ফ্লোরিডা থেকে:-
গত কয়দিনে ইরমার অত্যাচার , অপচয়, অবিচার ও তর্জন গর্জনে ক্লান্ত হইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়া ছিলাম ।
ঘুমাইলেই স্বপ্ন দেখি, ইহা একটি রোগ।
আমারই একটি কবিতা স্বপ্নে দেখিতেছিলাম। আমি নরকে বাস করি।
নরকের হাইওয়ে ধরিয়া গাড়ী চালাইতেছি। স্পিড খুব বেশী যদিও রাস্তা গাড়ীতে গাড়ীতে সয়লাব। বিগত কয়েকদিনের ফ্লোরিডার হাইওয়ে সমূহের মতই।
নরক বলিয়াই স্বপ্নে এত গতি।
অমি এক্সিট ভুল করিয়া ফেলিয়াছি। ফিরিবার পথ নাই। বাধ্য হইয়া পরের এক্সিটে বাহির হইয়াছি ।
দেখি ইহা নরক নহে।
একটি সুন্দর বাগান।
বিশাল , ফুল আর ফুল।
ঝর্ণা। পাখী গাহিতেছে।
সুন্দর বাতাস বহিতেছে।
একজনও ইরমা ইরমা করিতেছেনা।
দূরে কোন এক অতীব সুন্দরী রমনীর স্বচ্ছ ও হাল্কা বসন উড়িতেছে।
সে আগাইয়া আসিল: “পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?”
প্রশ্নটি আমি আগেও কোথায় যেন শুনিয়াছিলাম । মনে করিতে পারিতে ছিলাম না। কহিলাম , “ভদ্রে, আমি নরকে থাকি, পথ কাহাকে বলে তাহা জানিনা। পথ বাতলাইবার লোকজন ইরমার ভয়ে পালাইয়াছে । নরকের দিকেই যাইতে ছিলাম। তুমিই বল ইহা আমি কোথায় আসিয়াছি?”
সে ফিক্ করিয়া হাসিয়া ফেলিল।
হাসির কি রহিয়াছে বুঝিতে পারিলামনা।
“তুমি আসলে পথ ভুল করিয়াছ। বেশী দূরে চলিয়া আসিয়াছো । ইহা এডেনের নন্দন কানন। নরকে যাইতে হইলে তোমাকে ইউ টার্ন করিয়া দক্ষিনে নেপলস , মায়ামী ও “কী ওয়েস্টের” দিকে যাইতে হইবে ।”
আমি কহিলাম, “ইউ টার্নই যদি করিব, তবে নরকে আর যাইবোনা , আমার আদর্শের সাধ মিটিয়া গিয়াছে, আমি মর্তে ফিরিয়া যাইব, ভদ্রে তুমি কি আমার সাথে যাইবে?”
এই সময়ে বিশাল গর্জনের মত একটি আওয়াজ শুনিতে পাইলাম। উহা ছিল বাহিরে বাতাসের গর্জন।
সুইচ টিপিলাম, আলো নাই।
ঘুমের ওজনে চক্ষের পাতাগুলি খুলিতে পারিতেছিনা । কোনমতে ট্যারা চোখে আইফোনে দেখিলাম চারটি বাজিয়াছে । বিছানা খালি, কক্ষে অন্ধকার পা টিপিয়া হাঁটিতেছে, বাহিরে বৃষ্টি ঝর ঝর করিতেছে।
দমকা বাতাস বহিতেছে।
যাহার সাথে স্বপ্নে কথা কহিতে ছিলাম সে কই? মনে পড়িল কে যেন একজন হাসপাতালে আটকা পড়িয়াছে। ইনি সেই কিনা কোন মতেই ঠাহর হইতেছেনা।
কেমন ঘোরের মধ্যে আছি।
এই মুহূর্তে মেসেন্জারে টুং করিয়া আওয়াজ হইল। দেখিলাম একজন তন্বি অপরিচতা একটি সুন্দর ছবি ও “আমার বয়েস ১৯” এই তিনটি শব্দ ব্যবহার করিয়া একটি অসমাপ্ত মেসেজ পাঠাইয়াছে। সে হয়তো ঝড়ের রাতে “হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল ” ।
এইবার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল।
বাহিরে ইরমা নাচিতেছে। বৃষ্টিতে দুনিয়া সয়লাব হইয়া যাইতেছে।
ভাসিব না তলাইব বুঝিতে পারিতেছিনা।
নূহের নৌকা আশেপাশে নাই।
শৈশবের আমিন আলী মাঝি মরিয়া কোন দরিয়া দিয়া নৌকা লইয়া চলিয়া গিয়াছে ।এই দু:সময়ে কোন নিঠুরের মায়া হইল আমার সাথে চ্যাট করিবার?
সে কি কোন নিদ্রাহীন দেয়াসীনী? অথবা সুদূর হিজলের দেশের কোন কাশবন কন্য?
বুঝিলাম, সে আমার প্রোফাইল পিকচার ও মাথাভরা চুল দেখিয়াছে।
বুদ্ধি করিয়া বয়েসের গোমর ফাঁক না করিয়া ঝাকড়া চুলের সেই বয়েসে ফিরিয়া যাইয়া একটা অতি রোমান্টিক উত্তর লেখিতে শুরু করিলাম ,”ভদ্রে …
এই সময়ে মাসা আগাইয়া আসিল । রাগে অন্ধকারেও তাহার চক্ষু জ্বল জ্বল করিতেছিল । যেন সেখানে ফসফরাসের আগুনের মশাল জ্বালাইয়াছে !
কহিল, ” মিয়াউ, তোমার লজ্জা করেনা? হাসপাতালে একজন কাজ করিয়া মরিতেছে আর তুমি ফুর্তি লইয়া আছো।”
“সে কাজ করিতেছে তুমি তাহা জানিলে কি করিয়া ? সে কি তোমাকে ফোন করিয়াছে না টেকস্ট করিয়াছে ? হয়তো সে ক্লান্ত হইয়া ঘুমাইতেছে । ”
এই সময়ে যেন আকাশ ভাঙিয়া পড়িবার শব্দ হইল।
মাশা আমার উপরে হম্বি তম্বি করিলেও আসলে সে ভীতু, পটকার শব্দকে বোমার শব্দ বলিয়া ভুল করে সব সময়।
সে দ্রুত পলাইয়া গেল।
সকালে জানিতে পাইলাম আমার ভেনেজুয়েলায় প্রতিবেশী “হাভিয়ের” এর বাড়ীর চালে একখানা বিশাল বৃক্ষ শরীরের সমস্ত ওজন লইয়া ঝাপাইয়া পড়িয়াছে।
জানামতে ইহাই আমাদের পরিচিতদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্ষয়ক্ষতি।
তবে সে দু:খিত নয়, বহুদিন ধরিয়া তাহার চালাটি বদলানোর দরকার ছিল কিন্তু টাকা ছিলনা। ইরমা তাহার মায়ার হাতটি বাড়াইয়া দিয়াছে ।
এইবার সে ইনসুরেন্সের পয়সায় চালাটির নবায়ন করিতে পারিবে। ইনসুরেন্স একটি ক্যাপিটালিস্ট কনসেপ্ট। আমেরিকা কানাডা অস্ট্রেলিয়া ইওরোপে বসবাসকারী আমার বন্ধু বান্ধবেরা ক্যাপিটালিজম দেখিতে পারেনা, সহিতে পারেনা, উহাদের ঘেন্নায় গা রি রি করে।
আমি তাহাদেরই বন্ধু।
ক্যাপিটালিজমের প্রতি আমার গা ঘিন ঘিনে এলার্জী।
রাশিয়ায় পড়াশুনা করিয়া ক্যাপিটালিস্ট দুনিয়ায় বাস করিয়া বিষয়টি ধরিয়া ফেলিয়াছি , সমাজতন্ত্রের জয়গান গাইবার এবং ক্যাপিটালিজমের মা তুলিয়া গালি দিবার উপযুক্ত হল এই সব দেশ। সমাজতন্ত্রে বসিয়া সমাজতন্ত্র সম্পর্কে এমন কি গঠন মূলক সমালোচনার কথা স্বয়ং স্ট্যালিনও বলিবেননা। এইখানে বসিয়াই আমরা নিশ্চিত হইয়াছি যে বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের বিকল্প কিছু নাই।
ক্যাপিটালিজম আমাদের ঘাড়ে ধরিয়া কাজ করাইয়া ট্যাক্স কাটিয়া পকেটে সময় মতো বেতনটি পুরিয়া দেয়। সমাজতন্ত্রে বিষয়টি ঠিক ঐ রকম নয়, বেতন জুটিতে পারে , বেতও জুটিতে পারে।
তবে এই সব কথাকে শিবের গীত বলা হয়ে থাকে।
আমরা ইরমায় ফিরিয়া যাই।
সে বাংলাদেশের ১/১১ এর খলনায়কদের মত তর্জন গর্জন করিয়া যেথা যাইবার সেথায় চলিয়া গিয়াছে । যাহারা চিরকাল থাকিবার তাহারা থাকিয়া গিয়াছে।
এই সব ইরমা ফিরমা ১/১১ খালি খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলের কাটতি বাড়ায় । মারদাঙা না হইলে ফিল্মের যেমন মান বাড়েনা, ইরমা তাহার মারদাঙ্গা রূপটি হারাইয়া কান্না কুমারী শাবানায় পরিনত হইয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে। সাথে বিদ্যুত ও পানি লইয়া গিয়াছে ।
বিদ্যুত নাই তাই রান্না করিবার উপায় নাই, ফ্রিজের খাদ্য নস্ট হইয়া গিয়েছে। বাহিরে দোকান পাট রেস্টুরেন্টেও বন্ধ।
ইরমা ঠাট্টা মশকরার কারণে এখানে মূল্য পাইবেনা বলিয়া আমাদের সরাসরি না মারিয়া ভাতে মারিবার বন্দোবস্ত করিয়াছে। এখন খিচুরীর বদলে গরম সাওয়ার ক্রাউটের স্যুপও খাইতেও কোন আপত্তি নাই।
এক কাপ গরম কফি পাইলে, মাইকেল মধুসূদনের মত রুশিয়ার সিংহাসন বিলাইয়া দিতেও কোন আপত্তি থাকিবেনা।
এসি নাই , ঘরের ভিতরে নরক হাঁটিতেছে।
সাথে কিছু পোকা মাকড়।
জেনেরাটর কিনিয়া রাখিয়াছিলাম , তাহা ছাড়িয়া ফ্রিজ রক্ষা করিবার চেষ্টা করিয়াছি।
কিন্তু তাহার যে আওয়াজ তাহাতে আমাদের
কান ফাটিয়া প্রায় রক্ত বাহির হইবার উপক্রম হইছিল । তাহার ওপরে প্রতি ৫ মিনিট পরপর উহার সার্কিট ব্রেকার অফ হইয়া যাইয়া অমাদের অন্য কোন কাজ করিতে দিতেছিলনা। শেষ পর্যন্ত উহা বন্ধ করিয়া দিয়া যারপরনাই আরাম বোধ করিয়াছি।
আমাদের আশে পাশে প্রচুর মাছি ওড়া শুরু করিয়াছে। গোছলের অভাবে এক একেকজন পাকা কাঁঠালে পরিনত হইয়াছি। বাথরুমে যাইবার উপায় নাই , টিস্যুর আছে কিন্তু ফ্লাশ হয়না। বালতি ভরিয়া সুইমিং পুলের লবনাক্ত পানি দিয়ে বাথরুমকে গোছল করানো গেলেও নিজেদের পুলে নামা সম্ভব নয় কারণ গায়ে লবন থাকিয়া যাইয়া চুলকাইবে। তাহা ছাড়া পুলে দুই খানা কেউটে ছানাকে সাঁতরাইতে দেখিয়াছি। তাহারাও ইরমা পীড়িত বলিয়া বীরত্ব প্রদর্শন করি নাই ( অথবা ভয় পাইয়াছি)। আমার ছোট ভাইয়ের বৌ এমনিতেই মাছ মুরগী চিংড়ি গরু ছাগল ব্যাতীত সাপ খোঁপ ব্যাংঙ পিপড়া মাকড়সা তেলাপোকা ইত্যাদি জীব হত্যায় বিশ্বাস করেনা । আমিও তাহার মুরীদ হইয়া যাইবো ভাবিতেছি।
মানুষ মারিব কিন্তু পিপড়া মারিবনা।
বার্মার বৌদ্ধ হইয়া যাইবো।
আমার মেজোভাবী অবশ্য এই সব ইতর ( ?) প্রানীর ব্যাপারে “তাড়াতাড়ি সিস্টেম” পছন্দ করেন।
“তেড়ে মেরে ডান্ডা করে দেব ঠান্ডা। ”
তাহাকে বার্মার রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ করাইয়া দিতে পারিলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা যাইতো কি?
সুখবর এই যে তিনি আর ফিট হন নাই। টিভি বন্ধ করিয়া খুব করিয়া শাসাইয়া দিয়াছিলাম : “তুমি টিভি খুলিয়া আবার ইরমার সেন্ট মার্টিন ও কিউবার দক্ষযজ্ঞ দেখিবা তো তোমাকে কী ওয়েস্টে একেবারে ইরমার চোখের মধ্যে পাঠাইয়া দেব” ।
ইহা ম্যাজিকের মত কাজ করিয়াছে।
সকালে বাহিরে বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়া অজস্র ব্যাংঙ ডাকিতেছিল। ইহারা কোথা হইতে এত বিপুল সংখ্যায় আসিল বুঝিতে পারি নাই। ওকালা ব্যাংঙের কাউন্টি নয়, ঘোড়ার কাউন্টি। ব্যাংঙ বাড়িলে ঘোড়া কমিয়া যাইবার সম্ভাবনা রহিয়াছে । ঘোড়া কমিলে আমাদের ফরেন কারেন্সী কমিয়া যাইবে এবং সৌদী রাজকুমার গন ১৬ মিলিয়ন ডলার দিয়া একটি ঘোড়া কিনিয়া আমাদের বিশ্বমানের ঘোড়ায় চড়িবার সন্মান হইতে বন্চিত হইবেন।
ইরমা আমার মাথায় চাটি মারিয়া গিয়াছে। সব কিছু উল্টা পাল্টা হইয়া গিয়াছে। চিন্তার আগা মাথা নাই।
মাসা বিড়াল হইওয়াও অমানুষের মত কাজ করিতেছে। “প্লাইউড” দিয়া জানালা গুলো বন্ধ করিয়া দিবার কারণে দিনের বেলায়ও ঘরে অন্ধকার ঘুট ঘুট করে। মাসা সেই অন্ধকারে লুকাইয়া থাকে ,ডাকিলেও আসেনা।
মাশা যদি মেসেন্জারের কোন উর্বশী হইতো সে কি এমন নির্দয় ব্যবহার করিতে পারি তো? ভোরের রৌদ্রের মত কত সুন্দর সুন্দর কথা তাহার আঙ্গুল দিয়া বাহির হইতো না কি?
সেপ্টেম্বর ১২,২০১৭
ছবি:-hdfreewallpaper.net