নিউ ইয়র্ক থেকে:-

sinha4a

স্মৃতির শহর কলকাতা!
কাঠমুন্ডু থেকে আমরা উড়ে এলাম কলকাতা, দমদম এয়ারপোর্টে। কলকাতায় আমি আগেও এসেছি। এই শহরকে ঘিরে আমার অনেক স্মৃতি!

দমদম থেকে ট্যাক্সি ধরে হাওড়া।হাওড়া নেমেই ভিখিরিদের জটলা।মনে পডলো নীরার কথা!

‘নীরা, তুমি নিরন্নকে মুষ্টিভিক্ষা দিলে এইমাত্র
আমাকে দেবে না?
শ্মশানে ঘুমিয়ে থাকি, ছাই-ভস্ম খাই, গায়ে মাখি
নদী- সহবাসে কাটে দিন
এই নদী গৌতম বুদ্ধকে দেখেছিল
পরবর্তী বারুদের আস্তরণও গায়ে মেখেছিল
এই নদী তুমি’!

সকালের হাল্কা রোদে হাওড়া ব্রিজ ধরে বেরিয়ে যাচছে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে।পেছনে কলকাতা শহর।আবারো মনে পডলো নীরার কথা!

‘এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে আর কোনোদিন
পাপ করতে পারি ?

এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে , ভালোবাসি–
এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায় ?
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়ে ভীষণ জরুরী
কথাটাই বলা হয়নি
লঘু মরালীর মতো নারীটিকে নিয়ে যাবে বিদেশী বাতাস
আকস্মিক ভূমিকম্পে ভেঙ্গে যাবে সবগুলো সিঁড়ি

থমকে দাঁড়িয়ে আমি নীরার চোখের দিকে….
ভালোবাসা এক তীব্র অঙ্গীকার, যেন মায়াপাশ
সত্যবদ্ধ অভিমান–চোখ জ্বালা করে ওঠে,

সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি–
এই ওষ্ঠে আর কোন মিথ্যে কি মানায়’?

স্মৃতির শহর কলকাতা! জোব চারনকের শহর কলকাতা!
সুনীলের শহর।
নীরার শহর।
আর জ্যাতিবসুর শহর এই কলকাতা! গঙ্গার ধারে, ইডেন গার্ডেনে আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে!কত ঘুরেছি।চষে বেরিয়েছি শেকসপীয়র সরণি থেকে রবীন্দ্র সরণি।আড্ডা মেরেছি নিউমার্কেটে। ঘুরে বেড়িয়েছি নূতন শহর সল্টলেক সিটি।সেই গল্প আরেকদিন করবো। আজ আমরা যাবো রবী ঠাকুরের শান্তিনিকেতনে।সেই উদ্দেশ্যেই হাওড়া থেকে চেপে বসলাম শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে। যাবো হাওড়া থেকে বোলপুর। দূরত্ব প্রায় ১৪০ কিলোমিটার।

শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস,হাওড়া ছেরেছে সকাল ১০টা ১০মিনিটে।সাডে এগারোটা নাগাদ পৌছুলো বর্ধমান।এই বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জনমেছিলেন আমাদের জাতীয় কবি নজরুল। আসানসোলের একটি চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজও করেছিলেন কিছুদিন।বর্ধমানে ট্রেন থামলো দশ মিনিট।মাটির ঘটায় করে চা আনলো দোকানীরা ট্রেনের জানালায়।ওই চা অমৃতের মত!

ট্রেন থেকে নেমে গেলেন অনেকেই।নূতন করে উঠলেন দু’জন।গেরুয়া রংয়ের পোষাক,গলায় মালা, হাতে দোতারা।ওরা বাউল!ট্রেন ছাডলো বোলপুরের দিকে।ট্রেনের ঝিক ঝিক শব্দ ছাপিয়ে কানে আসছে লালন শাহের গান:

‘আসবার কালে কি জাত ছিলে
এসে তুমি কি জাত নিলে
কি জাত হবে যাবার কালে
সে কথা ভেবে বল না
জাত গেল, জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা!

ব্রা’ন, চণ্ডাল, চামার, মুচি
একজলে হয় সব হয় গো সুচি
দেখে শুনে হয় না রুচি
জমে তো কাউকে ছাড়বে না
জাত গেল জাত গেল বলে…’

