ফরহাদের মৃত্যুতে রমিজ, হামিদ ও অন্যরা অনেক দুঃখ পেয়েছে; ওরা হামিদকে বলে তুমি একজন ভালো বন্ধু এবং আমরা একজন ভালো মেস মেম্বার হারিয়েছি। হামিদ চোখের পানি মুছে বলে ও আমার গ্রামের ছেলে, ছোট বয়স থেকে একত্রে উঠাবসা এবং চলাফেরা করেছি। আমরা একত্রে স্কুলে যাওয়া আসা, গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে মাঠে গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্দা হাডুডু,পুকুরে সাঁতার; বর্ষার মৌসুমে নৌকা করে বাজারে গিয়ে আখ, মুরুলী, কিনে একত্রে নৌকায় বসে খেতাম, গল্প করতাম এবং পানিতে বড়শি দিয়ে এবং পাট ক্ষেতে কইয়া জাল পেতে মাছ ধরতাম। সুদিন মৌসুমে পুকুরে এবং খালের পানি কমে গেলে জাল দিয়ে মাছ ধরা, খালের পানি সেচে বাইম, সিং, গুঁড়া মাছ ধরে বাড়িতে নিয়ে আসলে মা চাচী কত খুশি হতো। ফরহাদ কোনোদিন গ্রামে কারো সঙ্গে রাগ করে কথা বলতে দেখি নি।
ফরহাদের স্ত্রী আলেয়া অতি অল্প বয়েসে বিধবা হয়েছে; একটি শিশু সন্তান নিয়ে বিপদে পড়েছে। ফরহাদের এবং আলেয়ার মাবাবার সংসারের অবস্থা ভালো না। আলেয়ার বাবা একজন অসুস্থ্য রোগী, সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকে, চলাফেরা ও করতে পারে না।আলেয়া ফরহাদের সংসারেও থাকতে পারবে না, এই সংসারে কী খাবে ?
তাছাড়া তার এবং বাচ্চার কি ভবিষ্যৎ?
তার সামনে সারাটা জীবন পড়ে আছে, তার দেখাশুনা কে করবে ?
রমিজ বলে ফরহাদের শালা খায়েরকে তুমি ডেকে এনে ঠেলা গাড়ির কাজে লাগিয়ে দাও, এতে তাদের সংসারে কিছুটা স্বচ্ছলতা আসবে। আলেয়া যদি বাচ্চা গ্রামে মাবাবা বা শ্বশুর শাশুড়ির নিকট রেখে কাজ করতে চায়, ঢাকাতে কারো বাসায় লাগিয়ে দেয়া যেতে পারে।
হামিদ বলে রমিজ ভাই, তুমি দেখো কোনো বাসায় দেয়া যায় কি না,আমি বাড়ি গেলে আলাপ করে এনে কাজে লাগিয়ে দেব। রমিজ বলে ফরহাদ মৃত্যুর পূর্বে আমার সঙ্গে ও আলাপ করেছিল তার স্ত্রীকে কোনো বাসায় কাজে লাগিয়ে দেয়া যায় কী না। আমি বলেছিলাম যে আমার জানাশুনা কেউ নেই , রহমত ও আফজালের স্ত্রী বাসায় কাজ করে, আলাপ করে দেখতে পারি।
তোমারতো ঠেলাগাড়িতে একজন লোক দরকার,অন্য কাউকে কাজ না দিয়ে খায়েরকে খবর দিয়ে কাজে লাগিয়ে দিতে পারো। হামিদ বলে খায়ের অনেক ছোট ও ভীতু, এই কঠিন কাজ করতে পারবে কী ?
খায়ের স্কুলের ৮ম শ্রেণীর ছাত্র , সংসারের দুরবস্থার জন্য পড়াশুনা বন্ধ করে দিয়ে খেতেখামারে কাজ করে।
আলেয়ার চাচা আনিস সাহেব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক; নিজের সংসার চালিয়ে বড়ো ভাইয়ের সংসারে ও কিছু সাহায্য করে। এ নিয়ে তার ঘরে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আনিস সাহেবের নিত্য কথা কাটাকাটি হয়। স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা বলে আমাদের টানাটানির সংসার, তুমি প্রতি মাসে বেতন পাইলেই ওদের সংসারের চাল ডাল কিনে দাও। তোমার নিজের সংসারের খোঁজখবর না নিয়ে অন্যের সংসারের খবর বেশি জরুরি মনে করো। আনিস সাহেব বলেন ও আমার আপন ভাই, অসহায়; ওরা কী না খেয়ে মরবে?
আনিস সাহেবের স্ত্রী রুপা বলে আমাদের টানাটানির সংসার, ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা, কাপড়চোপড়, ঔষধ, কাগজ কলম এবং নিত্য এটাসেটা লাগে, খরচ চালাতে পারো না, তুমি অন্যের সংসার দেখাশুনা করো। তুমিতো পরোপকারী মানুষ, নিজের ঘরের ভাঙা মুলির বেড়া, ঘরে ইঁদুর ঢুকে,ঠান্ডা শুরু হলে বাতাসে কাঁথায় শীত মানায় না, তুমি চোখ খুলে সংসার করো না, পরোপকার করে বেড়াও। আনিস সাহেব বলেন পরের ঘর কোথায়?
উনিতো আমার আপন ভাই এবং নিজের রক্তের মানুষ । খায়ের আর দুই বৎসর পড়লে স্কুল ফাইনাল দিতে পারতো, এখনই কাজে লাগিয়ে দিয়েছে।
এই ছেলের ভবিষ্যৎ কি ?
তুমি পরের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করো , নিজের ছেলেমেয়ের কথা কী চিন্তা করো ?
তুমি যদি এ সব পরোপকার বন্ধ না করো, আমি আমার বাবার বাড়ি চলে যাব। তুমি কয়দিন পর পর রাগ করে বাবার বাড়ি যাও, এ দিকে আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিপদে পড়ি, কে রান্না করে , হাঁসমুরগি, গরু ছাগল আছে, তুমি না থাকলে কে দেখা শুনা করে ?
আলেয়াকে বিয়ে দেয়া হয়েছিল, তাও তার কপাল মন্দ,এই অল্প বয়েসে স্বামী এক্সিডেন্ট করে মারা গেলো। রুপা বলে তোমার ভাই এমন সংসারে আলেয়াকে বিয়ে দিয়েছে, যে সংসারে আলেয়া দুই বেলা পেট ভরে ভাত ও খেতে পায় নি। আজ ৬ মাস আলেয়া এই টানাটানির সংসারে বাচ্চা নিয়ে কত কষ্ট পাইতেছে, ওর শ্বশুর বাড়ির লোক একবার এসে দেখে ও যায় নি। এগুলি আস্ত ছোট লোক, একটু খবর বা ছোট বাচ্চাকে দেখে যাওয়া প্রয়োজন মনে করে না। আনিস সাহেব বলেন গরিব মানুষ, আসলে দুইটি পয়সা খরচ করতে হয়, হয়তো সে জন্য আসে না।
রুপা বলে আমি শুনেছি , আলেয়ার শ্বশুর শাশুড়ি ওকে বলেছে, দেখে শুনে বিয়ে করে নিতে;ওরা বাচ্চা নিয়ে যাবে। আলেয়া বলে আমি বিয়ে করবো না এবং আমার জীবন গেলেও কাউকে বাচ্চা দেব না।আনিস সাহেব বলেন মেয়েরা সব সময় না করে, বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে কেউ কি এসেছে ?
এই গরিব ঘরে কে আসবে ওকে বিয়ে করতে, বাবা অসুস্থ্য, তা ছাড়া একটা ছোট বাচ্চা সহ কে বিয়ে করবে? আমি স্কুলে শিক্ষকদের সঙ্গে এবং এখানে সেখানে এ নিয়ে আলাপ করি, দেখি যদি কোথায় ও কিছু করতে পারি।
রুপা বলে আমার কাছে আলেয়ার জন্য একটা বিয়ের প্রস্তাব আছে।
আনিস সাহেব বলেন কোথায় এবং কে সেই ছেলে ?
রুপা বলে আমাদের গ্রামের রুস্তম চাচা, সংসারের অবস্থা অনেক ভাল। তোমাদের গ্রামের সব লোক আমি চিনি, কিন্তু রুস্তম কে ?
তুমি চিনবে না, ও চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্টে কাজ করতো, অবসর জীবন , ওর স্ত্রী মারা গিয়েছে। ছেলে মেয়েরা সবাই বড়ো হয়েছে।
তুমি কি ওই রুস্তমের কথা বলছো, সব সময় চায়ের দোকানে বসে চা খায়, পান খেয়ে দাঁত বিশ্রী রং বানিয়েছে , দাঁড়ি ও চুলে মিন্দি দিয়ে লাল রং করে রেখেছে এবং সব সময় দোকানে বসে গ্রাম্য পলিটিক্স করে?
হ্যাঁ ,তাতে অসুবিধা কোথায় ?
খেয়ে দেয়ে ভালো থাকবে এবং রুস্তম চাচা এই ছোট্ট বাচ্চা ও দেখাশুনা করবে , তাছাড়া তোমার ভাইয়ের সংসারে সময় অসময়, কিছুটা সাহায্য করবে । এই লোকের ৬০- ৬৫ বয়স, তুমি ওর জন্য ১৭ বৎসরের মেয়ে আলেয়াকে বিয়ে দেয়ার কথা বলছো, এই কথা আর একবার ও মুখে আনবে না ।
আমি তো খারাপ কিছু বলি নি , তোমার ভাই অসুস্থ্য এবং এক বেলা রোজগারের সামর্থ নেই , মেয়েটা খেয়ে দেয়ে ভালো থাকবে তার ছেলে নিয়ে। দেখো, বেমানান কথা কেন বলো?
রুপা বলে, তুমি তোমার ভাইয়ের সংসারে আর টাকা পয়সা দেবে না। আনিস সাহেব বলেন, খায়ের আরো দুই বৎসর স্কুলে পড়াশুনা করলে একটা ভালো কাজ পেতো। আমি আমার ভাইকে কি দেব এ নিয়ে তোমার মাথা ব্যথা কেন, তোমাকে জিজ্ঞেস করবো ?
রুপা বলে,আমি আজ ৪ মাস কোমরের ব্যথা নিয়ে উঠা বসা করতে পারি না। অনেক কষ্ট করে তোমার সংসারে কাজ করে খাওয়াই। তুমি একদিন ও জিজ্ঞেস করো না যে তোমার কী হয়েছে ?
তোমার বাতের রোগ, ঔষধ খাইলে কী ভালো হবে ?
ভালো হোক আর না হোক একবার জিজ্ঞেস ও করো না। আমি আজ ১৫ বৎসর তোমার সংসারে বান্দী দাসীর মতো কাজ করি। আমরা যখন একত্রে ছিলাম , তোমার পিয়ারে ভাবি আমাকে দিয়ে কাজ করাতো আর নিজে বসে বসে পান খাইতো এবং খবরদারি করতো, তোমার মনে নেই ?
চুপ কর, সারাক্ষন তোমার এই ঘ্যানর ঘ্যানর আমার ভালো লাগে না। শুনো, আমি কি জানিনা তুমি ওই মাগীর সঙ্গে রং ঢং করে কথা বলো। দেখো রুপা ওকে আমার বড়ো বোনের মতো শ্রদ্ধা করি, তুমি কী সব আজে বাজে কথা বলো। ছোটকালে আমাদের মাবাবা মারা গেছেন, বড়ো ভাই বিয়ে করেছেন এবং ভাবি আমাদের স্নেহ যত্নে মানুষ করেছেন। খায়েরের পড়াশুনা স্কুল ফাইনাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি সংসার একত্রে চালাবো; এটা আমার পবিত্র দায়িত্ব, আমি তা করবো।
তুমি যদি এ সব করো, আমি আমার বাবার বাড়ি চলে যাবো।
পরদিন আনিস সাহেব স্কুলে যাওয়ার পর রুপা আলেয়াকে ডেকে এই কথা সেই কথা বলার পর বলে তোমার বাবা অসুস্থ্য, তোমাদের সংসার তো আর এ ভাবে চলে না। আলেয়া চুপ করে আন্টির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সে বলে, আমাদের গ্রামের রুস্তম চাচা বয়স একটু বেশি, বৌ মারা গেছে, ছেলেমেয়েরা সব বড়ো বড়ো। ঝামেলামুক্ত সংসার, ওর দেখাশুনার জন্য বিয়ে করতে চায়। গত মাসে আমাদের ঘরে এসে তোমাকে দেখে পছন্দ করেছে। তোমার বাচ্চা শুদ্ধ ভালো থাকবে, ও বলছে তুমি রাজি হলে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নেবে।
আলেয়া শুনে হতবাক, আন্টি আমি কী ওই বুড়ো লোকটাকে বিয়ে করবো ?
তুমি কী ওনাকে দেখছো ?
হ্যাঁ , এই বুড়ো লোকটা আপনার ঘর থেকে বার বার আমার দিকে তাকাইতে ছিল।
শুনো, পুরুষ মানুষের বয়স কিছু না, উনি তোমাকে এবং তোমার বাচ্চা দেখবে। আলেয়া কাঁপতে কাঁপতে ঘরে গিয়ে কান্না শুরু করে এবং বলে আমি বিষ খেয়ে মরে যাবো। ওর মা বলে, তোর কী হয়েছে ?
আমাকে বল, ওই ঘর থেকে এসে কি জন্য কান্নাকাটি করছিস ?
ও কিছুই বলে না, শুধু চোখের পানি ফেলে আর বলে আল্লাহ তুমি আমাকে এই দুনিয়া থেকে নিয়ে যাও।
মেয়ের কান্না দেখে আলেয়ার বাবা রাতে জিজ্ঞেস করে তুমি দিনের বেলা রুপাদের ঘরে গিয়েছিলে, ওখানে রুপা তোমাকে কী বলছে এবং সেখান থেকে আসার পর কী নিয়ে কান্না করছো ?
আলেয়ার বাবা বলে আনিস আমাদের সাহায্য করে তার বৌ এ নিয়ে ঘরে আনিসের সঙ্গে ঝগড়া করে। নিশ্চয়ই কিছু বলছে যা শুনে তোমার দুঃখ হয়েছে।
আলেয়া বলে আনিস কাকা কেন আমাদের জন্য বাজার করবে?
আমরা না খেয়ে মরবো, প্রয়োজনে মাঠ থেকে কচু পাতা, পাট পাতা, এটাসেটা এনে খাবো; তথাপি কারো কাছ থেকে সাহায্য নেবো না।
তুমি বলো, কী নিয়ে তুমি কান্না কাটি করো?
আলেয়া বলে কে এক বুড়ো লোক আন্টির গ্রামের আমাকে এসে দেখে গেছে, আমি কিছুই জানিনা, এই বলে কান্না শুরু করেছে।বাবা, আমি এ সব শুনে সহ্য করতে পারছি না; আমি মরে গেলে যদি তোমাদের লাভ হয়, তাই করবো। কিন্তু আমি এ ধরণের কথা সহ্য করতে পারবো না। তোমরা বলো আমি মরে যাবো কী না ?
আলেয়ার বাবা বলে সংসারে অভাব আছে বলে কী এখন ১৭ বৎসরের মেয়েকে ৬০-৬৫ বৎসরের বুড়োর কাছে বিয়ে দিতে হবে?
আলেয়ার মা বলে আমি রুপাকে জিজ্ঞেস করবো, আমরা গরিব বলে কী এখন এই লোকের নিকট তোকে বিয়ে দিতে হবে ?
থাক মা তুমি আন্টি বা আংকেলকে কিছুই বলবে না এবং আংকেল নিজের ঘরে অশান্তি করে আমাদের সাহায্য করার দরকার নেই।
আমি ফরহাদের বন্ধু হামিদকে চিঠি দিয়ে বলেছি আমাকে ঢাকা কোথায় ও কারো বাসায় একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে। তোমরা আমার ছেলেকে দেখবে, আমি কাজ করবো এবং খায়েরকে স্কুলে দুই বৎসরের জন্য পাঠাবো;ও পড়াশুনা শেষ করে যে কোনো কাজ খোঁজ করে নেবে। আলেয়ার বাবা বলে তুমি কী কাজ করবে ?
বাবা, ফরহাদ মরার আগে প্রায়ই আমাকে বলতো, গ্রামে বেশি অসুবিধা হলে আমাকে ঢাকা নিয়ে যাবে এবং দুইজনে কাজ করে দাঁড়াতে চেষ্টা করবে । ঢাকাতে অনেকের বাসায় কাজের লোক দরকার হয় এবং থাকা খাওয়া ও ভালো পয়সা দেয়। ঠিক আছে আলেয়া এখন চুপ করে থাকো, যেভাবে ভালো মনে করো, তাই করবে। বাবা খায়ের ছোট্ট মানুষ কি কাজ করবে এবং ওর রোজগারে সংসার চলবে না, তাছাড়া তুমি অসুস্থ্য, ডাক্তার, ঔষধ লাগে।
রুস্তম কয়েক দিনের মধ্যে একজন বিয়ের ঘটক ও সঙ্গে আরও দুইজনকে দোকান থেকে একটা লাল নীল শাড়ি, অনেক ধরণের মিষ্টি সহ প্রস্তাব নিয়ে আলেয়ার বাবার কাছে পাঠিয়েছে। ওরা এসে সালাম দিয়ে বলে আমরা রুস্তম মিয়ার জন্য আপনার মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। আলেয়ার বাবা চুপ করে রয়েছে , ওরা রুস্তমের সব ধরণের প্রশংসা করে বলে আপনার মেয়ে ও ছোট বাচ্চা নিয়ে খুব ভালো থাকবে। রুস্তম মিয়ার অনেক বিষয় সম্পত্তি আছে, আপনাদের সাহায্য করবে। আলেয়ার বাবা বলে আপনারা এখন যান, আমি আপনাদের পরে বুঝেশুনে জানাবো। ওরা বলে আমরা বিয়ের কথা পাকা করে রুস্তমকে এনে বিয়ে পর্ব শেষ করে যাবো। আলেয়ার মা বলে আপনারা কী জোর করে আমার মেয়ে নিয়ে যাবেন ?
আলেয়ার ভাই খায়ের ঘরের ভিতর থেকে এসে বলে আপনাদের শাড়ি ও মিষ্টি নিয়ে এখান থেকে চলে যান। ওরা কিছুতেই যাইতে রাজি না। শেষে খায়ের এসে জোর করে তাদের শাড়ি ও মিষ্টি বাহিরে ফেলে দিয়ে বলে আপনারা এখান থেকে চলে যান। ওরা ধমক দিয়ে বলে বেটা চুনোপুটি, তুই উঠানে শাড়ি, মিষ্টি ফেলেদিয়ে আমাদের প্রকাশ্যে অপমান করলি, আমরা এখন যাই, তবে দেখবো কে এই বিয়ে ঠেকাইতে পারে এবং কী ভাবে ?
ওরা চলে যাওয়ার পর আলেয়া বোরকা পরে সঙ্গে সঙ্গে খায়েরকে নিয়ে পালিয়ে তার শ্বশুর বাড়ি রওয়ানা দিয়ে চলে আসে এবং শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলে আপনারা আমাকে এবং আমার দুধের শিশুকে বাঁচান। আমার এই এই বিপদ, আমি আর বাড়ি যাইতে পারবো না।
আমার বাবা ঘরে অসুস্থ্য, একমাত্র ভাই পড়াশুনা না করে এখন মাঠে কাজ করে। এ অবস্থায় কে আমাকে এবং আমার ছেলেকে দেখাশুনা করবে ?
ফরহাদ মৃত্যুর আগে প্রায়ই বলতো যে আমরা ঢাকা গেলে দুইজনে কাজ করে ভালো থাকবো। সে বলতো, আমরা কাজ করবো এবং দুইজনে মিলে কোথায় থেকে ছোটোখাটো করে সংসার চালাবো । আমি হামিদ ভাই আসলে ঢাকা গিয়ে দেখবো যদি কিছু করতে পারি।
হামিদ বাড়িতে আসার পর আলেয়ার সঙ্গে দেখা করে বলে, তুমি বলেছো সে জন্য এক বাসায় তোমার কাজের ব্যবস্থা হয়েছে। ওরা বলেছে তোমার ছেলেকে নিয়ে ওরা থাকতে দেবে। ফরহাদের মা বাবা এবং রিনা বলে তাহলে অসুবিধা কোথায় ?
আলেয়া বলে আমি তোমার সঙ্গে যাবো এবং তুমি আমাকে ওদের বাসায় পৌঁছে দিও। পরদিন সকালে হামিদ ওদের নিয়ে ঢাকা গিয়ে বাসায় পৌঁছে দিয়ে খায়েরকে নিয়ে মেসে এসে রমিজ ও মেসের লোকদের বলে আমি ফরহাদের স্ত্রী আলেয়াকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছি; খায়েরকে আপাতত এখানে আমার সঙ্গে ঠেলা গাড়ির কাজে রাখবো। রমিজ বলে এটা অনেক ভালো কাজ করেছো, একটা পরিবার তোমার উছিলায় একটু ভালো থাকবে।
পরদিন খায়েরকে নিয়ে ঠেলা গাড়ির কাজে লাগিয়ে দিয়ে বলে দেখো তুমি কাজ পারবে কি না। খায়ের ১৩-১৪ বৎসর বয়সের ছেলে, ২-৩ ঘন্টা কাজ করার পর, সে হাঁফিয়ে উঠছে এবং বলে এই কাজ আমার জন্য অনেক কঠিন।
বিকেলে সে আলেয়াকে দেখতে গিয়ে বলে আমি ঠেলা গাড়ির কাজ করতে পারবো না। বাড়ির মালিক শুনে বলে তুমি আমাদের বাড়ি পরিষ্কার, অফিসে দুপুরের লাঞ্চ নিয়ে যাবে, বাগানে ফুল গাছে পানি দিবে ও বাজারে যাইবে । তোমরা দুই ভাইবোন কাজ করবে এবং থাকবে।
খায়ের বাড়ি থেকে বই, খাতা ও পেন্সিল নিয়ে এসেছে । সে ও আলেয়া রাতের কাজের পর অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশুনা করে। আলেয়া ৫ম শ্রেণী ও খায়ের ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত দেশে পড়াশুনা করেছে। আলেয়া খায়েরের বই নিয়ে নাড়াচাড়া করে এবং যা না বুঝে, খায়েরের কাছ থেকে জেনে নিয়ে পড়াশুনা করতে চেষ্টা করে। বাড়ির মালিকের স্ত্রী বিন্দু, ভাই বোনের পড়াশুনার আগ্রহ দেখে খুশি হয়ে বলে তোমরা পড়াশুনা করতে পারলে আমি তোমাদের বই, খাতা, কাগজ ও পেন্সিল কিনে দেব।তাছাড়া আমি ও আমার ছেলেমেয়েরা তোমাদের পড়াশুনায় একটু আধটু সাহায্য করতে পারবো । ওরা খুশি হয়ে বলে আমরা দুইজনেই একত্রে দুই বৎসর পর স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দেব। ওরা দুইজনই বিন্দুকে মা বলে ডাকে। বিন্দু খুশি হয়ে বলে যাক , আমি একটা ছেলে ও মেয়ে পেয়ে খুশি হয়েছি।
খায়ের সকাল হলেই ব্যাগ নিয়ে বাজার করে বাড়তি পয়সা বুঝিয়ে দিয়ে নিজের কাজ সেরে দুপুরের লাঞ্চ নিয়ে রহমান সাহেবের অফিসে দিয়ে আসে; রান্না খাবার পর বই নিয়ে বসে বিকেল পর্যন্ত পড়াশুনা করে; বিকেলের রান্নার কাজে গিয়ে ভাই বোন মিলে চা নাস্তা তৈরী করে সবাইকে দিয়ে রাতের রান্না বসিয়ে দেয় এবং খায়ের বিকেলে গার্ডেনে ফুলের গাছে পানি দেয়া, সব ধরণের বাহিরের কাজ সেরে বাসায় আসে। ওরা ভাই বোন মনে করে ” আমরা যে করেই হোক মালিকের মনো-রঞ্জনের জন্য চেষ্টা করবো। ” মাসের শেষে বিন্দু ওদের ১০০ টাকা বাড়ির জন্য দিয়ে বলে ডাকে বা হামিদের নিকট পাঠিয়ে দিও।
সমস্যা দেখা দিয়েছে আলেয়ার ছোট বাচ্চা নিয়ে ; ওকে আলেয়ার বুকের দুধ খাওয়ানোর পর ও দুধ খাওয়াতে হয় এবং প্রায়ই দেখা যায় যে বাড়িওয়ালির ফ্রীজে দুধ থাকে না। বাচ্চা সব সময় কান্না কাটি করে, এখানে সেখানে ফ্লোরে পায়খানা করে বাসা নষ্ট করে রাখে যে জন্য ওরা আলেয়া ও ওর ভাইকে বাসা থেকে বিদায় করে দিয়েছে। আলেয়া অনেক কান্না কাটি করে বলে আমি বাচ্চা দেশে রেখে আসবো এবং আমরা দুইজনে কি থাকতে পারবো ?
বাসার সবাই এই ছোট বাচ্চার জন্য বিরক্ত হয়ে বলে আপাতত আমাদের কোনো কাজের লোক দরকার নেই। যদি ভবিষ্যতে প্রয়োজন হয় তোমাদের জানাবো।
রহমান সাহেব সরকারি চাকুরীজীবি, প্রতিদিন কাজ থেকে এসে বাচ্চার ঘ্যানর ঘ্যানর এবং বাসায় বাড়তি ঝামেলা সহ্য করতে না পেরে বিন্দুকে বলেছে ওদের বিদায় দিতে। বিন্দু বলে আমি বুঝি তোমার অনেক অসুবিধা এবং তোমার মতো হাজার হাজার মানুষের কত কী অসুবিধা , আমরা কতজনকে দেখবো?
আলেয়া এবং খায়ের টিকাটুলীর মোড়ে গিয়ে হামিদকে কেঁদে বলে আমাদের বিদায় করে দিয়েছে ওদের বাসা থেকে। হামিদ বলে কেন হঠাৎ করে তোমাদের বিদায় করে দিয়েছে ?
খায়ের বলে আমরা ভাইবোন এবং বাচ্চা নিয়ে ওদের একটু বেশি সমস্যা হয় । অনেক সময় ছোট বাচ্চা কান্না কাটি করে , বাসায় মেহমান আসলে বিরক্ত হয় ; সে জন্য ওরা আমাদের বিদায় করে দিয়েছে। আলেয়া বলে আমি অনেক কান্নাকাটি ও করেছি। কিন্তু ওরা কোনো মতেই রাজি হয় নি।
হামিদ বলে আমি মেসে থাকি ওখানে তোমাদের কী ভাবে রাখবো ?
হামিদ ঠেলা নিয়ে বের হয়ে গেলে, ওরা কিছুক্ষন অপেক্ষা করে গুলিস্তান হয়ে রমনা পার্কের দিকে চলে যায়। খায়ের রমনা পার্কের এখানে সেখানে বহু বাস্তুহারা লোকের সন্ধান পেয়ে বলে দেখি ওরা কী ভাবে দৈনন্দিন রোজি রোজগার করে।
খায়ের বলে আলেয়া তুমি বাড়িতে চলে যাও , আমি একা থেকে কিছু না কিছু করে ওদের সঙ্গে এখানে সেখানে রাতে ঘুমিয়ে থাকবো। আলেয়া বলে আমি বাড়িতে গেলে ওই বুড়ো রুস্তমের সঙ্গে বিয়ে দেবে। খায়ের তুমি বরং আমার ছেলেকে নিয়ে বাড়িতে রেখে দিয়ে আসো , ওকে নিয়ে শহরে থাকা অনেক অসুবিধা হবে। তুমি না আসা পর্যন্ত আমি ওই বাসায় বলে কহে দুই দিন থাকার ব্যবস্থা করবো।
খায়ের ও আলেয়া ছোট বাচ্চা নিয়ে বিন্দুর বাসার নিকট গিয়ে বলে খায়ের তুমি আমার ছেলেকে নিয়ে এখানে দাড়াও, দেখি আন্টি কি বলে ?
সে বাসায় গিয়ে অনেক অনুরোধ করে বলে আন্টি আমি আমার বাচ্চা ও খায়েরকে দেশে পাঠিয়ে দিতেছি। আপনি জানেন আমি দেশে গেলে অনেক অসুবিধা হবে , খায়ের ফিরে আসা পর্যন্ত আমাকে থাকতে দেন।
বিন্দু বলে ঠিক আছে তুমি থাকো, তোমার আংকেল দেখলে কি বলে তা জানি না। আন্টি খায়ের নিচে অপেক্ষা করছে ,আমি খায়েরকে বাচ্চা নিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে আসি। আচ্ছা ঠিক আছে। আলেয়া কেঁদে ছোট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর করে বলে যাও ; আন্টি বলেছেন তুমি না আসা পর্যন্ত থাকতে পারবো। ভয় পাই আংকেল কী বলেন ?
ঠিক আছে আমি ওকে নিয়ে চলে যাই এবং ফিরে এসে হামিদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করবো। খায়ের বাচ্চা নিয়ে চলে যাচ্ছে, আলেয়া অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে চোখের পানি মুছে আর বলে যার কেউ নেই,তার জন্য উপর ওয়ালা রয়েছে।
ক্রমশ :