ডিসেন্বরের শেষে কয়েকটা দিনের জন্য বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। সাথে ছিল আমার বাচ্চারাও। বাচ্চারা দীর্ঘ নয় বছর পর বাংলাদেশে গেলো। আমাদের ছেলে কাঙ্খিতর জন্মের পর পরই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লিয়েন নিয়ে সৌদি আরবের কিং খালিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাই। ওখান থেকেই আমরা সবাই পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট হিসাবে টরেন্টো চলে আসি। তাই কাঙ্খিতর বাংলাদেশের স্মৃতি নেই বললেই চলে। কাঙ্খিত এবং আমাদের মেয়ে শ্রেয়াকে নিয়ে খুবই আগ্রহ এবং উদ্দীপনা নিয়ে বাংলাদেশে পৌঁছালাম । টরেন্টো থেকে হংকং টানা পনেরো ঘন্টা প্লেন জার্নি – হংকংয়ে পাঁচ ঘন্টা ট্রানসিট। তারপর আবার পাঁচ ঘন্টা প্লেন জার্নির পর, ঢাকা। আমরা সবাই ভীষণ ক্লান্ত আর পরিশ্রান্ত ছিলাম এবং উন্মুখ হয়ে ছিলাম অপেক্ষারত আত্মীয় স্বজনের চেনা মুখ দেখার জন্য। একমুহূর্ত তর যেন আর কারো সইছিলো না। কিন্তু যাবো কিভাবে? লাগেজ তো আর আসে না। লাগেজ আসলো টানা তিন ঘন্টা পর। আসার পর দেখা গেলো আমাদের সব চেয়ে বড় লাগেজ যেটাতে আমাদের মা–বাবা, ভাই–বোন, দেবর–ননদ সহ অন্যান্য আত্মীয় স্বজন এবং বন্ধু বান্ধব সবার জন্যে অনেক যত্ন করে অনেক দিন বসে অনেক প্ল্যান করে কেনা, প্যাকেট করা এবং নাম লেখা গিফট সহ আরো অনেক এক্সট্রা গিফট দিয়ে ঠাসা ছিল, সেটাই আসেনি। কেমন লাগে? মাথায় তো আমার বাজে ভেঙে পড়লো। কি সর্বনাশ! আমার স্বামী এবং আমরা সবাই কত যত্ন করে, কষ্টার্জিত কত ডলার খরচ করে, সারা বছর ধরে এই গিফ্ট গুলো কিনেছিলাম। যে ডলার খরচ হয়েছিল তা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে গিফ্ট কিনলে আরো অনেক বেশি পরিমাণ কেনা কাটা করা যেত। কিন্তু আমাদের সবার এতো ভালোবাসা, এতো যত্ন তো আর ওই গিফ্টগুলোতে থাকতো না। তাই আমরা টরেন্টো থেকেই কিনেছিলাম ঐসব গিফ্ট। আরো ঘন্টা খানেক সময় লাগলো ব্যাগেজ ক্লেইম ফর্ম পূরণ করে দিয়ে আসতে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো– খালি হাতে কিভাবে যাবো সবার কাছে? বাচ্চাদের তো আর এইসব ভাবনা তেমন ছিল না, ওরা অধৈর্য্য হয়ে যাচ্ছিলো বাইরে আসার জন্য। তবে আনন্দের কথা, অনেক কাঠ–খড় পুঁড়িয়ে, অনেক চেষ্টা তদবির করে, এয়ারপোর্টের অনেক বন্ধু বান্ধবের সাহায্যে টরেন্টো ফিরে আসার ঠিক একদিন আগে আমার অতি প্রতীক্ষিত লাগেজটি ফেরৎ পেয়ে ছিলাম এবং সবাইকে আমাদের মমতা মাখা গিফট গুলো দিয়ে আসতে পেরেছিলাম।
এয়ারপোর্ট রোডে পুলিশদের কাঁধে রাইফেল দেখে আমার ছোট্ট ছেলেটি শিউরে উঠলো। ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে প্রশ্ন করলো– ‘” আম্মু পুলিশ কেন এতো বড়ো বড়ো গান ক্যারি করছে? ওরা কি এগুলো দিয়ে গুলি করে? নাকি এগুলো খেলনা বন্দুক? ওরা কি এগুলো ক্যারি করতে এবং গুলি করতে এলাউড ? মনে করো কোনো বৃদ্ধা মহিলার পার্স ছিনতাই হলো, তখন কি ওরা গুলি করে? ওরা কি মানুষের জীবন নিতে পারে? কখনো তো কোনোদিনও পৃথিবীর কোথাও সাধারণ পুলিশকে এমন গান ক্যারী করতে দেখিনি। আমি কি উত্তর দেব? বললাম– “না বাবা, এটা সিম্বলিক, ওরা গুলি করে না,ওরা জাস্ট ক্যারি করে। ” ” কিন্তু সেটা তো আরো ভয়ঙ্কর, বন্দুক দেখলে মানুষ তো পুলিশকে ভয় পাবে, বন্ধু ভাববে না, ভালো বাসবে না; তারা সত্যি যখন কোনো বিপদে পড়বে , পুলিশকে ডাকবে না , বলবেই না।” ভাবলাম হয়তো কাঙ্খিতই ঠিক বলেছে।
কাঙ্খিত পশু পাখি খুব ভালো বাসে। অনেক দিন ধরে একটা কুকুর পুষতে চায় | আমরা আনিনা। পৃথিবীতে কত মানুষ অনাহারে থাকে আর কানাডায় কুকুর বিড়ালের পিছনে মানুষ যে অর্থ, শ্রম আর সময় দেয় তা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য শুধুমাত্র তাঁদের জন্যই, যাঁরা একা থাকেন, নিঃস্বঙ্গতায় ভোগেন, আমাদের জন্য নয়, আমাদের জন্য ওটা বিলাসিতা। ঢাকার রাস্তায় ভোর রাতে এতো কুকুর – কাঙ্খিত বললো– ” আম্মু, রাস্তায় এতো কুকুর– কাদের কুকুর এগুলো? এদের মালিক কারা ? বললাম– এদের কোনো মালিক নেই। ও জিজ্ঞেস করলো– আমি কি একটা নিতে পারবো? আমার ছোট বেলায় পড়া ছোট গল্প পন্ডিত মশাই এর কথা মনে পড়ে গেলো। ইংরেজ আমলে লাট সাহেবের কুকুরের পিছনে যে টাকা খরচ হতো তা দিয়ে এই উপমহাদেশের কত শত পাঠশালার পন্ডিত মশাইদের বেতন সহ কত উন্নতিই না করা যেত! কাঙ্খিতাকে তো আর এইসব বলা গেলো না, শুধু বললাম– এই কুকুর গুলো বাসায় নেয়া নিরাপদ না, ভ্যাকসিন দেয়া নেই, কামড় দিতে পারে এবং কামড়ালে জলাতংক রোগ হতে পারে। ট্রাক ভর্তি জ্যান্ত ফার্মের মুরগি দেখে কাঙ্খিত বললো – এখানে রাজধানীতেও মুভিং ফার্ম করা যায়, তাই না? এড়িয়ে গেলাম, কোনো উত্তর দিলাম না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোকজন পেশাব করছে দেখে ছেলে বললো– আম্মু, পাবলিক টয়লেট নেই? রাস্তা তো নোংরা হয়ে যাচ্ছে। মেয়েদেরও কি এভাবে পেশাব করতে হয়? ও আবার কানাডিয়ানদের মতো– সব কিছুতেই আগে মেয়েদের কথা ভেবে কাজ করতে হবে। আমার মেজাজ এতো বিগড়ে ছিল– সব গিফট হারিয়ে গেছে, কাঙ্খিত র এইসব নানান প্রশ্নের উত্তর দিতে মন চাইছিলো না। আমাদের সামনে চলমান বড়ো এক সব্জির ট্রাকের পিছন দিয়ে ছোট একটি ছেলে লাফ দিয়ে উঠলো দেখলাম. এবং মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা আর এক লোক দেখলাম জুতো দিয়ে লাফিয়ে উঠা ছেলেটার মাথায় কষে বাড়ি দিলো। কাঙ্খিত চিৎকার করলো– কেন মারছে ছেলেটাকে? আমিও ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। ড্রাইভার স্বপন ভাই বললো ‘ ও লাফ দিয়ে উঠেছিল সবজি চুরি করার জন্য, ওতো আর জানতো না যে ট্রাকের মধ্যেই কেও একজন শুয়ে আছে! কাঙ্খিত খুব মন খারাপ করে বললো– সামান্য কিছু সবজি চুরি করে ওর কি আর লাভ হবে? ও নিশ্চয়ই খুব ক্ষুধার্ত এবং অভাবী ; সরকার কেন ওকে সাহায্য করে না? ও কেন ফুড ব্যাংকে যায় না। শ্রেয়া ওর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলো, আমাকে আর দিতে হচ্ছিলো না।
ঢাকায় পৌঁছানোর পরের দিনই রাতে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী শিখার বাসায় গেলাম। অনেক দিন পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নওয়াব ফয়জুন্নেসা হলের আমার অনেক প্রিয় বান্ধবীরা এবং ওদের পরিবারের সাথে খুব সুন্দর একটা সময় কেটেছে। ঐদিন মনে হয়েছিল আমরা যেন আবার সেই হলের জীবনে ফিরে গেছি।
আমার মা–বাবা থাকেন খুলনা আর শশুর বাড়িও খুলনায়। তাই আমাদের অনেকটা সময় কেটেছে খুলনায়। সুন্দরবন দেখানোর জন্য খুলনা থেকে সাতক্ষীরা গিয়েছিলাম। আমাদেরকে যিনি সুন্দরবন দেখতে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি আলিম চাচা (কাল্পনিক নাম) খুব বিত্তশালী এবং প্রভাবশালী। উনি ঢাকাতেই থাকেন, শুধুমাত্র আমাদেরকে সুন্দরবন দেখাতে নিয়ে যাবেন বলে সাতক্ষীরা চলে গেলেন |আমার বাবা ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে সাতক্ষীরা চাকরি করতেন, তখন আমরা সাতক্ষীরা থাকতাম আর এই আলিম চাচা তাঁর মাছের এবং বিভিন্ন ধরণের ব্যবসা শুরু করেছিলেন সেই সময়। তখন থেকেই ওনারা আমাদের পারিবারিক বন্ধু। নির্দিষ্ট দিনে সাতক্ষীরা থেকে ভোর রাতে একজন ড্রাইভার একটি কালো ঝকঝকে সিআরভি নিয়ে আম্মার বাড়ির সামনে হাজির। আমরা সিআরভিতে উঠলাম। কাঙ্খিত ওর প্রিয় ছোট মামার সাথে আর একটা ছোট সাদা গাড়িতে উঠলো। আমার ছোট ভাই মাসুম সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনে মিনিস্টার হিসাবে কর্মরত। ও সিঙ্গাপুর থেকে এসেছিলো। ও সবসময় নিজেই গাড়ি চালায়– ড্রাইভারদের গাড়ি চালানো ওর পছন্দ না। আমরা সাতক্ষীরা পৌঁছানোর টানা দুই ঘন্টা পর কাঙ্খিতরা সাতক্ষীরা পৌঁছালো। রাস্তা এতো খারাপ কল্পনার অযোগ্য। আমাদের ড্রাইভার বাচ্চু ভাই যে গতিতে যে ভাবে, ইমার্জেন্সি হর্ন বাজিয়ে, কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে, ভীষণ বিপদজনক ভাবে বাতাসের গতিতে এইসব ভাঙাচোরা রাস্তা পার হয়ে চলে এসেছে, মাসুম তো আর তা করে নি। বাচ্চু ভাইকে নিষেধ করলেও উনি শুনছিলেন না, ভয়ে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো, অথচ বাচ্চু ভাই ভাবছিলো, আমরা বোধ হয় ওনার অর্থাৎ আলিম চাচার ক্ষমতা দেখে খুব খুশি হচ্ছিলাম।
সে যাই হোক, সাতক্ষীরা পৌঁছানোর পর আলিম চাচা বললেন, মাসুমের ছোট গাড়িতে মুন্সীগঞ্জে যাওয়া যাবে না, আরো একটা সিআরভি নাও। তো শুরু হলো যাত্রা, দুইটা সিআরভি নিয়ে মুন্সীগঞ্জের পথে। মুন্সীগঞ্জ থেকে লঞ্চে সুন্দরবনের ভিতরে গিয়েছিলাম। চলার পথে চোখে পড়লো সারি সারি মাটির ঘর, বড়ো বড়ো চিঙড়ি মাছের ঘের। আমার এবং মাসুমের দুজনেরই মন খুব খারাপ ছিল – বিশ্ব যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, আমাদের দেশ সেই গতিতেই পিছিয়ে যাচ্ছে। অভূক্ত, বস্ত্রহীন, কঙ্কালসার শিশুরা মাটির ভাঙা রাস্তা ধরে দৌড়ে চলে আসে গাড়ি দেখার জন্যে। মাছের ঘেরে, ইটের ভাঁটায়, রাস্তায়, পানের বরজে মহিলারা বাচ্চা কোলে কাঁধে নিয়ে কি অমানুষিক পরিশ্রম করেও মজুরি বৈষম্যের শিকার। কর্ম সংস্থান বা আয় রোজগারের কোনো ব্যবস্থা নেই, শহর এবং গ্রামে সবখানেই অধিকাংশ মানুষ শুধু একবেলা খেয়েই জীবন কাটাচ্ছে, লেখাপড়া বা স্বাস্থ্য সেবার কথা তো বাদই দিলাম। পাকা বাড়ি চোখেই পড়ে না। আমরা ছোট বেলা যে হেলিকপ্টার(বাইসাইকেলের পিছনে তক্তা বসিয়ে সিট্ বানানো এবং তাতে করে যাত্রী পরিবহন করা হতো) আর দেখলাম না। সরকারি হাসপাতালে গিয়েছিলাম আমার বান্ধবী ডাক্তার, ও মেডিকেল কলেজে পড়ায়, বিকালে প্রাইভেট প্রাকটিস করে ; ওর সঙ্গে দেখা করতে। হাসপাতালে দরিদ্র রোগীদের অবস্থা চোখে দেখার মতো নয়। কি ভাবে বারান্দায়, রাস্তায় অসহায় মুমূর্ষু রোগীরা কাতরাচ্ছে, পাশে তাদের আত্মীয় স্বজন কাঁন্নাকাটি করছে , কেও নেই দেখার। এইসব রোগীদের সামর্থ নেই প্রাইভেট ক্লিনিক বা হাসপাতালে চিকিৎসা করাবে ।
যাই হোক , মুন্সীগঞ্জে রেস্ট হাউসে পৌঁছানোর পর দেখলাম খালি পায়ে একটি ছেলে হুঁহুঁ করে কাঁদছে; কারণ আমাদের কোনো একজন ড্রাইভার ভাই রাস্তায় তার ছাগল চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছে। আলীম চাচা বললেন – ‘ এই বাচ্চু, পাঁচ হাজার টাকা দে বিদেয় করি দেদিন, আর সহ্য হতিস না। শিগগির দূর কর ওরে ইখানতে নালি কিন্তু একদম মেরি পাটাই ফেলবানে। ” কাঙ্খিত খুব মন খারাপ করে আমাকে আস্তে আস্তে বললো– ইশ! ওর আদরের পোষা ছাগলটা মেরে ফেলেছে, ওর নিশ্চয়ই খুব মন খারাপ, তাহলে আবার ওকে উল্টো বকা দিচ্ছে কেন? ড্রাইভারের বিরুদ্ধে তো ক্রিমিনাল রেকর্ড হবে এবং লাইসেন্সও বাতিল হয়ে যাবে তাই না? শ্রেয়া বললো– চুপ থাকো, বোকা, তুমি এদেশের কিছুই জানো না।
সুন্দরবন দেখে সাতক্ষীরা পৌঁছানোর পর, কাঙ্খিত এবং শ্রেয়া দৌড়ে ওদের মামার গাড়ীতে উঠলো-” মামা, আমরা আপনার গাড়ীতে যাবো আপনার সঙ্গে যাবো, আমরা আর সিআরভিতে উঠতে চাই না, আমরা বড়ো গাড়ীও চাই না, তাড়াতাড়িও যেতে চাই না। বাচ্চু চাচা যেভাবে মিথ্যা ইমার্জেন্সি হর্ন বাজিয়ে, কোনো স্পিড লিমিট আর আইন কানুন না মেনে, রাস্তা–ঘাট ভেঙে চুরে গাড়ী চালায় তা কোনোভাবেই সহ্য করা যায় না।“
খুলনাতে আত্মীয়–স্বজন বন্ধু–বান্ধবের বাসায় গেলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যাঁরা খুলনা থাকেন তাদের একটা অনুষ্ঠানে আমাকে সম্বর্ধনা দিলো, গেলাম ক্রিসেন্ট জুট মিলের অফিসার্স ক্লাবে। আমার শ্বশুর বাড়ি সৈয়দমহল্লা গেলাম, আমার শ্বশুর–শাশুড়ির কবর জেয়ারত করলাম। খুলনায় আমাদের বাড়ীতে যাঁরা সবসময় দৈনন্দীন কাজে সাহায্য করতেন, তাঁরাও এসেছিলেন দেখা করতে। আরো বেশি শীর্ণকায় এবং যেন ছোট হয়ে গেছে তাদের এবং ওঁদের বাচ্চাদের শরীর। আগে দুবেলা ভাত খেত, এখন একবেলা খাবারও পায় না। স্বামীরা রিক্সা চালাতো, এখন ইজি বাইক আসাতে আয়রোজগার নেই বললেই চলে।
এরপর গেলাম যশোর। আমার নানাবাড়ি। ওখানে আমার নানী– যাঁর বয়স ৯৫ বছর, তাঁর সঙ্গে দেখা করে দোআ নিলাম। আমার বড়ো ভাই এবং নানার কবর জেয়ারত করলাম। আমার খালা–মামা যারা যশোর থাকেন সবার সাথে দেখা হলো। ওখান থেকে গেলাম আমার দাদার পৈতৃক বাড়ি মনিরামপুর, দাদা–দাদির কবর জেয়ারত করলাম। সাতক্ষীরা এবং যশোর ভ্রমণের পুরোটা সময়ই আমার বাবা–মা আমাদের সঙ্গে ছিলেন।
যশোর, খুলনা এবং সাতক্ষীরা বেড়িয়ে আবার ঢাকায় গেলাম সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন পলিসি নিয়ে সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপনাকরলাম । ঐদিনই আমার স্কুল জীবনের বান্ধবীদের সাথে ধানমন্ডিতে গুলশানের বাসায় একত্রিত হলাম অনেকদিন পর। আমাদের বাচ্চারা খুব মজা করেছিল ওই দিন। ঢাকায় আমার ভাই, দেবর, মামা–খালা সহ আরো অনেক আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধু–বান্ধবের বাসায় গেলাম– সবার আতিথেয়তা ভোলার নয়। সময় স্বল্পতার কারণে অনেকের বাসায় যেতে পারি নি, ফোনে কথা বলেছি– ওনারা এসেছিলেন দেখা করতে– আমরা কৃতজ্ঞ সবার কাছে।
ইংরেজ, নবাব, জমিদার, পাকিস্তানী কেও নেই এখন বাংলাদেশে– বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। তাতে কি? আমার আব্বার বন্ধু আলীম চাচাদের মতো অনেক লোক আছে বাংলাদেশে যাদের অনেক টাকা, তাই অনেক পাওয়ার, তাই যা ইচ্ছা তাই করে ফেলতে পারে বাংলাদেশে। গরীবের রক্ত চুষে, কর ফাঁকি দিয়ে অবৈধ টাকার পাহাড় যারা বাংলাদেশে বানিয়ে ফেলেছে তাদের কাছে বাংলাদেশ সহ পুরো পৃথিবীই স্বর্গপুরী। এরা তাদের নিজস্ব এলাকায় এবং রাজধানী ঢাকা সহ বিভিন্ন উন্নত দেশেও তাদের আবাসস্থল তৈরী করে রেখেছে– কোনোখানেই তাদের কোনো সমস্যা হয় না।
ঢাকার গুলশান, বনানীতে যখন গেছি, কাঙ্খিত প্রশ্ন করেছে– এদিকের রাস্তাঘাট তো অনেক বড়, পরিষ্কার, যানজটও তেমন নেই, অথচ ঢাকারই অন্যান্য জায়গায় কেন এতো যানজট? বিশ মিনিটের পথ যানজটের কারণে যখন আমরা তিন ঘন্টারও উপরে বসে থেকেছি, আমার বাচ্চারা তখন বলেছে– চলো রিকশায় বা হেঁটে যাই– নিরাপত্তার কথা ভেবে সাহস পাই নি।
বাংলাদেশেরই কিছু মানুষ দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে, ব্যাগ ভর্তি টাকা বা ক্রেডিট কার্ড নিয়ে নাম করা সব রেস্তোরায় খাওয়া দাওয়া করছে, শপিং করছে , অভিজাত এলাকায় বসবাস করছে, প্রশাসন, পুলিশ, সবাই তাদের হুজুর হুজুর করছে, তারা আইন মানে না, মানতে হয় না। কিন্তু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে, নিষ্পেষণের যাঁতাকলে তারা পিষ্ট হচ্ছে, শোষিত হচ্ছে , ধনী দরিদ্রের বৈষম্য ক্রমাগত ভাবে বেড়েই চলেছে। আর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অধিকাংশ ভাগ হয়ে যাচ্ছে দুই দিকে– হয় নিঃস্ব নয় শোষকদের দলভূক্ত হচ্ছে। ভালো লাগে নি এসব দেখে– আমাদের প্রিয় জন্মভূমি, মাতৃভূমি, আমরা কানাডা থাকলেও আমাদের মা–বাবা, আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সবাই যে থাকে বাংলাদেশে। ওদের তো অনেক কষ্ট, সাথে সাথে আমাদেরও কষ্ট বাড়ে, অসহায় লাগে নিজেদের।
টরেন্টোতে প্লেন থেকে নামার ঠিক সাত মিনিট পর আমাদের লাগেজ আসা শুরু করলো। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে –৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা, কনকনে ঠান্ডা , চারিদিক বরফে ঢাকা ধূসর নগরীতে আসলাম। পিছনে ফেলে আসলাম সবুজ শ্যামলিমায় ঘেরা আমাদের ছোট্ট, প্রিয় বাংলাদেশ আর কোটি কোটি আপন জনের প্রিয় মুখ। ফেরার পথে আমার বাচ্চারা গাড়িতে, প্লেনে বারবার শুধু আমার চোখ মুছিয়েছে আর বলেছে– কাঁদে না আম্মু। আমরা নৌকায় চড়েছি, সর্ষে ফুলের মাঠে গিয়েছি, আত্মীয় পরিজনের একদম কাছে গিয়েছি ; চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, ডায়রিয়া এসবের চিন্তা করে নিজে এবং বাচ্চাদেরকে বলেছিলাম খুব সাবধানে খাওয়া–দাওয়া করতে। লাভ তেমন হয় নি। বাচ্চারা আমাকে লুকিয়ে সেমাই পিঠা, ভাঁপা ও কুলি পিঠা , দোকানের চটপটি, ফুচকা, চানাচুর সব খেয়েছে । আর আমিও বাচ্চাদের লুকিয়ে, মুড়ি দিয়ে কাঁচা রস, রসের পায়েস, রস পিঠা , রাস্তার পাশের কাঁচের গ্লাসে চা এসব খেয়েছি। ওতে যে কি স্বাদ তা শুধু যে খায় সেই বোঝে। সময়ের অভাবে সড়ক পথে আমার প্রিয় জন্মস্থান যশোর রোডের গাছ দেখতে দেখতে ঢাকা থেকে খুলনা যেতে পারি নি; টরেন্টো এসে শুনলাম যশোর রোডের অপূর্ব সুন্দর গাছগুলো নাকি কেটে ফেলা হবে। কিছুতেই তা হতে দেয়া যাবে না। আমরা প্রতিবাদ করবো, টরেন্ট থেকেই বাংলাদেশের প্রতিবাদকারীদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করছি। সিনেট নির্বাচনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যারিকেটের কারণে আমার বাচ্চাদেরকে আমার এবং আমার স্বামীর প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যেতে পারি নি। দেখি এর পরের বার যাবো হয়তো। চেয়ে থাকলাম কবে আবার যাবো আমার জন্মভূমি বাংলাদেশে।
মাহমুদা নাসরিন রেগুলেটেড কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট এন্ড কমিশনার অফ অথস , ক্যানবাংলা ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস, টরেন্টো, কানাডা। [email protected]