দীর্ঘকবিতা
জাদুঘর থেকে বলছি
পর্ব ১৫।।
কেন জানা হল না– তৃষ্ণাবোধক সাগর কি কখনো মিঠে জলের খোঁজে প্রাণান্ত হয়? তেমন আফসোস ফুরাতে না-ফুরাতেই আরেকটি মসলিন-আচ্ছাদিত বর্ষা এসে গেল। বিষণ্ণতার নানা চালাকি হৃদয়ে দুরন্ত চাকার মতো চলকে উঠছে। কষ্ট কি চোরাকুঠুরির প্রকাশ্য বধিরতা নিয়ে শুধু বঞ্চনার হাততালিকেই অনুবাদ করতে পছন্দ করে?
মন-নদীতে সনির্বন্ধ সাঁকো বাঁধতে-বাঁধতে বেলা-অবেলাগুলো আজ তবে পোড়ামাটির ফলক। তুমি কি পটুয়া? আমার হৃদয়-অকুস্থলে তৃপ্তিহীন খোঁদাই করো মেঘাতীত মানচিত্র।
ও-পার ছুঁয়ে-থাকা তাম্রলিপ্তি ধুলোর শালিক, শালিকের মেঘ, মেঘের অর্ধখোলা বাড়ি, বাড়ির ছায়াবাজী, ঝুমকো টোপর-পরা ছায়ার পাহাড়, পাহাড়ে ঝরনাস্নাত শঙ্খমালার কমনীয়তা– সকল কিছুই অজানা থেকে গেল। আদতে অসাড় জীবিতের মাঝে বেঁচে থাকে মেধাবী মৃতরা, প্রেতবাড়ির নানা কারিগর।
ভাঁটিখানার কোলঘেঁষে তাহলে কি মুখচোরা অলিন্দ চিরকালই পড়ে থাকবে দাবিদাবাহীন? রূপনারায়ণের বদান্যতায় একদিন হয়ত সেও হবে দখিনা দিগন্তের সৌভাগ্যময় ঘাঁটি। বাকল খসে-পড়া ইটের পাচিল যেমন নিস্তরঙ্গ তেমনি পরিপাটি ঘোড়াগাড়ির গৃহপ্রবণতা। এমন আধ্যাত্মিকতাতে দুপুর-আঁধার করে বুনো হাঁসের ঢঙে বৃষ্টির অবিরত সিঁড়ি রাজবাড়িতে দ্রুত নেমে এল।
জনশ্রুত মাছের সর্বাঙ্গীণ জিন জলীয় হতেহতে অস্ফুট নদীর দেশে কক্ষপথহীন গ্রহের ব্যগ্রতায় কর্মঠ গাছদের প্রেরণা হতে চায়। পতঙ্গ-শিকারী ফুলদের ঊর্ধ্বমুখী ক্রোড়পত্রে লেখা রয়েছে– এ যাবত অতিরঞ্জিত হয়েছে কী-কী ঋতুর বিষাদগীতি। স্মিত শিক্ষায়তনে মাংসল চক ব্ল্যাকবোর্ডে থেকে-থেকে এঁকে দিয়েছিল তার প্রচলিত সংসার-ভাবনা। অবিশ্বাস্য ছুটির ঘণ্টা বেজে-বেজে থমকে থাকে হাঁটু-মচকানো টেবিলের সন্তাপদীপ্ত কোণে।
নিষ্কলঙ্ক তাপবিদ্যুৎ-কেন্দ্রের সকল সমাচার পাললিক ভাগ্যলিপির জ্বরাক্রান্ত লক্ষণ মাত্র। ছিপিআঁটা-বোতলে বন্দি দৈত্যের খোঁজে জাল হাতে কখনো নদীতে যাওয়া হয় নি। তাই বলে কি ভাগ্যান্বেষণে অপটু রহিম দপ্তরির জমানো-রোদ্দুর কুয়াশার ছদ্মবেশ নেবে? এখনো কান পেতে রাখে সেই একই বিচক্ষণতায়– কখন বড়ালের বেতস ঝোপ থেকে ভেসে আসবে সঠিক ডাহুকের বাস্পীভূত ডাক।
খিলিপানে নেশাগ্রস্ত মুখোশের ফেলা টুকটাক পিকে রঞ্জিত গানবাজনার যত সরঞ্জাম। আসন পেতে ব’সে, ওরা মেঝেজুড়ে ঝাউবনের দক্ষতাতে ঠিকঠাক ঘুমিয়ে আছে। অবাক ঘর থেকে দিগ্বিজয়ী ঘোড়-সওয়ারের শিরোপাটা শুধু চুরি গেছে। খবরটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক-চুল পরিমাণ ফাঁস হতেই মাথার ওপরে তা পাক খেয়ে চলল হেলিকপটারেরও অধিক ক্ষিপ্রতা বগলদাবা করে। নকল উজিরের প্রামাণিক ক্লোন জনপ্রিয় বিক্রয়বিপণিতে ঝুলতে লাগল শতশত।
শতপ্রকার কাদাপানিতে হাঁটার বিচ্ছিরি ভালোলাগা নিয়ে এক-হাঁটু বন্যা ডিঙিয়ে সুফিয়াদের উঠোনে যাই ওদের কদমগাছ থেকে কদমফুল পাড়তে। বিস্তারিত জানালায় ঘাড় গুঁজে পড়ে-থাকা পর্দা নড়ে উঠতেই ওদিকে তাকালাম। আলটপকা চমকে পিছলে পড়ি থিকথিকে কাঁদায়। যেন মোষের পিঠে চড়ে বেড়ানো এই আমি ভূপতিত হলাম দড়াম ভঙ্গিমায়। ঘরের ভেতর থেকে কার যেন মিহি হাসির দমক পিরামিডের উচ্চতা নিয়ে আমাকে ছাপিয়ে গেল। সুফিয়া নয় তো?
নয়ছয় হয়ে যায় পুষ্ট বীজে জমে-থাকা মোহনীয় আগুন শনির অভিপ্রায়ে অভ্যস্ত বিষপিঁপড়েদের অভিশাপে। কারো স্বপ্নের মাঝে প্রতিচ্ছবি হয়ে রাত-পোহানো সৈনিক দুঃখমোচন বলতে বোঝে পদ্মদিঘিতে একা বসে অনন্য জলপোকাদের সাঁতার দেখা।
কাতারে কাতার মগ্নতায় ছায়াময় পাখিরা আলোর ডিমে তা দিতে-দিতে আরো মায়াময় হয়ে ওঠে। অকৃত্রিম দূরে সুকুমার বেলা চলে যেতে পারে। সসীম জাম, জামরুল, নিমগাছ পাতার পকেটে-পকেটে সঞ্চয় করে কিছু নিরাপদ দুপুর। এভাবে সুগন্ধি রঙের একেকটি বৃত্তাকার মঞ্চ বাগান হতে-হতে বসন্ত হয়ে যায়। শাখা-প্রশাখাহীন বিষণ্ণতার গতিবিধি মুখ থুবড়ে পড়ে নিকটবর্তী বৃষ্টিতে, ঝরনার উদ্বোধনে, জলধির সন্তরণে কিংবা নির্ভুল জনপদে।
বাঁশির ব্যাকুল সুরের বাজুতে কে বেঁধে দেয় অনুপম বিরহের দক্ষিণা? সে কেন বউকথা-কও হলুদ পাখির উছিলায় রাধার হৃদয়কে নীড় ভেবে গোপন ডুবুরির বেশ ধারণ করে? মৈমনসিংহ গীতিকার মাদকতায় শরণাপন্ন হয়ে এই আতারিপাতারি সন্ধেবেলায় কে দেখাল ঘর-বাঁধার নিরবিচ্ছিন্ন স্বপ্ন?
কাচারি ঘরের দূরতম সীমান্ত ঘেঁষে সূর্যাস্ত ভেসে গেলে, কতিপয় নীলিমার জল মেখে চাঁদ উঠে আসে। জোছনার হলুদ আলতায় আপ্লুত চারদিক। চন্দ্রাবতী, আজ তোমার গায়ে হলুদ?
পার্শ্ববর্তী গাছের জিলেপি ফল থেকে কেমন ঝুরঝুর লাল আভা ঝরছিল অর্বুদ কৌতূহলে। আহা আস্থার এমন দৃষ্টান্তমূলক যোগফলে বিস্তৃত ঝিঁঝিঁপোকাদের সঙ্গীত সমুদ্র-সমতলে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে। ঘুমুতে যাব। জাফরানি জামাটার বিশ্বস্ত বোতামগুলো গীতিনাট্যের নীরব সুরে আমাকে কত-না শোনাল তাদের স্মৃতিচারণ!
বিশিষ্ট পাখি সনাক্তকরণ নীড়ে খড়কুটোরা হয়ে উঠেছে প্রশান্তির শিরা-উপশিরা।
মধুপুর বিলের হিজল গাছটা পেছন ফিরে তাকাতেই, ভুঁইফোড় রোদ বিবাগী ঢেউয়ের মতো মৎস্যকুমারী হয়ে জলের অতলে হারিয়ে গেল। আত্মঘাতী দুধকলা দিয়ে বিচ্ছেদ নামের খরস্রোতা ছোবল পুষেছ মনের অন্তরীক্ষে। তবে কেন আকাশে ময়ূরী মেঘকে পেখম মেলতে দেখলেই অতর্কিতে অমনোযোগী হয়ে পড়ো? বাতাসের বাঁ দিকের পাঁজরে রক্তপিপাসু জবা ঘনিষ্ঠ হলে, দম-দেয়া যন্ত্রণার জীবাণুরা মোচড় দেয় হলুদে-আঁকা অপ্রবাসী হৃদয়ে। অকাট্য পাপোশের বিনয়ত্বকে পুঁজি করে ঘরের দোরে ঘাপটি মেরে পড়ে-থাকা পায়ের পোষ্য ধুলোগুলো কম্পাস-কাঁটার কঙ্কাল হয়ে নড়েচড়ে বসে। থুতুর করোটিতে শ্যাওলা ঘনীভূত হলে, কে পরিয়ে রাখে লোহার শিকল কাঠের ঘোড়ার পায়ে?
ত্রিতাল-পূজারী বীজগণিতের শিক্ষা ঘাটের কড়ির মতো ম্রিয়মান সন্ধে নয়। আমার হৃদয়ের জলজ অলিন্দে নৌকা পেতে মৃণালিনীকে প্রথম শেখালাম কীভাবে বৈঠা বাইতে হয়। বৈঠার সেইসব ত্রিকোণমিতিক ছপাত-ছপাত ধ্বনি এখনো মননে বাজে। আর মৃণালিনী চলে গেছে বৈঠাখানা ফেলে সাতসমুদ্র তেরো নদী ও-পারে ভেনিসে।
একাধারে বিদ্যুৎপ্রভার ঝিলিক-নিঃসৃত অবসরের টানাপোড়েন অলস পাখির গ্রীবা উঁচিয়ে আমার ঠোঁটে নীরবতা এঁকে দিতে চায়।
আশ্রমহীন কলসের নিঃশব্দ অতলতা কি দ্রোণাচার্যের প্রেমাসক্ত যুদ্ধযাত্রা?
তোমার অনুপম নাকছাবিটা একদিন হোক-না তবে কোনো দ্বাদশী উড়াল, দূর-পাহাড়ের ঝরনার চেয়েও প্রবহমান। আমি প্রিয়তম পক্ষ হয়ে অন্তর্নিহিত হব ওতে। যেমন করে উপত্যকার উঠোনে উপবিষ্ট সময়ের শয়নভঙ্গিমাও ঝিনুককে জাহাজডুবির গল্প শোনাতে ভালবাসে। (চলবে…)