মা বসেছেন জানালার পাশে।তার দৃসটি উদাস!উদাস হলো আমারো মন।জানালা দিয়ে আমি তাকিয়ে আছি বাইরে।পথ-প্রানতর আর দু’পাশের জনপদকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে শান্তি নিকেতন এক্সপ্রেস।মনে পডলো বহুদিন আগে একবার গিয়েছিলাম লালনের আখড়ায়।লালন-উৎসবে।ওখানে এক লালন-প্রেমিককে আমি জিজ্ঞেশ করেছিলাম, ‘আপনি হিন্দু না মুসলমান’?
লালন-প্রেমিক নিরুত্তর!
আমি আবারো জিজ্ঞেশ করলাম, ‘আপনি হিন্দু না মুসলমান’?
লালন-প্রেমিক নিরুত্তর!
তৃতীয়বার আবারো জিজ্ঞেশ করলাম, ‘আপনি হিন্দু না মুসলমান’?
লালন-প্রেমিক এবার উত্তর দিলেন। তিনি বললেল:
‘আমি না মুসলিম, না হিন্দু।না ধনী, না গরীব। সবই এক। মনি থেইক্যা হয় রতি।রতি থেকে মতি।মতি থেকে মানুষ। মনি, রতি, মতি ও মানুষ। এই একটাই পথ’!

ট্রেন যখন বোলপুরে এসে থামলো তখন সময় দুপুর একটা বিশ।বোলপুর থেকে শান্তিনিকেতন এর দূরত্ব দু’কিলোমিটার, আমরা যে টুরিষ্ট লজে উঠবো বলে মনস্থির করেছি ওটার দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। রিকসা নিয়ে আমরা আগালাম ট্যুরিষ্ট লজের দিকে।

sinha4c

যাওয়ার পথে একটি তোরন চোখে পডলো।ওখানে বড বড করে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাণী:
‘আমাদের শান্তিনিকেতন সে যে সব হতে আপন
তার আকাশ ভরা কোলে মোদের হৃদয় দোলে
মোরা বারে বারে দেখি তারে
নিত্যই নূতন’!

 

ট্যুরিষ্ট লজে লাঞ্চ সেরে একটু রেষ্ট নিয়ে নিলাম। তারপর ধীরে ধীরে পা বাড়ালাম শান্তিনিকেতনে। আমরা যখন শান্তিনিকেতনের ক্যাম্পাসে ঢুকছি ততক্ষণে প্রায় চারটা বেজে গেছে।

ভূবনডাঙ্গা থেকে শান্তি নিকেতন!
যারা শান্তিনিকেতনে বেড়াতে আসেন সবাই চলে যান মূল ক্যাম্পাসে, আমরা মূল ক্যাম্পাসে না গিয়ে চলে এলাম ছাতিমতলায়। কেন? কারণ এই ছাতিমতলাতেই শান্তিনিকেতন শুরু। শান্তিনিকেতনের বীজটা এখানেই বপিত হয়েছিল!

আদিতে শান্তিনিকেতনের নাম ছিল ভুবনডাঙ্গা। জমিদার ভুবন সিংহের নামানুসারে এই নাম।এই সিংহ পরিবারের সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিলো। একবার তিনি নিমন্ত্রণ রক্ষায় সেখানে গেলে ভুবনডাঙ্গায় রাত হয়ে যায়। দৈবক্রমে সেদিন ছিলো জ্যোৎস্না রাত।মাঠের মধ্যে ছিলো কতগুলো ছাতিম গাছ। অপূর্ব সেই দৃশ্য।এই নৈসর্গিক দৃশ্যে অভিভূত হয়ে তিনি ভুবনডাঙ্গার প্রেমে পড়ে যান।১৮৬৩ সালের ৩১শে মার্চ তিনি কুড়ি বিঘা জমি পাঁচ টাকায় পাট্টা নিলেন জমিদার ভুবন সিংহের কাছ থেকে।ছাতিমতলাতেই তিনি গড়ে তোলেন এক আশ্রম। পাশে একটি বাডী যার নাম ‘শান্তিনিকেতন’! কালের প্রবাহে ভুবনডাঙ্গা থেকে এলাকাটির নাম হয়ে যায় ‘শান্তিনিকেতন’!

অর্থ, বিত্ত, যশ, প্রতিপত্তি কোনটারই কমতি ছিলনা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের। অথচ সময় পেলেই তিনি সূদুর কলকাতা থেকে ছুটে আসতেন অখ্যাত ভুবনডাঙ্গায়। নিরিবিলিতে ছাতিম তলায় বসে ধ্যান করতেন। এখানে আসলে তিনি আত্মার শান্তি পেতেন।পরবর্তীতে এই বাবার হাত ধরেই বারো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথম বেড়াতে আসেন শান্তিনিকেতনে। বাবার মত তিনিও ভালবাসতে শুরু করেন লাল মাটির এই ভূমি ও তার চারপাশের সবুজ নির্জনতাকে।

১৮৮৮ সালের ৮ই মার্চ দেবেন্দ্রনাথ ট্রাস্টি চুক্তির মাধ্যমে শান্তি নিকেতনকে সবার জন্য উন্মুক্ত করেন। এরপর এখানেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০১ সালে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যদিও এর উদ্যোক্তা ছিলেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই বিদ্যালয়ের প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন ব্রক্ষ্মবান্ধব উপাধ্যায় আর ছাত্র হিসেবে ছিলেন গৌরগোবিন্দ গুপ্ত, প্রেমকুমার গুপ্ত, অশোককুমার গুপ্ত, সুধীরচন্দ্র, গিরিন ভট্টাচার্য, যোগানন্দ মিত্র, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরবর্তীতে কালের পরিক্রমায় এখানে ১৯২১ সালে বিখ্যাত বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

sinha4b

ছাতিম তলায় রয়েছে একটি সুন্দর বেদী। বেদীর উপরেই ঝুঁকে আছে ছাতিম গাছ। মূল বেদীর পাশেই রয়েছে কারুকার্য খচিত আরেকটি বেদী। সেখানে বড় বড় হরফে লেখা:

‘তিনি
আমার প্রাণের আরাম
মনের আনন্দ
আত্মার শান্তি।’

ছাতিম তলায় কোন কোলাহল নেই, আছে নিরবিচ্ছিন্ন নীরবতা আর শ্রান্তি!
পুরো এলাকাটিতে প্রচুর গাছ গাছালি।
গাছের মধ্যে ‘সপ্ত পার্নি’ নামে একটি গাছের আধিক্য দেখলাম। পরে জেনেছি প্রতি বছর বিশ্ব ভারতীর নতুন স্নাতকদের এই গাছের পাঁচটি পাতা সহ একটি ডাল উপহার হিসেবে দেয়ার রীতি ছিল। ছাতিমতলায় আমরা কিছু সময় কাটালাম।তারপর সেখান থেকে আমরা চলে এলাম শান্তিনিকেতন ভবনে।

শান্তিনিকেতন ভবন।
এটি আশ্রমের সবচেয়ে পুরনো বাড়ি। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৪ সালে এই বাড়িটি তৈরি করিয়েছিলেন। বাড়িটি দালান বাড়ি। প্রথমে একতলা বাড়ি ছিল। পরে দোতলা হয়। বাড়ির উপরিভাগে খোদাই করা আছে:

‘সত্যাত্ম প্রাণারামং মন আনন্দং’!

এটি উপনিষদের একটি উক্তি।তিনি নিজে বাড়ির একতলায় ধ্যানে বসতেন। তাঁর অনুগামীরাও এখানে এসে থেকেছেন। কৈশোরে বাবার সঙ্গে হিমালয়ে যাওয়ার পথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে কিছুদিন বাস করেন। ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় স্থাপনের সময়ও রবীন্দ্রনাথ কিছুকাল সপরিবারে এই বাড়িতে বাস করেছিলেন।পরে আর কখনও তিনি এটিকে বসতবাড়ি হিসেবে ব্যবহার করেননি। এখন বাড়িটির সামনে রামকিঙ্কর বেইজ নির্মিত একটি বিমূর্ত ভাস্কর্য রয়েছে।

আমাদের স্থানীয় গাইড সুদ্বীপ বাবু জানালেন, দেবেন্দ্রনাথ তিনটি স্ট্রাকচারে বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। ভবনটি একেকদিক থেকে দেখলে একেক রকম মনে হবে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, সত্যিই তো। একদিক থেকে দেখলে মনে হচ্ছে মন্দির, অন্য দিক থেকে দেখলে মসজিদ, আরেক দিক থেকে দেখলে গির্জা।কেউ কেউ অবশ্য বলেন বাড়িটি পাঁচটা ধর্মের স্ট্রাকচারে করা।
শান্তিনিকেতন ভবন থেকে হাটতে হাটতেই আমরা এসে দাঁড়ালাম উপাসনা গৃহ বা ব্রাহ্ম মন্দিরের সামনে।

উপাসনা গৃহ বা ব্রাহ্ম মন্দির!
১৮৯২ সালে এই মন্দিরের উদ্বোধন করা হয়। এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র দিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।এটি কাঁচের তৈরি সুন্দর ছিমছাম একটি ঘর। জীবদ্দশায় এখানে প্রার্থনা করতেন রবীন্দ্রনাথের বাবা এবং রবীন্দ্রনাথ নিজেও। প্রার্থনা ঘরে এখনও নিয়মিত প্রার্থনা হয়। প্রতি বুধবার ‘সংগীত ভবন’ এর ছাত্রছাত্রীরা এখানে সমবেত প্রার্থনা সংগীত করেন।

স্মৃতি বিজরিত এইসব জিনিস দেখতে দেখতে এতোই বিভোর ছিলাম কখন যে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে তা খেয়ালই করিনি!হাটতে হাটতেই ফিরে এলাম আমাদের ট্যুরিষ্ট লজে।
কাল আবার যাবো মূল ক্যামপাসে!

চলবে… … …

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন