার মতো নির্বাক দৃষ্টিতে হাঁ করে চেয়ে থাকি। -এ কি, আমাদের সহকর্মী লিলি যে! ও’এখানে কি করছে! ম্যানেজারের এতো ঘনিষ্ঠ হলো কবে থেকে! কথাবার্তাও তো বলতে দেখিনি কখনো! দু’জনেই নিউ কামার। মাসখানিক হলো মাত্র। ওকে একেবারে পশমাবৃত দুইবাহুতে আলিঙ্গন করে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দু’চোখের দৃষ্টি মেলে ম্যানেজার এ্যন্থনি আস্বাদন করছে, সৌন্দর্য্যরে পারিজাত লিলির বাঁধ ভাঙ্গা উত্তাল যৌবনের চমকপ্রদ রূপ, আর রং। একেবারে রোমিও-জুলিয়েটের মতো প্রেমলীলায় মশর্গুল দুজনে। আশ্চর্য্য, ওরা প্রেমে পড়ে গেল না কি! কিন্তু ম্যানেজার এ্যন্থনি একজন গণ্য-মান্য ব্যক্তি, তার এমন অভিরুচী? এই তার অভিব্যক্তির পরিচয়? বেহায়ার মতো একজন মহিলা কর্মচারীর সাথে অবৈধভাবে এধরণের বিহেইভ তার মোটেই শোভা পায় না। বললাম মনে মনে।
ইতিপূর্বে হাওয়ার গতীতে ছুটে বেরিয়ে গেল লিলি। লক্ষ্য করলাম, অপ্রস্তুত ম্যানেজার এ্যন্থনিও হঠাৎ আমার আগমনে থতমত খেয়ে গেল। নড়ে চড়ে বসে একটা ঢোক গিলে আমায় বললেন,-‘সরি ম্যাম, ভেরী বিজি নাউ। কাম লেইটার।’
-‘ও.কে স্যার।’ বলে দ্রুত অফিসঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়েই দেখি, একটু দূরে দাঁড়িয়ে লিলি। আহাল্লাদে যেন ফেটে পড়ছে। উচ্ছাসিত চোখে কিছু বলার ব্যকুলতায় প্রসন্ন চিত্তে দাঁতকপাটি বার করে নৈঃশব্দে মুখ টিপে হাসছে।
দেখে পিত্তি জ্বলে উঠল আমার। সর্বাঙ্গ রি রি করছে রাগে। একটু চক্ষু লজ্জাও নেই।
বার বার ক্ষণপূর্বের রোমান্টিক দৃশ্যটি মনঃশ্চক্ষে ভেসে উঠতে লাগল। কেমন নির্লজ্জ বেহায়ার মতো অসংযত অবস্থায় ম্যানেজার এ্যন্থনির পেশীবহুল বাহুদ্বয়ের উষ্ণ আলিঙ্গনে গভীরভাবে লিপ্ত হয়েছিল লিলি। হয়ত বা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এক গভীর রোমাঞ্চকর উন্মাদনায় মেতে উঠত দুজনে। তন্ময় হয়ে ডুবে যেতো, ক্ষণিক সুখের অতল গহ্বরে। হঠাৎ দরজাটা খুলতেই হকচকিয়ে গিয়েছিল প্রেমালিঙ্গনে বন্দিনী লিলি। ঝড়ের বেগে দ্রুত ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল বাইরে। এখন দেখছি, ওর দু’কানই কাটা। লজ্জা শরমের বিন্দুমাত্রও বালাই নেই।
পরদিন যথারীতি ষ্টোরে প্রবেশ করে কর্মচারী ডেভিট আর নাতাশার কানাঘূষোয় অবগত হলাম, লিলি শিপ্ট্ চেঞ্জ্ করেছে। মর্নিং-শিপটে কাজ করবে। ভাবলাম, তা’হলে তো ওর পোয়া বারো। আফটারনুনের আগে কাষ্টমারের খুব একটা ভীড় হয়না। বিকেল পর্যন্ত ফাঁকাই থাকে প্রায়। চলবে পুরোদমে অভিসার। চুটিয়ে প্রেম করবে দুজনে, রোমাঞ্চ করবে, আরো কত কি!
কিন্তু সেদিনের পর থেকেই দৃষ্টিগোচর হয়, ম্যানেজার এ্যন্থনির অভাবনীয় পরিবর্তন। যেন এক নতুন মানুষ। সারাদিন অন্যমনস্ক, উদাসীনভাব। কিসের চিন্তায় যেন ডুবে থাকে। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় না। একদম নরম হয়ে গিয়েছে। কথা বলছে অত্যন্ত ক্ষীণ শব্দে।
সাধারণত যুবতী রমণীরাই অনধিকার চর্চায় একটু মাথা ঘামায় বেশী। তেমনি কৌতূহলও। বিশেষ করে প্রণয়মূলক ব্যাপারে। কোনপ্রকারে ইঙ্গিত একটা পেলে আর কথা নেই, সত্য উদ্ঘাটন না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তিই পায় না কেউ। হঠাৎ বিনা নোটিশে রাতারাতি চব্বিশঘন্টার মধ্যে লিলির শিপ্ট্ পরিবর্তন, ম্যানেজার এ্যন্থনির মন-মানসিকতার পরিবর্তন শুধু বিস্ময়করই নয়, রীতিমতো রহস্যজনকও বটে। সন্দেহ ক্রমশই ঘনীভূত হতে থাকে আমার, ব্যাপারটা কি!
একদিন মুখোমুখি দেখা লিলির সাথে। আমি ঢুকছি, ও’ বের হচ্ছে। চোখে চোখ পড়তেই লিলি ফিক্ করে হেসে ফেলল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমিও অস্ফুষ্ট হেসে ফেলি। লিলি সুপ্রসন্ন হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। লজ্জা আর আবেগের সংমিশ্রণে চোখের তারাদু’টি ওর উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে উঠল। চেহারায় এতটুকু মলিনতার ছাপ নেই। একগাল অনাবিল হাসি ছড়িয়ে উৎফুল্ল হয়ে আমায় বলল,-‘হায়, হাউ আর ইউ? তুমি বাঙ্গালী আছো না?’
স্ববিস্ময়ে আমিও পাল্টা প্রশ্ন করলাম ওকে। উত্তরে ‘নেহি’ বলে হঠাৎ আমাকে চমকৃত করে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলতে থাকে। -‘হাঁ তোমার কোতার এ্যাক্সেন্টেই হামি বুঝে লিয়েচি। হাম্লোগ মারাঠি আছি। প্যায়দা হইচি কলকাত্তায়। বাংলা স্কুলে পাঁচ সাল পড়েছি। বহত দিন ছিলাম কলকাত্তায় মায়ের সঙ্গে। এখনও থোড়া থোড়া এয়াদ আছে সব। ভুলা নেহি।’
ওর কথা শুনে আমার কৌতূহল বেড়ে গেল। জিজ্ঞ্যেস করলাম,-‘ম্যানেজার এ্যন্থনি কে হয় তোমার?’
আনন্দে উৎফুল্ল উঠল লিলি। মনে হলো, এই প্রশ্নটির জন্যই অপেক্ষা করছিল। আহাল্লাদে গদগদ হয়ে একগাল অনিন্দ্য সুন্দর হাসি ছড়িয়ে বলল,-‘ও হামার রিলেটিভ্ আছে।’
জানতে চাইলাম ম্যানেজার ইন্ডিয়ান কিনা। কিছুক্ষণ থেমে চোখ মুখের বিচিত্র ইশারায় বলল,-‘জলদি যাও ব্যাহেনজী! উদেখো, ম্যানেজার সাহাব খাড়া হ্যায় উধার। ও জরুর ওয়াচ্ করছে।’
আমি তৎক্ষাণাৎ ঢুকে পড়লাম ষ্টোরে। কিন্তু যতক্ষণ কাজে ছিলাম, শুধু লিলির কথাই ভাবছিলাম। আধো আধো বাংলা বলছিল, দারুণ লাগছিল শুনতে। কিন্তু যতটা অনুমান করেছিলাম, ততটা খারাপ নয়। বেশ মিশুকে মেয়েটা। কথায় কথায় হাসে। সেইসঙ্গে কথাবার্তায় সরলতা আর আবেগের প্রবণতাও কম নয়। মানুষকে কনভিন্স করার অসাধারণ ক্ষমতা ওর। দেখে বোঝা যায় না। যা অত্যাশ্চর্য্যজনক ভাবে আমাকেও আবিষ্ট করে রেখেছিল। দেখতে খুউবই সুন্দরী। হরিণের মতো ওর আঁখিপল্লব। তীক্ষ্ন নাসিকা। বুদ্ধিদীপ্ত চোখের চাহনি। শ্বেতাঙ্গদের মতোই দুধসাদা গায়ের রং। টোলপড়া গোলাপ গালের বাঁ-পাশে ঝুলে আছে একগোছা কালো রেশমী চুল। চিবুকের উপরে বড় একটা কালো তিল। যেমন শরীরের গড়ন, কোমরের খাঁজ এবং নিখুঁত নিতম্ব, তেমনি যৌবন যেন ওর উপছে পড়ছে। প্রজাপতির মতো চঞ্চল, উচ্ছলতা এবং মায়ামৃগের মতো প্রাণবন্ত পদচারণায় দারুণ লাগে। নজর ফেরানো যায়না। আর ম্যানেজার এ্যান্থনির মতো একজন তরুণ সৌন্দর্য্যপ্রেমিক লিলির প্রেমজ্বালে বশীভূত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। শুধুমাত্র এ্যান্থনি কেন, যে কোনো পুরুষ মানুষকেই পলকমাত্র দৃষ্টিপাতে চুম্বকের মতো আকর্ষিত করবে, তাদের হৃদয় হরণ করবে।
কিন্তু প্রথম আলাপেই ওর সঙ্গে এমন বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে, তা কখনোই ভাবতে পারিনি। ভাবতে পারিনি, ওকে আমি অন্তর দিয়ে ভালোবেসে ফেলবো। ওর প্রতি আমার যে একটা খারাপ ধারণা জন্মেছিল, সেটাও নিমেষে বিনষ্ট হয়ে গেল।
সেদিনের পর থেকে প্রায়ই দেখা হতো লিলির সাথে। বন্ধুত্বের সৌজন্যে হায় হ্যালো বলে কুশল বিনিময় করা একটা রুটিন হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মধ্যে দেখতাম, লিলি বাড়িই যেতো না। ম্যানেজারের ব্যক্তিগত ফাই-ফরমাইশও ওকে খাটতে হতো। কোন কোনদিন গল্প করেই সময় কাটিয়ে দিতো। জীবনে অনেক সংগ্রাম করেছে। অতীতের ভাগ্যবিড়ম্বণায় পদে পদে অপদস্থ হয়েছে। দারিদ্রপীড়িত জীবনের সংঘর্ষে নানান বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে। বহু কষ্টও স্বীকার করতে হয়েছে। জীবনে অনেক কষ্ট করেছে। আজ সমস্ত বাঁধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে মঞ্জিল ওর হাতের মুঠোয়।
একদিন নোটিশ করলাম, অপ্রাসঙ্গিকভাবে বার বার স্বামীর প্রসঙ্গই টেনে আনছে। ওর স্বামীই আলচ্যের একমাত্র মূল বিষয়। যার প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ। শুধু জীবন দেবতাই নয়, ওর প্রাণপ্রতিম, প্রাণেশ্বর, প্রেমের পূজারী। যিনি প্রথম প্রেম নিবেদনে সহৃদয়ে লিলির স্বোয়াগত করেছিল হীরার নেক্লেস গলায় পড়িয়ে। খুউব রীচ ম্যান্, উচ্চবিত্ত খান্দানি বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারী। লা-জবাব, হ্যান্ডসাম্ ওর স্বামী। দুইখানা ফাইভ-ষ্টার হোটেলের মালিক। ফিল্ম-ষ্টারদের মতো চেহারা। যে কোনো মেয়েই প্রেমের পত্তন ঘটে ওর দেওয়ানা হয়ে যায়। কিন্তু লিলিই ওর স্বামীর একমাত্র ভালোবাসার ফুল। স্বামীর চোখের মণী। আর স্বামী ওর জান। যে ব্যক্তি পর নারীর মুখদর্শণ করা তো দূর, কখনো না কি তাদের ছায়াও স্পর্শ করেন না।
মনে মনে ভাবলাম, লিলি কি ভাগ্যবতী মহিলা। বিরল ওর সৌভাগ্য। কত সুখী ও’ জীবনে। এতবড় সৌভাগ্য ক’জনেরই বা হয়। চিন্তাই করা যায়না। কিন্তু লিলি যা বলছে, সত্যিই কি তাই! সত্যিই কি ওর স্বামী এতবড় রীচ্ ম্যান। ও’ যদি সত্যিই স্বামীর সোহাগী হয়, তা’হলে একজন পরপুরুষ ম্যানেজার এ্যন্থনির সাথে ওর এতো কিসের পিরিত! কিসের এতো ঘনিষ্ঠতা! আর কেন ইবা ম্যানেজার এ্যন্থনির সাথে ওর এতো গলাগলি, ঢলাঢলি।
ক্ষণিকের নিরবতায় লিলি বলল, -‘চুপ কিঁউ হো ব্যাহেনজী! কুছ তুম ভি শুনাও!’
ঈর্ষাণ্বিত হয়ে বললাম,-‘তোমাকে তো সোনার ফ্রেমে বেঁধে রাখা উচিৎ। এমন চাঁদ বদন তোমার, রৌদ্রের এমন প্রখড় উত্তাপে ঝলসে যাবে যে!’
-‘মজাক করছ!’
-‘তা’হলে তোমার চাকুরির কি দরকার? কিসের অভাব তোমার?’ আমি বললাম।
ঠোঁটের কোণে কৌতূকের হাসি ফুটিয়ে লিলি বলল,-‘আরে এয়ার, ওতো স্রিফ টাইম পাস করার জন্যে। অউর পুরাদিন ঘরমে এ্যকেলা ব্যয়ঠে ব্যয়ঠে কঁরুঙ্গি ভি ক্যায়া! বাল্ বাচ্চা তো হ্যায়ই নেহি!’
ওকে উৎসাহ দিয়ে বললাম,-‘কিঁউ হ্যায় নেহি! প্রটেক্ট্ দেওয়া বন্ধ করো, দেখবে জলদি বাচ্চা এসে যাবে!’
আবার সেই মুক্তঝরা হাসি লিলির। মশকরা করে কি যে বলে ফেললাম, হাসতে হাসতে ও’ একেবারে গায়ের ওপরেই ঢলে পড়ছে।
( দুই )
পেরিয়ে গেল ক’য়েক পক্ষকাল। সামনেই আসন্ন খ্রীষ্টমাস্। বড়দিন। ইংরেজী নতুন বছর। দৈনন্দিন জীবনের আনুষঙ্গীক প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে, বাচ্চা-বুড়ো-জোয়ান প্রতিটি মানুষ। প্রত্যেকের কেনা কাটাও চলছে পুরোদমে। ষ্টোরে পা ফেলার জায়গা নেই। কাষ্টমারের প্রচন্ড ভীড়। নিঃশ্বাস ফেলার সময়ই পাচ্ছিনা কেউ। ওদিকে লিলিও দু’দিন যাবৎ কাজে আসছে না। কোনো খোঁজখরব নেই ওর। গিয়ে যে ম্যানেজারকে কিছু জিজ্ঞ্যেস করবো, সে সাহসও পাচ্ছি না। কর্মচারীরা সবাই যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। হঠাৎই দেখি, লোকের ভীড় ঠেলে উত্তপ্ত মেজাজে অফিস ঘরের দিকে উর্দ্ধঃশ্বাসে হনহন করে এগিয়ে যাচ্ছে লিলি। অপ্রত্যাশিত হঠাৎ ওকে দেখে আমরা ষ্টোরের কর্মচারী সবাই বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। স্বাভাবিক কারণেই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল সেদিকে। নিজের কাজ ছেড়ে ওকে ওয়াচ্ করতে লাগলাম।
ইতিপূর্বে অফিস ঘরের দরজা বন্ধ দেখে পিছন ফিরতেই লিলির চোখে চোখ পড়ে গেল। ওকে হাতের ইশারায় বললাম,-‘ম্যানেজার সাহেব নেই, বাইরে গেছে।’
লম্বা চার-পায়ার একটা টুল ছিল সামনে, লিলি টেনে নিয়ে আমার পাশে এসে বসলো। কিন্তু ওর হাবভাব দেখে মনে হলো, রাগে বেলুনের মতো ফুলছে। চোখ দিয়ে যেন আগুনের গরম শলাকা বের হচ্ছে। মুখখানা লাল দেখাচ্ছে ওর। ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে হাঁপাচ্ছে আর বলছে,-‘ম্যানেজার সাহাব কব্ বাপস্ আসবে জানো?’
মাথা নেড়ে বললাম,-‘না। কিন্তু কি ব্যাপার বলোতো! চেহারার এ কি হাল হয়েছে তোমার? আজ এতো শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে কেন তোমাকে! কেশ বিন্যাস এলোমেলো। ড্রেস্ও চেঞ্জ করো নি। খুব জরুরী তল্লাসী মনে হচ্ছে।’
গম্ভীর হয়ে লিলি বলল,-‘কিঁউ হবেনা, গলত কদম জো উঠায়া ম্যায়নে। আব তো জুরমানা ভড়না পড়েগী না, ইসি লিয়ে।’
কিছুটা সময় নিরবতায় কেটে গেল। আমার নিরুত্তরে লিলি বলল,-‘সরি এ্যায়ার, খামোখা দুঃখ লিবে না। কসুরবার তো ম্যায় হু না।’
হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলে,-‘ও আগয়া।’
দেখলাম, ভি.আই.পির মতো খট্খট্ শব্দে বুটের আঘাত করতে করতে উগ্রমেজাজে ষ্টোরে ঢুকছে ম্যানেজার এ্যন্থনি লরেন্স। লিলিকে দেখামাত্রই মুখখানা কেমন বির্বণ হয়ে গেল। কটাক্ষ দৃষ্টিতে এক পলক তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলতে বলতে ঢুকে পড়লেন অফিস ঘরে। ওর পিছন পিছন লিলিও ঢুকে পড়লো ভিতরে। তার ঠিক মিনিট কুড়ি পরই যেন বিরাট একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। আমরা চমকে উঠি। হঠাৎ বজ্রকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল ম্যানেজার এ্যন্থনি,-‘আই সেইড গেট আউট্ ফ্রম হীয়ার! আউট্!’
গলা টেনে দেখি, লিলিকে ধাক্কা দিয়ে অফিস থেকে বের করে দিলেন ম্যানেজার এ্যন্থনি। লিলি দু’হাতে মুখ ঢেকে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে ফ্যাঁচ্ ফ্যাঁচ্ করে কাঁদছে। আচমকা সাময়িক বিভ্রান্তিতে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে ওঠে ম্যানেজার এ্যান্থনি। রাগাণ্বিত হয়ে কটাক্ষ দৃষ্টিতে এমনভাবে একপলক তাকালেন, যেন চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে লিলিকে। চোখদু’টোতে যেন তার আগুন জ্বলছে।
ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,-‘আই ডু নট ওয়ান্ট টু সি ইওর ফেইস এনি মোর, আন্ডারষ্টুড্? ননসেন্স!’ বলেই বিকট শব্দে অফিস ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন।
ইতিমধ্যে আমার চোখে চোখ পড়তেই মোমের মতো গলে নরম হয়ে গেল লিলি। ছোট্ট শিশুর মতো হিচ্কি তুলে কেঁদে কেঁদে বলল,-‘ব্যাহেনজী, ম্যায়তো লুট গয়ী! বরবাদ হো গয়ী! ও’ শালা হাড়ামী, বদমাশ, হামার সবকুছ্ লুটে লিয়েচে!’
বলেই আঙ্গুল থেকে হিরের আংটিটা খুলে অফিস ঘরের দিকে ছুঁড়ে ফেলে অশ্লীল ভাষায় গালি দিতে থাকে।
আচমকা অপ্রীতিকর পরিস্থিতি লক্ষ্য করে ষ্টোরের উপস্থিত কাষ্টমার সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। একে অন্যের দিকে জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। মাঝখানে আমিই পড়ে গেলাম মহা ফ্যাসাদে। কি করি! অগত্যা, লিলিকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম ষ্টোরের বাইরে। পাশেই কফি হাউজ্। বললাম,-‘চলো, কফি হাউজে গিয়ে বসি।’
লিলি বলল,-‘নেহি, কফি হাউজমে নেহি। ও শালা ভাগ যাবে। ইধারিই ব্যায়ঠো। আজ ম্যায়ভি দেখ্ লুঙ্গী!’
রাতের উন্মুক্ত আকাশের নীচে একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম দু’জনে। শিহরণে অনুভব্য হয়, আসন্ন শীতের মিহিন বাতাস। ঠান্ডা আবহাওয়া। একটু একটু কূয়াশাও পড়ছে। লিলি ফোঁস করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,-‘শালা, এ্যকভি নেহি মিলা, জিসকো আপনা কহে সঁকু! সব শালা ঝুট্! বিশ্বাসঘাত, ধোকেবাজ, ধান্দাবাজ। শালা বেইমান কঁহিকা!’
আমি প্রতিবাদ করলাম।-‘তুমি সব পুরুষ মানুষকে গালি দিচ্ছ কেন? মেয়েরাও সব স্বতী সাবিত্রী না কি? ছলা-কলায় মেয়েরা তো একেবারে এক্সপার্ট। বাগে পেলে মেয়েরাও পুরুষ মানুষদের কম নাচায় না!’
গায়ে ফোসকা পড়ে গেল লিলির। মুখখানাও ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অসন্তোষ গলায় বলল,-‘ঘাঁও মে মরিচ ঢালছ। আরে এ্যায়ার, ম্যায়নে কোই গুনা নেহি কি। উসেতো স্রিফ দিলসে চাহা। প্যায়ার কিয়া। লেকিন ও’ শালা হামাকে ধোকা দিবে, তা কে জানতো!’
এবার মুখ ফসকে আমিও বলে ফেললাম,-‘কেন, তুমি না বলেছিলে, তোমার স্বামী তোমাকে খুব ভালোবাসে। সে একেবারে রাজপুত্রুর। তুলনাই হয় না। খুব আমির লোক। তুমি তার পতীব্রতা স্ত্রী। তা এমন স্বামী ছেড়ে ম্যানেজার এ্যন্থনির সাথে কেন প্রেম করতে গিয়েছিলে? দোষ তো তোমার!’
লিলি নিরুত্তর। অপরাধীর মতো অব্যক্ত ভাষায় মলিন ম্রিয়মান হয়ে বেশ কিছুক্ষণ নিঃশ্চুপ হয়ে বোবা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। হঠাৎ বড় বড় চোখ পাকিয়ে হাতের বুড়ো আঙ্গুলটা দেখিয়ে বলল,-‘ঘোড়েকা আন্ডা! তুমকো নেহি মালুম, শালা মরদলোগ স্রিফ আপনা পিয়াস বুঝায়। অউরত জাত্কো খিলোনা সমঝতে হ্যায়। সব বকওয়াস হ্যায়। পেয়ার বেয়ার কুছ নেহি।’
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,-‘আরে এ্যায়ার, ছোড়ো ইন বাতোকো। আপনি দিমাক কিউ খারাপ করছ। ইয়ে সব বেকার কি বাত হ্যায়। মেরি কিসমতই হ্যায় এ্যাসি।’
বিস্মিত হয়ে বললাম,-‘তা তুমি যে এসব করছ, তোমার স্বামী জানে?’
ফিক্ করে একটা বিষন্ন হাসি হেসে ফেলল লিলি। হাসিটা বচায় রেখে বলল,-‘কিতনি ভোলে হো তুম! অউর বুদ্ধু ভি।’
লিলির হাতে ছিল, হাজার ডলারের একটা নোট। নোটটা রোল করে মুড়াতে মুড়াতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হতাশার সুরে বলল,-‘পতী, কিসকি পতী? ক্যাসি পতী? সব দিখাওয়া হ্যায়। আভি তক্ মেরি সাদিই হুয়ি নেহি। অফর আপনি পতীকি প্যায়ার মিলনা, কিসমত কি বাত হ্যায়। তুম নেহি সমঝোগে। জানতি হো, কিতনি অভাগন হু ম্যায়! ক্যায়া শোচা থা, অউর ক্যায়া পায়া!’
বলেই দুহাতে মুখ ঢেকে ফ্যালে লিলি। গলা ভারি হয়ে আসে। তার পরক্ষণেই হৃদয়ের পূঞ্জীভূত সমস্ত কষ্ঠ, বেদনাগুলি তরল হয়ে ওর দু’গাল বেয়ে শ্রাবণধারায় অঝোরে ঝড়তে লাগল।
আমি তো অবাক শুনে। কিছুই বুঝছি না। মনে মনে ভাবলাম,-বড় গভীর জলের মাছ। যতোটা সোজা মনে হয়েছিল, অতোটা সোজা মেয়ে ও’ নয়। জল ঘোলা করতেও জানে।
বিষন্ন হয়ে বললাম,-‘অমন করে কাঁদছ কেন? ম্যানেজারের সঙ্গে হয়েছেটা কি তোমার বলো না! খুব তো দোস্তী ছিল তোমাদের। হঠাৎ এমন কি ঘটলো!’
বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে বেঞ্চিতে মাথা ঠুকে সাশ্রু নয়নে বসে থাকে লিলি। মুখ দিয়ে একটা শব্দও আর বের হয় না। আমিও নাছোড়বান্দা। প্রশ্নটা পূনারাবৃত্তি করলাম। লিলি নিরুত্তর। ততক্ষণে আকাশের গায়ে সন্ধ্যে ঢলে পড়েছে। রাস্তার বিজলীবাতিগুলি জোনাকীর মতো ঘন কূয়াশায় মিটিমিটি করে জ্বলছে। সুদূর গগনে একঝাঁক পাখী উড়ে চলে আপন ঠিকানায়। লিলি শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সেদিকে। চাঁদের ক্ষীণ মৃদু আলোয় মুক্তোর মতো বিন্দু বিন্দু অশ্রুকণায় চোখদু’টো ওর চিক্চিক্ করছে। অথচ ভিতরে ভিতরে বুকের পাঁজরখানা ভেঙ্গে যে গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে, তা ওর মুখদর্শণে বেশ অনুমেয় হচ্ছিল। তবু ফুটে কিছুই বলছে না। হঠাৎ চোখে চোখ পড়তেই শুকনো মুখখানা ওর আরো ফ্যাকাশে হয়ে গেল। চেয়েছিল গোপন করে রাখতে কিন্তু অবলীলায় তা আর পারলো না। ধীরে ধীরে উন্মোচণ হতে লাগল ঘন রহস্যাবৃত লিলির জীবন কাহিনী।
( তিন )
এ্যন্থনির সাথে লিলির প্রথম দেখা হয়, বান্ধবী সুলোচনার ম্যারেজ সেরিমোনিতে। সেদিন সন্ধ্যে থেকেই সুবর্ণের ঝাঁড়বাতির ঝিকিমিকি আলোর কণার সুসজ্জিত সাজে মেতে উঠেছিল, আলো আঁধারির খেলা। প্রচুর আয়োজন। বিরাটাকারে বিস্তৃত টেবিল জুড়ে সাজানো ছিল সুস্বাদু বিভিন্ন খাদ্যসম্ভার। ক্রমাণ্বয়ে শুরু হয়, চমকপ্রদ প্রসাধনের বাহার ছড়িয়ে, আতরের গন্ধ উড়িয়ে, মুক্তাঝরা হাসির ফোয়ারা তুলে বাহুবেষ্টিত যুগলবন্দী কপোত-কপোতীর পালা করে আগমন। কথোপকথনের গুঞ্জরণ। বেশ আনন্দোৎচ্ছল সমারোহে ছেয়ে গিয়ে সৃষ্টি হয়, এক মনোরম রোমাঞ্চকর পরিবেশ। সেইসঙ্গে ছিল স্যাম্পেন, হুইস্কি আর সফ্ট ড্রিংক্স। এছাড়াও আমন্ত্রিত অথিতিদের মনোরঞ্জনের জন্য বসেছিল সহেলিদের লাস্যভরা নৃত্য-গীতের আসর। চলছে অপূর্ব সঙ্গীতের মূর্ছনা। সবাই মশগুল হয়ে আছে। ইতিমধ্যে এ্যন্থনি লরেন্সের সন্ধানি চোখের দৃষ্টি ওর প্রতিটি মুভমেন্টের সঙ্গে চড়কির মতো ঘুরতে ঘুরতে একসময় তীরের মতো ছুটে গিয়ে বিদ্ধ হয়, লিলির উর্দ্ধাংশের অনাবৃত নরম মসৃণ শুভ্র বক্ষের মধ্যস্থলে। এ্যন্থনির হাতে ছিল হুইস্কির গ্লাস। ক্ষীণ পায়ে নৈঃশব্দে লিলির সন্নিকটে এগিয়ে এসে লিলির গা-ঘেষে দাঁড়িয়ে হাতের কনুই-এর সংস্পর্শে অনুভব করছিল, নারীর কোমল অঙ্গের উষ্ণ অনুভূতি। গল্পে এতোটাই মত্ত হয়ে ছিল যে, সেদিকে ভ্রুক্ষেপই ছিলনা লিলির। হঠাৎই পুরুষালি দেহের এক অন্যতম অনুভূতি এবং নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের উগ্রগন্ধ্যে ও’ চমকে ওঠে। পিছন ফিরেই দ্যাখে, মাথায় পাগড়িপড়া সুঠাম সুদর্শণ মার্জিত চেহারার এক তরুণ যুবক সহাস্যে মুগ্ধ বিস্মিত চোখের দৃষ্টি মেলে ওর মুখপানে পলকহীন নেত্রে চেয়ে আছে। চোখের পাতা পর্যন্তও পড়ছে না। তার দুইবাহু ভর্তি তৃণের মতো পশম। গালের দু’পাশে সুসজ্জিত দাড়ি এবং সর্বোপরি পুরুষোচিত চেহারা এবং মিশ্রব্যক্তিত্বের এক অন্ধ আকর্ষণে মায়াবী পরীর মতো সুদর্শণা লিলির রক্তগোলাপ ঠোঁটের কোণায় চকিতে হাসির ঝিলিক দিয়ে ওঠে। মহলের মধ্যস্থলে ঝুলন্ত ঝাঁড়বাতিটার ঝিকিমিকি আলোয় সেদিন ওকে আরো উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। আর তখনিই এ্যন্থনি লরেন্স দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত হয়, চিড়িয়া ওর জ্বালে ফেঁসে গেছে। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে সকৌতূকের হাসি ফুটিয়ে সৌজন্যমূলক আলাপচারিতায় এ্যন্থনির প্রথম প্রশ্ন,-‘আর ইউ ম্যারেইড্?’
সলজ্জে মুচকি হেসে মাথা নেড়ে লিলি বলল,-‘ওঃ নো! আই এ্যাম নট্?’
সেদিন সহজ সরল নিস্পাপ মনা লিলি কি ভেবেছিল, ঐ সৌজন্যমূলক হাসিটুকুই একদিন ওর জীবনে এতবড় বিপদ ডেকে আনবে।
সততা ও নৈতিকতার সিঁড়ি বেয়ে এ্যন্থনি লরেন্স অনায়াসে পোঁছে যায় লিলির অন্তরের অন্তরস্থলে। যার ইশারায় একটানা ন’মাস কাঠপুতুলের মতো নেচেছিল লিলি। যাকে ভালোবেসে মন-প্রাণ উজার করে ঢেলে দিয়ে মনে মনে স্বামীরূপে গ্রহণ করেছিল। যাকে ওর হৃদয়পদ্মে দেবতার আসনে বসিয়ে স্বেচ্ছায় সঁপে দিয়েছিল স্বামীর পূর্ণ অধিকার। যার নাম সন্দীপ রায়। ওরফে এ্যন্থনি লরেন্স, বির্জু সিং, মুহম্মদ জামাল। যাকে এশিয়ান বলে কোনদিন মনে হয় নি। অথচ সে ভারতীয়, একজন খাঁটি বাঙালী। যার আঁখেড়া ছিল দেশ-বিদেশের অলিতে গলিতে, পৃথিবীর সর্বত্রই।
সন্দীপ কখনোই স্থায়ীভাবে এক জায়গায় বসবাস করে না। প্রতি ন’মাস অন্তর ওর ডেরা বদলায়। সেখানেই চলে ওর রাজত্ব। ছলা-কলা-কৌশলে, বুদ্ধির চাতুর্য্যে প্রাইভেট ফার্মের ছোট চাকরি থেকে জেনারেল ম্যানেজারের পদ অনায়াসে হাসিল করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা তার জন্য ছিল বাচ্চা ছেলের হাতের মোয়া। কখনোবা টেলিফোন অপারেটর থেকে চিফ্ অফিসার। সেই সঙ্গে পরিবর্তিত হয় তার চেহারা, বেশভূষা এবং নামের পদবীটাও। যার অন্তরালে সাপের খোলসের মতো এক পৈশাচিক অমানবিক আত্মায় রূপান্তরিত হয় সন্দীপ রায়। ওরফে এ্যন্থনি লরেন্স। যখন মনুষ্য শিকারের সন্ধানে লোভ লালসার জ্বাল বিছিয়ে সহজ সরল কচি সুদর্শণা যুবতী মেয়েদের মোটা বেতনের চাকরি, লাক্সারী গাড়ি-বাড়ি, অভাবনীয় আরাম-আয়েশের জীবনের প্রলোভনে ওদের কব্জা করবার প্রচেষ্টায় হায়নার মতো হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায় রাজ্যের বিভিন্ন নীরব নির্জন নিড়িবিলি এলাকায়। আর কার্য সিদ্ধি হলেই সন্দীপ রায়ের পোয়া বারো। ওর শিকারের প্রাথমিক পদ্ধতি হলো, উদার মনোভাব ও সদাচারে মহান ব্যক্তিত্বের পরিচয় প্রমাণিত করে মাসুম মেয়েদের অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস জোগানো। যার অনিবার্য কারণে লিলির প্রথম পরিচয়েই বন্ধুত্বে পরিণত হওয়াটাও ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে ঘনিষ্ঠতা, হৃদ্যতা। কখনো বা চমকিত বিজলীর আলোর মতো বাঁকা চোখের ইশারায় রহস্যাবৃত হাসির ঝিলিকে চুম্বকের মতো আর্কষণে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়ে দিনের পর দিন চলতে থাকে গোপন অভিসার। ভালোলাগা আর ভালোবাসার নাটক। প্যায়ার, ইস্ক, মহব্বত। অবশেষে জানায় বিবাহের প্রস্তাব। আর তখনই নীরিহ দুর্বল যুবতী মেয়েরা মিথ্যে বিবাহের সম্মতি দিয়েই ব্যাভিচারী ও ধূর্ত সন্দীপের শিকার হয়ে অচীরেই পতিত হয় নিরাপত্তাহীন, গন্তব্যহীন, অনিশ্চিত জীবনের এক ভয়াবহ অন্ধকার গুহায়। যখন অমানবিক এবং পৈশাচিক আচরণে গভীরভাবে লিপ্ত হয়ে, দৈহিক ক্ষুধা মিটিয়ে বাসররাতের গহীন নিশীথে স্বামী বনাম ধূর্ত অসামী সন্দীপ রায় ঐ মাসুম মেয়েদের অজ্ঞাতসারে ঘুমের বড়ি সেবনে নিদ্রাবস্থাতেই গুপ্তচরের সহায়তায় ওদের সঁপে দেয়, আরব দেশের রাজা বাদশাদের হাতে। দয়া-মায়াহীন অত্যাচারী পাষন্ডদের হাতে। সেই সঙ্গে পাচার করে, তোলা তোলা হীরা-জহর, মণী-মুক্তোও। যার বিনিময়ে সন্দীপ রায় উপার্জন করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। হাজার হাজার ডলার, পাউন্ড।
কিন্তু লিলির বেলায়ই ঘটে যায় সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। যা কখনো স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি সন্দীপ। অত্যন্ত চমকৃতভাবে বিবাহের রাতেই লিলি আবিস্কার করতে সক্ষম হয়, এ্যন্থনি লরেন্স একজন স্মাগ্লার, ফ্রড্, ধূর্ত। দেশে-বিদেশে মেয়ে পাচার করে। এসবই ওর ব্যবসা।
কিন্তু বিয়ে বলে কথা। ছেলে খেলা নয়। দু’টি মানব-মানবীর পবিত্র ভালোবাসার অনিবার্য পরিণতি। দু’টি আকাক্সিক্ষত হৃদয়ের মধুর সঙ্গম। একান্ত নিবিড় নিঃভৃতে সংগোপনে পরশে পরশে উষ্ণ উত্তাপে দু’টি মাংসল শরীর একাকার হয়ে মিশে যাওয়া। এ তো নতুন কিছুই নয়। আবহমানকালের নারী-পুরুষের চাওয়া-পাওয়ার এক চিরন্তন খেলা। আদিম খেলা। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই তার যৌবনের প্রারম্ভকাল থেকেই এক পুলক জাগা শিহরণে আকুল হয়ে অপেক্ষা করে থাকে, জীবনের পরম আকাক্সিক্ষত এই শুভ দিনের শুভ মুহূর্তটির জন্য।
তেমনি লিলিও কত না স্বপ্ন ওর দু’চোখে এঁকে রেখেছিল। কত আশা নিয়ে গোধূলির শুভ লগ্নের শুভ ক্ষণের অপেক্ষা করে বসেছিল। অথচ রীতি-নীতি অনুসারে সামাজিক বিবাহের কোনো আয়োজনই নেই! বাজনা বাজজে না, সানাই বাজজে না। এমনকী পরিচিত বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, ওর আশে-পাশে কেউ নেই। চারদিকে শুধু শ্মশ্বান পুরীর মতো গাঢ় নিঝুম রাত্রির নিস্তদ্ধতা।
অজানা আশক্সক্ষায় বুকটা ধুক্ধুক্ করে কাঁপতে থাকে লিলির। যেন কার শ্রাদ্ধ হচ্ছে। সাড়া বিশ্বজুড়ে প্রতিটি মানুষ যেন মৌনমনে শোক পালন করছে। সে যে কত নিষ্ঠুর পরিণতির পূর্বাভাষ, তখনও ওর মনের মধ্যে চৈতন্যোদয়ই হয় নি।
সন্ধ্যে থেকে একটানা গভীর নিস্তদ্ধতায় ডুবে থেকে একসময় হঠাৎ ওর কর্ণগোচর হয়, টেলিফোনটা বারবার রিং হচ্ছে, কিন্তু কেউ পিক্ করছে না। হঠাৎ এ্যন্থনি কোথা থেকে আর্বিভূত হয়ে ফিসফিস করে কি যেন বলে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ইত্যবসরে নামাবলি ধারণকৃত একজন পুরোহিত মহাশয় উৎকন্ঠিত হয়ে বলছে,-‘ইয়ে সাধী,এয়া বরবাদী? বাড়ির লোকজন সব গেল কোথায়? কামাল হ্যায়! দুলহা ভি নেহি হ্যায়।’ বলতে বলতে সেও অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
এদিকে সুগন্ধি ফুলের গহনায় সুসজ্জিত বধূবেশে লিলি ক্রমশ অস্থির হয়ে ওঠে। ডাঙ্গায় ওঠা মাছের মতো ক্রমাণ্বয়ে ছট্পট্ করতে থাকে। -হে ভগবান, ইয়েতো সত্যিই বরবাদী মনে হচ্ছে! কোথায় গেল এ্যন্থনি?’
তিনতলা বাড়ি। চারদিক নীরব নিস্তদ্ধ। কারো সাড়া শব্দ নেই। ইঁদুর কতগুলো চিচি করে আওয়াজ করছে। সময় যতো অতিবাহিত হচ্ছে, সন্দেহ আরো ঘণীভূত হতে থাকে। চাপা উত্তেজনায় লিলি পালঙ্ক ছেড়ে নেমে এসে দরজার গোড়ায় গিয়ে দাঁড়ায়। গলা টেনে জানালায় উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দ্যাখে, বাইরে বারান্দার বিজলীবাতিটা ক্ষীণ মৃদু আলোয় জ্বলছে। কেউ কোথাও নেই। যেন একটা গুদামঘর। দম আঁটকে আসছে ওর।
হঠাৎ ঘরের দরজাটা দ্রুত খুলতে গিয়ে টের পায়, ওকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। তালা দেওয়া। কিন্তু কেন? কিসের জন্য? চায় কি এ্যন্থনি? সবই কি ওর পূর্বপরিকল্পিত? ষড়যন্ত্র? তবে কি এ্যন্থনি বিশ্বাসঘাতকতা করলো ওর সাথে?
হাজার প্রশ্নের ভীড়ে বিচলিত হয় ওঠে লিলি। তবু ওর মন মানে না। বিশ্বাসই হয় না। ভালোবেসেই তো এ্যন্থনি ওকে বিয়ের প্রোপোজাল দিয়েছিল। বলেছিল ওকে রাজরানী করে রাখবে। হৃদয় নামক ওর বিশাল সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্ঞী করবে। না, না, ও’ কখনো বেইমানী করবে না। জরুর কোই মুসিবতে ফেঁসে গিয়েছে এ্যন্থনি। লেকিন দরওয়াজা বন্ধ কেন? ওকে কেন বন্দী করে রেখেছে?
ভাবতে ভাবতে কেটে যায় কয়েক প্রহর। ততক্ষণে চারিদিকে গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যায়। লিলি চিৎকার করে ওঠে,-‘দরওয়াজা খোলো। এ্যন্থনি তুম কাঁহা হো? দরওয়াজা খোলো।’
ইতিমধ্যে টেলিফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠতেই দরজায় আড়ি পেতে থাকে লিলি। – ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আমি সন্দীপ বলছি। গুরু, মাল আভি তক্ নেহি পঁহউচা। আউর সর্দারজী ভি। জী হাঁ, লন্ডিয়াভি নাকাবন্দি হ্যায়। ও মেরে কব্জেমে হ্যায়।’
অভাবনীয়ভাবে কথাগুলি শুনে মাথায় বজ্রাঘাত পড়ে লিলির। এ কি শুনলো ও’? জীবনের চরম মুহূর্তে কি না এতবড় ধোকা। ভালোবাসার নাটক রচিয়ে এ্যন্থনি ওর সাথে এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করলো! আমায় প্রতারণা করলো!
ক্ষোভে, দুঃখে-অপমানে জর্জরিত লিলি মুহূর্তের জন্য ভারসাম্য হারিয়ে মানসিকভাবে অত্যন্ত ভেঙ্গে পড়ে। জীবনে এক অভিনব আনন্দের একটা তীব্র অনুভূতি জাগ্রত হবার পূর্বেই সুকোমল হৃদয়কে ওর ভেঙ্গে চৌচির করে দিলো। অনুভব করে, পায়ের নিচের মাটিটা যেন সরে গেল। শরীরের সমস্ত অনু-পরমানুগুলিও যেন ক্রমশ অসার হয়ে আসছে। ভাটা পড়ে গেল ওর প্রেম যমুনায়। সম্মুখে যেন চোরাবালির চড়। আতঙ্কে শিউড়ে ওঠে। বিড়বিড় করে বলে,-‘মাল, কিসকা মাল? ক্যাসা মাল? কৌন সর্দারজী? ও’ কেন আসবে এখানে? হে ভগবান, এ আমায় কোন্ পরিক্ষায় ফেলে দিলে তুমি!’
লিলি বুদ্ধিমতী ও সহনশীল মেয়ে। সহজে ভেঙ্গে পড়ার নয়। মনে মনে বলল,-‘বাপ কো ভি বাপ হ্যায় এ্যন্থনি। আজতক্ স্রিফ্ বিল্লিই পাকড়াও কিয়া। আব দেখ্না, খেল্ ক্যাসে খতম করুঙ্গী ম্যায়!’
সত্যিই তাই হলো। হঠাৎ মেসেজ আসে, পরিস্থিতি আশক্সক্ষাজনক। বিপদ অবশ্যম্ভাবী। নিরাপদ নয়। সীমান্তের চারিধারে পুলিশ টহল দিচ্ছে। ওরা যে কোনো মুহূর্তে ধরা পড়ে যেতে পারে। সর্দারজী বাপস চলে গেছে।
সংবাদটি শুনে টেনশন বেড়ে গেলেও লিলির মতো একজন সুন্দরী যুবতী নারী দেহের গন্ধে ও ভোগের লালসায় ক্ষুধার্ত হায়নার মতো সন্দীপকে ক্রমশ ধাবিত করতে থাকে। উদ্যত করে। অবশেষে একটা হুইস্কির বোতল নিয়ে অবিলম্বে ঢুকে পড়ে লিলির ঘরে। অথচ এ্যন্থনি একজন ফ্রড্ চরিত্রহীণ নির্দয় নিষ্ঠুর জেনেও লিলি অমত করল না। বাঁধা দিলো না। বিনা মন্ত্র উচ্চারণে বধূবেশে যুগলবন্দি হয়ে বাসররাতের খেলাঘরে নিজেকে উজার করে ঢেলে দেবার উন্মাদনার অভিনয়ে গভীর ভাবে মেতে ওঠে। কিন্তু মনে মনে লিলি অপেক্ষা করেছিল সুযোগের। আর সেই সুযোগে ওর সুকোমল যৌবনের নেশায় অমানবিকভাবে পৈশাচিক আচরণে গভীরভাবে লিপ্ত হয়ে কামনা নদীর অতল তলে ডুবে যেতেই এ্যন্থনিকে ব্রান্ডির সাথে কড়া ডোজের ঘুমের ঔষধ খাইয়ে, অচৈতন্যে বেহোঁশ করে ওর বৈষয়িক সম্পত্তির সমস্ত ডকুমেন্ট, টাকা-পয়সা, দামী গহনা একে একে সব হাতিয়ে নিয়ে চেয়েছিল, এ্যন্থনিকে সর্বস্বান্ত করে ওর ঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে। ও’কে প্রমাণসরূপ পুলিশের হাতে তুলে দিতে। ওকে ভিক্ষীরি করে পথে বসিয়ে দিতে। কিন্তু লিলি তা পারেনি। পারিনি চুরি-ডাকাতি করে রাতারাতি এ্যন্থনির ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে নিরুদ্দেশ হতে। উল্টে নিজের ভাগ্যকে বাজী রেখে ঘরের আলো নিভিয়ে, টেলিফোনের সমস্ত কানেকশান্ অফ্ করে, দরজায় খিল দিয়ে সারারাত অন্ধকার ঘরের কোণে চুপটি করে বসেছিল, ওর হৃদয় কম্পিত ভয়াবহ দূর্ধর্ষ্য রহস্যের জ্বাল উন্মোচন করার জন্য। এ্যন্থনির সত্য উদ্ঘাটনের জন্য।
কিন্তু নিজে প্রতারিত, অপমানিত এবং নিগৃহীত হয়েও সর্বনাশা ভালোবাসাই অবরোধ করে বসে ওর পলায়নের পথ। শুধু তাই নয়, নারীজাতির কলঙ্ক থেকেও ওকে মুক্ত করলো, রক্ষা করলো। লিলির হৃদয় বড়ই কোমল, উদার। ওযে নিয়তির কাছে আত্ম সমর্পিত, নিমোজ্জিত এবং বিসর্জিত।
লিলি সিদ্ধান্ত নেয়, নারীর পূর্ণ সত্ত্বা দিয়ে, ওর হৃদয় নিংড়ানো অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়ে, প্রেমের পরশ দিয়ে, সঙ্গ দিয়ে, সেবা-যত্নে সন্দীপকে, ওরফে এ্যন্থনিকে এই ভয়ঙ্কর নরক থেকে ফিরিয়ে আনবে, ওকে মুক্ত করবে। ওকে সুশীলসমাজে সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত করবে।
ভাবতে ভাবতে আপনমনেই স্বগোতক্তি করে ওঠে,-তোমায় যে মনে-প্রাণে ভালোবেসেছি দ্বীপ। তোমায় একান্তআপন করে কখনো না পেলেও আমাদের প্রথম দেখার সেই বর্ণনাতীত ভালোলাগার অম্লান স্মৃতিটুকুই যে জড়িয়ে আছে আমার অদৃশ্য অনুভূতিতে। যা গেঁথে আছে, অর্থহীন, মূল্যহীন অবাঞ্ছিত ভালোবাসার গভীর বন্ধনে। অথচ তা কখনো ছিন্ন করা যাবে না। এ এমনিই এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। এক অনবদ্য প্রেমের পান্ডুলিপি। তুমি যে আমার হৃদয়ের পুরোটাই দখল করে নিয়েছ দ্বীপ। আমায় ভালোবাসো না জেনেও, গ্রহণ করবে না জেনেও তোমায় একেলা ছেড়ে পারিনি চলে যেতে। পারিনি তোমায় সাজা দিতে। নাইবা পেলাম স্ত্রীর পূর্ণ মান-মর্যাদা, পূর্ণ আধিপত্য। তবু মন-প্রাণ শরীরের সমস্ত অনুভূতি দিয়েই একান্তে নিভৃতে অনুভব করবো, তোমার উপস্থিতি। তোমার আবেগাপ্লুত প্রেমের মধুর স্পর্শ। আর তখনই গভীরভাবে ডুবে যাবো সুখের অতল গহ্বরে। কিন্তু এতবড় অসম্ভবকে সম্ভব করা কল্পনায় যতটা সহজ, বাস্তব ততটাই কঠিন।
(চলবে)…
যুথিকা বড়ুয়া : কানাডার টরন্টো প্রবাসী গল্পকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী।