ফ্লোরিডা থেকে:- (রজকীনি ও চন্ডিদাস)
দুর্গাপুজার সময়ে শান্তিনিকেতন এলাম সেই কতদূর থেকে। ফ্লোরিডার ইরমা-মারিয়ার রক্তজবা চোখ আর ছিনালী চুম্বন এড়িয়ে , উটের পিঠে দুবাইয়ের তপ্ত লাল ও সাদা বালুর মরুভূমি পার হয়ে ।
ভাবলাম অবগাহন করবো রবীন্দ্র স্মৃতি সরবরে। টোকা দেব সেই সব দ্বারে যেখানে রয়েছে কবিগুরুর স্পর্শ!
কিন্তু বন্ধ সব কিছুই ।
সৃজনী গ্রাম দেখেছিলাম গতকাল, আজ ঘুরলাম জনমানবহীন শান্তি ও শ্রীনিকেতন।
ঘুরে ফিরে যতটুকু সম্ভব দেখলাম।
রামকিংকর বেজের ভাস্কর্য্য, আম্রকুন্জ আর বকুল তলা, শালবিথি, দেবালয়, আর কবিগুরুর বাসস্থান সমুহ ।
বট, ফলবন্ত ও পুস্পিত নাগলিঙ্গম, দুটা একটা ফুল ঝরানো বকুল ,মহুয়া , আমলকি ,পুস্পিত সেগুন ,কন্টকিত বাবলা এবং আরও কত কত গাছ নিয়ে এই শান্তির নীড়!
ফুলে ফুলে হেসে উঠেছে ছাতিম গাছ।
এমনি এক ছাদিম তলায় বিশ্রাম নিয়েছিলেন মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তখনই তার ইচ্ছা জেগেছিল শান্তিনিকেতন তৈরী করার।
এই ইতিহাস সবার জানা কিন্তু ছাদিম গাছে তখন ফুল ধরেছিল কিনা এই প্রশ্নের উত্তরটি আমার জানতে ইচ্ছে হয়।
কিন্তু উত্তর দেবার মানুষ নেই।
হাবিয়া দোযখ থেকে গরম নেমে এসেছে হাঁসের পায়ের মত সংযুক্ত বাতাসহীনতা নিয়ে।
স্বেদসিক্ত এক অতৃপ্তি ঠোকরাচ্ছে বুকের অন্তস্থল।
আমার বড় ভাই বলেন ,”চল্ নানুরে যাই।”
“নানুর কি ?”
আমি জীবনে কোন দিন এমন কোন শব্দ শুনিনি।
ভাই, মো: শাহজাহান মিয়া, যে মুন্সীগন্জের হরগঙ্গা কলেজে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য পড়িয়ে কর্মজীবন শেষ করেছে এবং এখন বিক্রমপুরের পথে পথে ইতিহাসের মনি মানিক্য খোঁজে, গল্প ফাদে।
ব্রাহ্মণ ঠাকুর এক রজকিনীর প্রেমে মুগ্ধ হয়ে প্রতিদিন বড়শী পেতে বসে থাকতো দীঘির ধারে যেখানে রজকিনী কাপড় ধুইতে আসতো। রজকীনি পরিশ্রমী ও সোমত্তা।
রজকীনি সুন্দর!
তাদের মধ্যে কথা বার্তা, চিঠি চালাচালি, “টেকস্ট”, “ভাইবার”, “ওয়াটস আপ ” কিছুই হতোনা।
মধ্যযুগ ব্যাপারটাই কেমন আজগুবি নৈ:শব্দে পরিপূর্ণ।
দিন বসে থাকেনা।
চলে যায় নানুরের চন্চল বাতাসের পথ ধরে।
অবশেষে নক্ষত্র সংযোগ হয়, রজকিনী এগিয়ে আসে :
“কি ঠাকুর ১২ বছর ধরে বড়শী পেতে বসে আছো , মাছে ঠোকর দেয়?”
“এই প্রথম ঠোকরটি দিল।” ঠাকুর হেসে বলে।
মধ্য যুগে বাংলাকে পাগল করে ছিল, পাগল করে চলেছে আজো সেই ঠাকুর। বীরভূমের নানুর গ্রামে মৃত্যুর নয় বছর পরে হয়তো সেই পুনর্জন্ম লাভ করে নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্য রূপে। এত প্রেম যার মধ্যে সে কি পারে চলে যেতে চিরকালের মত ?
চলে যেতে পারে বাংলা ছেড়ে?
“সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ।”
ভাই স্মৃতি থেকে পদগুলো শুনিয়ে যাচ্ছেন একে একে , প্রাচীন অবোধ্য শব্দগুলো ব্যাখ্যা করে করে শ্রুতি মধুর করে। আর আমি দুলছি , দুলছি অমিয় সাগরে পদাবলীর নৌকায় :
“পিরীতি বলিয়া এ তিন আখর
ভুবনে আনিল কে ।
মধুর বলিয়া ছানিয়া খাইনু
তিতায় তিতিল দে।।”
( তিতিল- তিক্ত করে তুললো,
দে-দেহ )
গাড়ী চলছে ধীরে বীরভূমের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠেদের মাঝ দিয়ে। সবুজ ধানের ক্ষেত , কোথাও সবুজ ধানের শীষ এসেছে , দূরে ছাতি মাথায় দাঁড়িয়ে আছে একাকী তাল গাছ । বাতাসের দারিদ্র্য আজ চারিদিকে। এমন মাঠে হাওয়া কথা বলেনা এটা কি ভাবা যায়?
কিন্তু পাশে কথা বলে একজন ,সেই মাঠেদের দিকে তাকিয়ে মুখে যার অভিভুত উচ্ছসিত মুগ্ধতা: “কি অদ্ভুত দিক চক্রবালে মিশে যাওয়া তোমাদের বাংলার শ্যামলিমা ! ”
আর সে করে চলে প্রশ্নের পর প্রশ্ন, পুশকিনের ভাষায় ।
এমন অন্তহীন বিশাল সবুজ প্রান্তর আমি বাংলাদেশে দেখি নাই। এমন ধানের খেত দেখি নাই পৃথিবীর অন্য কোথাও।
আমি আদিগন্ত শুয়ে থাকা এই সবুজের ঘাস ফড়িংয়ের মত বিহ্বলিত!
আমি তাকে উত্তর দেব , না মনোযোগ দেব বিক্রমপুরের কাদার মত নরম গদ গদ বড় ভাইয়ের কন্ঠে ?
“সকলি আমার দোষ হে বঁধু
সকলি আমার দোষ
না জানিয়া যদি কৈরাছি পিরীতি
কাহারে করিব রোষ।”
আমি আটার মত করে হৃদয় দিয়েছি যাকে , সে দলেছে ,মথেছে ,বেলনায় ডলেছে কিন্তু
আমি দোষ দিতে পারি নাই। কারণ সকলি আমার দোষ…
আমি রোবটের মত একজন মানুষ , সময়ে বুঝি নাই সেই আদি ও অন্তহীন সত্য :
“সুখের লাগিয়া যে করে পিরীতি
দুখ যায় তার ঠাঁই ”
দু:খ , দু:খ আমার বঁধু , দু:খ ভালোবাসার ।
আমার মনে পড়ে নিউ ইয়র্কের বেলাল বেগের কথা। তার সাথে আধ ঘন্টা কথা বললে সে অন্তত বার দশেক যার কথা বলবে, এই নানুরে তার জন্ম। আমি সেই তীর্থ দর্শনে যাচ্ছি। সন্দ্বীপে জন্ম যদিও ,বেলাল বেগ আমার আরও এক ভাই। নানুর -সন্দ্বীপ- বিক্রমপুর বাংলা কেমন একাকার হয়ে গেছে । আমার জন্মদাত্রী জননীর মুখ বদলে গেছে সত্ত্বায়। বাংলাকে ভেঙে খন্ড বিখন্ডিত করা যায় , বাঙ্গালীকে ভিন্ন ভিন্ন নাগরিকত্ব দেয়া যায় কিন্তু পরিখার এই পারে ওই পারে বাঙ্গালীর মন রয়ে যায় অখন্ডিত অবিরল।
আমার দৃষ্টি অন্ধ করে তন্দ্রা নামে , স্বপ্ন আসে ঝরা বকুলের মত:
বিশাল বাংলার ধান খেতের আল বেয়ে ঢোলে চাটি মারতে মারতে নাচতে নাচতে গাইছে বেলাল বেগ আর আমার বড় ভাই । আর আমি বাম হাতে কোমরে লুঙ্গী চেপে অন্য হাতে সবুজ লাল পতাকা ধরে ছুটছি তাদের পিছু পিছু:
“শুনহ মানুষ ভাই,
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।”
চলবে