-মোঃ মনিরুজ্জামান
আমাদের পরবর্তী গ ন্তব্য ব্রাজিলের দক্ষিণ – পূর্বাঞ্চলের সান্তা ক্যাটরিনা’ (SANTA CARTERINA)’ স্টেটের রাজধানী শহর ফ্লোরিয়ানাপোলিস (FLORIANPOLIS) । ১৬ মার্চ বেলা দুইটায় ফ্লোরিয়ানাপোলিস যাত্রার উদ্দেশ্যে আমরা রিও ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে উবের ট্যাক্সি কল করলাম। আমাদের এপার্টমেন্ট থেকে রিও ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট পৌঁছাতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগলো। রিও এয়ারপোর্টটি আধুনিক ও বেশ বড়। এটি ব্রিটেনের স্টেনস্টেড এয়ারপোর্টের অনুকরণে নির্মিত বলে জানতে পারলাম। চারিদিকে স্টিলের বিম/পীলার ও পুরু গ্লাস দ্বারা পরিবেষ্টিত। আমরা ডমেস্টিক কাউন্টারে ‘চেক ইন’ শেষ করে ‘গল এয়ারলাইন্স’ এর নির্ধারিত বিমানে আরোহন করলাম বিকাল পাঁচটায়। উল্লেখ্য , ব্রাজিলের ডমেস্টিক রুটে চলাচল করি বিমানগুলিও অনেক উন্নত। অনেক দেশের ইন্টারন্যাশনাল রুটে এসব বিমান এখনো চলাচল করে। গল এয়ারলাইন্সএর এ বিমানটি একটি এয়ারবাস এ-৩১০। ১৪৫ আসনের বিমানটি পুরাতন হলেও অনেক পরিষ্কার পরিছন্ন। ব্রাজিলের ডমেস্টিক ও পার্শবর্তী দেশ সমূহে যাতায়াতকারী অন্যানো এয়ারলাইন্স গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে টাম ,এভিয়ানকা ,গল, আজুল এয়ারলাইন্স।
সন্ধ্যা সাতটায় বিমানটি ফ্লোরিয়ানাপোলিস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে অবতরণ করলো। কাস্টমস ‘চেক ইন’ শেষ করে লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে আসতে সাড়ে সাতটা বাজলো। উবের ট্যাক্সি কল করে আমাদের এপার্টমেন্টে যেতে আধা ঘন্টা লাগলো। এপার্টমেন্টটি আমরা আগে থেকেই বুক করে রেখেছিলাম। রিও’র এপার্টমেন্ট থেকে এটি আরো বড় ও সুপ্রসস্ত। রিও;র মতোই এপার্টমেন্টের ফ্রীজে প্রচুর খাবারও ফলমূল রাখা আছে। যে যার পছন্দমত রুম বেছে নিয়ে রাতের খাবার খেতে বাইরে গেলাম। ফ্লোরিয়ানাপোলিস শহরটি সাও পাওলো বা রিও’র মতো বড় না হলেও অনেক পরিষ্কার পরিছন্ন মনে হল। আমাদের এখানকার এপার্টমেন্টটিও বিচ এলাকায় অবস্থিত। আশেপাশে অনেক রেস্টুরেন্ট,কাফে ও ফাস্ট ফুডের দোকান রয়েছে। একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকে সেলফ সার্ভিস বুফে থেকে যে যার পছন্দমতো খাবার ও সফট ড্রিঙ্কস নিলাম। খাবার শেষে বেশ কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটি করে এপার্টমেন্টে এসে ঘুমের আয়োজনে ব্যাস্ত হয়ে গেলাম।
ফ্লোরিয়ানাপোলিস শহরের ডাক নাম ফ্লোরিপা (FLORIPA) । ব্রাজিল মেইনল্যান্ডের সাথে তিনদিকে আটলান্টিক মহাসাগরের তীরবর্তী অনেকগুলি ছোট বড় দ্বীপের সমন্বয়ে ফ্লোরিপা শহরের অবস্থান। ব্রাজিলের একটি অন্যতম ও উল্লেখযোগ্য ব্রিজ ‘HERCILIO LUZ BRIDGE’ মেইনল্যান্ডের সাথে সান্তা ক্যাটরিনা সহ অন্যানো দ্বীপের সংযোগ স্থাপন করেছে। দ্বীপাঞ্চলের সাথে যোগাযোগের জন্য এটি নির্মাণ করা হয় ১৯২৬ সালে। এ বৃহৎ ব্রিজটি ছাড়াও আরো দুটি ব্রিজ আছে মেইনল্যান্ডের সাথে দ্বীপাঞ্চলের যোগাযোগের জন্য। ফ্লোরিপার উত্তরাঞ্চলে মেইনল্যান্ডেই শহরের গুরুত্বপূর্ণ অফিস আদালত বাবসাকেন্দ্র বা অন্যানো স্থাপনা। পর্তুগিজ কলোনিয়াল ঐতিহ্য থাকলেও ফ্লোরিপা’তে জার্মান, ইতালি ও আজোরিয়ান অনেক কালচারাল ও সামাজিক কর্মকান্ড এখানে দেখা যায়। বিভিন্ন সময়ে এসব দেশের পর্যটক বা নাগরিক এ শহরে এসে বসবাস করেন। ফ্লোরিপা’কে বসবাসের জন্য ব্রাজিলের সেরা শহর বলা হয়। অনেক পর্তুগিজ ,ইউরোপিয়ান ,মার্কিন ও আর্জেন্টাইন নাগরিকেরই ফ্লোরিপা’কে তাদের দ্বিতীয় বসতবাড়ি বা ‘SECOND HOME’ রয়েছে। ফ্লোরিয়ানাপোলিস বা ফ্লোরিপা ব্রাজিলের অন্যতম টুরিস্ট এট্ট্রাকশন ও পর্যটন নগরী। ফ্লোরিপা শহরের মেইনল্যান্ড ও আশেপাশের দ্বীপ সংলগ্ন ৪২টি বিচের অবস্থান। এ জন্য ফ্লোরিপা কে অনেকে ‘সিটি অফ বিচ’ ও বলে থাকেন। দ্বীপাঞ্চলে পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে অনেক ছোট বড় লেগুনা। এ ছাড়া নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ,ফিশিং,বোটিং ,ইনফরমেশন টেকনোলজি,কলোনিয়াল আর্কিটেকচার ও বিভিন্ন দেশীয় কালচারের জন্য ফ্লোরিপা ব্রাজিলের অন্যতম সেরা শহর হিসাবে পরিচিত।
ছবি:- রাতের আলোক সজ্জায় মেইনল্যান্ড ও দ্বীপাঞ্চলের সংযোগকারী ‘HERCILIO LUZ BRIDGE’ ব্রিজ, ফ্লোরিপা, ব্রাজিল
ফ্লোরিপায় আমরা চার দিন অবস্থান করবো। দু’দিন শহরের মেইনল্যান্ডের বিভিন্ন স্থাপনা,মিউজিয়াম ,ডাউনটাউন ও আশেপাশের অন্যানো উল্লেখযোগ্য জায়গা পরিদর্শন করবো। তৃতীয় ও চতুর্থ দিনে আমরা গাইডেড ট্যুরে জার্মান অধ্যুষিত শহর ব্লুমেনাউ (BLUMENAU) ফ্লোরিপা ও আশেপাশের দ্বীপাঞ্চলের বিভিন্ন বিচ ও লেগুনা পরিদর্শন করবো বলে আগেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম। পরদিন সকালে উঠে আমি একা বাহিরে গেলাম কিছুক্ষন বিচের পাড়ে যেয়ে হাঁটাহাঁটি করে নির্মল বাতাস সেবনের জন্য। রিও’র ব্যাচগুলির মতো ফ্লোরিপার বিচগুলি এতবেশি ক্রাউডেড বা ব্যাস্ত নয়। তবে বিচগুলির অবস্থান ও প্রাকৃতিক দৃশ্য মনোরম। এখানে এতো সকালে অনেক দোকান-পাট এখনো খুলে নাই। তাই রিও’র মতো দিনের প্রারম্ভে কফি পান করা সম্ভব হল না। এপার্টমেন্টে এসে দেখলাম জন ও এস্থের সকালের ব্রেকফাস্ট প্রস্তুত করে টেবিলে সাজিয়ে রেখেছে। ব্রেকফাস্ট শেষে সকলে দিনের পরিকল্পনা মতে আমরা সকলে বাহির হলাম
ছবি:- আমাদের এপার্টমেন্টে সকালের ব্রেকফাস্ট ,ফ্লোরিয়ানাপোলিস ,ব্রাজিল
আমাদের এপার্টমেন্ট থেকে পায়ে হেঁটে ফ্লোরিপা ডাউনটাউন প্রায় তিন কিলোমিটার। হেঁটে যেতে যেতে লক্ষ্য করলাম ফ্লোরিপা সাও পাওলো বা রিও থেকে অপেক্ষাকৃত ছোট হলেও পরিকল্পিত ও অনেক সাজানো গোছানো শহর। রিনালদো জানালো ফ্লোরিপা আসলে ধনী ও ব্যাবসায়ী লোকজনদের আবাসস্থল। শহর ও সংলগ্ন দ্বীপাঞ্চল মিলে জনসংখা দশ লক্ষের কাছাকাছি। পূর্ব দিকে আটলান্টিক ও পোর্ট এলাকা এবং দ্বীপাঞ্চল। ওপর দিকে উঁচু নিচু পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে ফ্লোরিপা ডাউনটাউন অবস্থিত । রাস্তার দুপাশে প্রচুর দোকানপাট, স্যুভেনির শপ,রেস্টুরেন্ট ও ক্যাফে । আমরা বেশ আগ্রহ নিয়ে সবকিছু দেখছি। একপর্যায়ে আমরা একটি ক্যাফেতে ঢুকে কিছু ব্রাজিলের ঐতিহ্যবাহী ফাস্টফুড আইটেম ‘পস্তাইসে’ ও কফি পান করলাম। আমরা হাঁটতে হাঁটতে একটি গাইডেড ট্যুর কোম্পানির অফিসে গেলাম। সেখান থেকে ফ্লোরিপা ফুল ‘ডে ট্যুর’ ও ব্লুমেনাউ (BLUMENAU ) ভ্রমণের জন্য টুরিস্ট বাসের টিকেট নিলাম।
দুপুরের লাঞ্চের জন্য আমরা শহরের সমতল অংশে নেমে আসলাম। এখানে আছে কয়েকটি ওপেন মার্কেট ও শপিং মূল। মিউনিসিপাল মার্কেটের কাছেই বিশাল ফুড কোর্ট। ফ্লোরিপাতে এতো বড় ফুড কোর্ট থাকতে পারে সেটা না দেখলে হয়তো বিশ্বাস হতো না। দুপরের খাবারের জন্য প্রচুর ভীড় দেখলাম। তার বেশির ভাগই মনে হল ট্যুরিস্ট। আমরা ফুডকোর্টের একপাশে একটি দোকানের কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। এ সময় এক সুন্দরী তরুণী এসে আমাদেরকে ডেকে নিয়ে তার রেস্টুরেন্টে বসার জায়গা করে দিল। আমরা খাবার মেনু দেখে অর্ডার করবো সেই সময় ঐ তরুণী বললো, তোমরা চাইলে ফ্লোরিপার ঐতিহ্যবাহী ‘সী ফুড’ ও সেইসাথে অন্যানো যা খুশি অর্ডার দিয়ে পারো। আমরা তার উপর মেন্যু নির্ধারণ করার দায়িত্ব দিয়ে অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষন পর দুটি বড় ট্রেতে করে সে আমাদের খাবার নিয়ে এলো। খাবারের পরিমান ও বিভিন্ন মাছের ভ্যারাইটি দেখে আমাদের চক্ষুস্থির ! প্রচুর পরিমানে ২/৩ প্রকার শ্রিম্প বা চিংড়ি মাছ ,ক্রাব , নাম না জানা ছোট অন্ন্যানো জাতের মাছ ,কয়েক প্রকার সালাদ ও সস, সেই সাথে ডাব ও কিছু সফট ড্রিঙ্কস। যথাযত তৃপ্তি সহকারে আমরা দুপুরের খাবার খেলাম । খাবার পরে দেখলাম বিল আহামরি বেশি নয় এবং আমাদের আয়ত্তের মধ্যে।
ছবি:- দুপুরের লঞ্চ ,ফ্লোরিপা মিউনিসিপাল ফুড কোর্ট,ফ্লোরিপা,ব্রাজিল
খাবার শেষে মিউনিসিপাল মার্কেটের সামনে একটি পার্কে বসে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিলাম। বিকালে আমরা ফ্লোরিপার বিখ্যাত ‘ নভেম্বর ফিফটিন ‘ শপিং সেন্টারে গেলাম। এটি একটি বড় বাজার বা শপিং সেন্টার। ডাউনটাউনেই ফ্লোরিপার মেট্রোপলিটন ক্যাথেড্রাল যার অফিসিয়াল নাম ‘NOSSA SENHORA DO DESTERRED’। ১৬৭৮ সালে এটি নির্মাণ করা হয় ও পরে ১৯২২ সালে পুনঃ সংস্কার করা হয়। ক্যাথেড্রালটির ভিতরে ও বাহিরের দেয়াল ও জানালা গুলি ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন ধরণের আর্ট ও কারুকাজ খুবই সুন্দর। আমরা সেখানে বেশ কিছু ছবি তুললাম। পরে আমরা ‘SANTA CATERINA ART MUSEUM’ দেখতে গেলাম। ১৯৪৯ সালে স্থাপিত এ মিউজিয়ামে প্রাচীন ও আধুনিক শিল্পকর্মের অনেক নিদর্শন রয়েছে। পাহাড়ের উপর নিচে হাঁটা হাঁটিতে আমরা সবাই কমবেশি ক্লান্তি অনুভব করছি। সেজন্য ঐ দিনের মত আমাদের ভ্রমন কার্যক্রম শেষ করে আমরা এপার্টমেন্টে ফিরলাম রাত নয়টায়। রাতের খাবার এপার্টমেন্টের কাছাকাছি একটি রেস্টুরেন্টে সেরে যে যার মত রেস্ট নিয়ে গেলাম।
পরদিন সকালে আমরা গাইডেড সিটি ট্যুরে যাত্রার জন্য ব্রেকফাস্ট করে এপার্টমেন্টের কাছে একটি নির্দিষ্ট্র স্থানে টুরিস্ট বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমাদের আশেপাশের অনেক হোটেল ও এপার্টমেন্ট থেকেও ট্যুরিস্টরাও এখানে অপেক্ষা করছে। সকাল ঠিক নয়টার দিকে ছোট খাটো ও সুন্দর একটি টুরিস্ট মিনিবাস আমাদের তুলে নিল। বাসে আমি ড্রাইভারের পিছনে একটি সিটে বসলাম চারিদিকে ভালো মতো দেখাত জন্য। বাসের ড্রাইভার ব্রাঙ্কো নিজেই ট্যুরিস্টদের গাইড। মোটামুটি ভালো ইংরেজি জানে। বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ট্যুরিস্টদের তুলে নিয়ে সে ডাউনটাউনের একটি জায়গায় থামলো। বাসের মাইক্রোফোন প্রথমে পর্তুগিজ ও পরে ইংরেজি ভাষায় সে সারাদিনের কর্মসূচি সম্পর্কে জানিয়ে দিল।
প্রথমে সে আমাদের ফ্লোরিপা মেইনল্যান্ডে বিখ্যাত FORT PONTA GROSSA,VICTOR MEIRELLES MUSEUM,CASA DE ALFANDEGA পরিদর্শনের জন্য নিয়ে গেল। এ সকল দুর্গ ,স্থাপনা বা ভবনসমূহ পর্তুগিজ শাসনামলে জলদস্যু ও বহিঃ শত্রূর আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষে নির্মাণ করা হয়।এ সব স্থাপনা গুলি এখন সান্তা ক্যাটরিনা স্টেটের সম্পত্তি। কোনো কোনটি মিউজিয়াম বা মার্কেট এবং বিভিন্ন সরকারি অফিসের জন্য ব্যাবহৃত হচ্ছে। এক পর্যায়ে আমরা ফ্লোরিপা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল দেখতে নামলাম। এখন থেকে বাসে পার্শবর্তী দেশ চিলি ও উরুগুয়ে যাওয়া যায়। দক্ষিণ আমেরিকার বিখ্যাত আন্দেজ পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে চিলি যাবার রাস্তা। যেতে সময় লাগে দশ ঘন্টা। উরুগুয়ে যেতে সময় লাগে আট থেকে নয় ঘন্টা। বাস টার্মিনালটি পরিছন্ন ও সাজানো গোছানো। অভ্যান্তরিন ও দেশের বাহিরে যাবার বাস সমূহের কাউন্টার ও ওয়েটিং রুমগুলি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থিত।বাস টার্মিনালের কাফে ও রেস্টুরেন্ট গুলি সুন্দরভাবে সাজানো। আসলে শুধু বাস টার্মিনাল নয় ,ফ্লোরিপার সব রাস্তা ঘাট ,মার্কেট বা পাবলিক প্লেস সবই পরিষ্কার ঝকঝকে। এখানকার মিউনিসিপালিটি তার কাজ ঠিক মতোই করছে বলে শহরটি এতো সাজানো গোছানো ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ সফরসঙ্গী এস্থারের বাড়ি পার্শবর্তী দেশ উরুগুয়ে। আমরা তাকে উদবুদ্ধ করলাম এখন থেকে উরুগুয়ে যাবার জন্য। কিন্তু এ সফরে সেটা সম্ভব নয়। তবে সে পরবর্তীতে ব্রাজিলে আসবে ও ফ্লোরিপা থেকেই বাসে উরুগুয়ে যাবে বলে জানালো।
বাস টার্মিলান থেকে আমরা ফ্লোরিপার পূর্বপ্রান্তে একটি জেলেদের গ্রামে (ঝিনুক)/OYSTER চাষ প্রজেক্ট প্রজেক্ট দেখতে নিয়ে গেল। আটলান্টিকের সাথে একটি ছোট ক্যানালের মাধ্যমে সংযুক্ত একটি লেগুনায় ঝিনুক চাষের বিশাল প্রজেক্ট। আমরা ঝিনুক বসবাসের ও বংশবৃদ্ধির প্রক্রিয়া দেখে আশ্চার্যান্বিত ও চমৎকৃত হলাম। সুশৃঙ্খল ভাবে ঝিনুকের বংশ বৃদ্ধি ও বসবাসের ধরণ ডেকে আমি অবিভুত হলাম। ইতোপূর্বে আমি এ ধরণের করো জলজ প্রাণীর একত্রে বসবাস বা বংশবৃদ্ধির প্রক্রিয়া দেখি নাই। এখান থেকে ঝিনুক সংগ্রহ করে দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। ফ্লোরিপার এ ঝিনুক সারা ব্রাজিলে জনপ্রিয়। ঝিনুক চাষ প্রজেক্ট দেখে আমরা জেলেদের গ্রামে ঢুকলাম। জেলেদের গ্রাম হলেও এটি একটি সুন্দর গ্রাম। লেগুনার তীর ঘেঁষে জেলেদের সুন্দর ও সাজানো গোছানো ছোট ছোট বাড়িগুলি একটি মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আমার মনে আকাঙ্খা জাগলো যদি আমি এমন মনোরম ও সুনসান পরিবেশে কিছুদিন থেকে যেতে পারতাম !! লেগুনার তীর ঘেঁষে বেশ কিছু ক্যাফে ও রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে। ‘সী ফুড’ই এ সব রেস্টুরেন্টের প্রধান খাবার মেন্যু। ফ্লোরিপা থেকে বিকালের দিকে অনেক ট্যুরিস্ট ও স্থানীয় লোকজন এখানে এসে সময় কাটায়। লেগুনার তীরবর্তী কাফে রেস্টুরেন্টে বসে রাতের খাবার খেয়ে আবার ফিরে যায়। আমরা জেলেদের গ্রাম ঘুরে দেখলাম ও বেশ কিছু ছবি তুললাম। ব্রাঙ্কো এসে জানাল এখানকার বরাদ্দ সময় শেষ। কাজেই আমরা বাসে উঠে বসলাম পরবর্তী গন্তব্যে যাবার জন্য।
মেইনল্যান্ড থেকে দক্ষিণাঞ্চলের বিচ,লেগুনা ও আশেপাশের স্থান সমূহ দেখানোর জন্য ‘HERCILIO LUZ BRIDGE’ পেরিয়ে গাইড ব্রাঙ্কো আমাদের সান্তা ক্যাটরিনা দ্বীপে নিয়ে গেল। দ্বীপে আসার পরে যেন প্রাকৃতিক পরিবেশও পাল্টে গেল। দ্বীপের রাস্তার দু’পাশের ছোট ছোট বাড়িঘর,ফিশ প্রসেসিং ইউনিট,ফাঁকে ফাঁকে কিছু হোটেল মোটেল ও রেস্টুরেন্ট। অনেক জায়গায় পাহাড়ের কঠিন পাথর কেটে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। প্রথম দর্শনেই আমার কাছে দ্বীপের পরিবেশটি পছন্দ হয়ে গেল। বাসে যেতে যেতে আমরা দ্বীপাঞ্চলের মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধ নয়নে দেখতে লাগলাম। ছোট বড় অসংখ্য বিচের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে PRAIA MOLE, BARRA DA LAGOA, PRAIA DA JOAQUINA, INGLESES, CANASVIEIRAS, CAMPACHE ও SANTINHO বিচ। উল্লেখ্য ,দ্বীপের তিনদিকে আটলান্টিক মহাসাগরের তীর ঘেঁষে এ সব বিচের অবস্থান। পূর্ব থেকে পশ্চিমে কোনো বিচের দূরত্ব ত্রিশ কিলোমিটারেরও বেশি। দ্বীপের মধ্যেবর্তী স্থানে পাহাড় ও টিলার ভিতরে ছোট বড় লেগুনা। ব্রাঙ্কো কয়েকটি বিচে নামিয়ে দশ মিনিট করে সময় দিল সংক্ষিপ্ত ঘোরাফেরা ও ছবি তোলার জন্য।
বিচগুলিতে প্রচুর টুরিস্ট ও দর্শনার্থীর ভিড়। বিচ গুলিতে ট্যুরিস্টদের মনোরঞ্জনের সব উপাদানই রয়েছে। বিচের লোনা পানিতে জলকেলী , বালির উপর শুয়ে বসে সান বার্ন ,হর্স রাইডিং ও কাফে বা রেস্টুরেন্টে বসে পানাহারে ব্যাস্ত সকলে। অনেকে সুউচ্চ রকের উপরে বসে নির্মল বাতাস উপভোগ করছে। অনেকে বিচের সুভেনির শপে কেনাকাটায় ব্যাস্ত। আমরা অপেক্ষাকৃত বড় বিচ PRAIA DA JOAQUINA তে পৌঁছালে ব্রাঙ্কো ঘোষণা করলো , দুপুরের খাবার ও কেনাকাটার জন্য এখানে দু’ঘন্টার বিরতি। গাড়ি থেকে নেমে প্রথমেই ক্যাফেতে ঢুকে কচি ডাবের পানি খেলাম। মার্গারেট,গ্রেস ও জন পোশাক পাল্টিয়ে সমুদ্রের পানিতে নেমে পড়লো। আমি রিনালদো ও এস্থার শুভেরির শপে ঘুরাঘুরি ও কিছু কেনাকাটা করলাম । আমি ও রিনালদো কয়েকটি টিশার্ট ও ফ্লোরিপার বিভিন্ন ছবি মুদ্রিত কিছু চাবির রিং কিনলাম। এস্থার তার ছেলে মেয়ে ও নাতি পোতার জন্য বেশ কিছু টিশার্ট ও অন্যানো গিফট আইটেম কিনলো। এখানে দ্রব্যসামগ্রীর দাম কিছুটা সস্তা। আমাদের অপর সহযাত্রীরাও সমুদ্র স্নান সেরে এসে আমাদের সাথে কেনা কাটায় যোগদান করলো। সকলেই কমবেশি কেনাকাটা করলো। আমরা যা কেনাকাটা করলাম তার বেশির ভাগই টিশার্ট ,প্যান্ট ,চাবির রিং,ক্রিস্টাল পাথরের মালা ও কানের দুল।
ছবি:- সান্তা ক্যাটরিনা দ্বীপের বিচ PRAIA DA JOAQUINA ফ্লোরিপা ,ব্রাজিল
ইতোমধ্যে প্রায় দু’ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে। আমরা দুপুরে খাবার জন্য ব্রাঙ্কোর পরামর্শ মতো একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম। প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যে একত্রে আমাদের ছয়জনের সিট্ পাওয়াতে বেশ বেগ পেতে হলো। অবশেষে বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষার পর বসার জায়গা পেলাম। আশেপাশের টেবিলে দেখলাম গতকালের মতোই বড় বড় ট্রেতে করে করে হরেক রকম সী ফুড ,আচার বা সসেজ ,সালাদ দিয়ে সবাই লাঞ্চ করছে। আমরা আজও ফ্লোরিপার ঐতিহ্যবাহী সী ফুডের অর্ডার দিলাম। গতকালের থেকে এখানকার খাবারের ট্রে বেশ বড় ও খাবারের পরিমাণ বেশি। বড় ও ডিম্বাকৃতির দুটি প্লেটে শ্রিম্প ডিপ ফ্রাই ,ফিশ বল , ক্র্যাব ও কালামারী ফ্রাই , বাচা বা তেলাপিয়া জাতীয় মাছের ফ্রাই,সালাদ ও স্টিমড রাইস। এক প্লেট খাবার চার জনের জন্য। আমরা দেরি না করে খাবারে মনোনিবেশ করলাম। আমাদের ড্রাইভার/গাইড ব্রাঙ্কো এসে জানিয়ে দিল এখানে অবস্থানের সময় আরো একঘন্টা বাড়ানো হয়েছে। কাজেই আমরা নিশ্চিন্তে খাবার শেষ করে যেয়ে পারবো। তবে আমরা ভরপেট খেয়েও সব খাবার শেষ করতে পারলাম না। যে যার পছন্দমতো ড্রিঙ্কস নিয়ে বিল পরিশোধ করে আবার আমরা আশেপাশের বিভিন্ন দোকানে কিছুক্ষন ঢু মেরে গাড়িতে এসে বসলাম। ইতোমধ্যে বিকাল চারটা বেজে গেল। ব্রাঙ্কো আমাদের কে জানালো , সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাকি সব দ্বীপাঞ্চল ও বিচ দেখা সম্ভব নয়। তাই সে আমাদের কাছাকাছি দু’ একটি বিচ ও মধ্যে-পূর্বাঞ্চলে সান্তা ক্যাটরিনার সব চাইতে বড় লেগুনা ‘CONCEICAO’ দেখার প্রস্তাব দিল। আমরা ও সফরসঙ্গী অন্যানো ট্যুরিস্টরা তার প্রস্তাবে সম্মত হলাম।
বৈকালিক ভ্রমণে আমরা ফ্লোরিপার জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পট বা দর্শনীয় স্থান ‘LAGOA DA CONCEICAO’ পৌছালাম । সেখানে দেখলাম লেগুনার তীরবর্তী এলাকায় প্রচুর টুরিস্ট ও দর্শনার্থীর ভিড়। ফ্ররিপা ভ্রমণে এসে এ নৈসর্গিক লেগুনা না দেখে কোন ট্যুরিস্ট ফিরে যায়না। এটির অবস্থান দ্বীপাঞ্চলের প্রায় মাঝামাঝি এবং অনেকটা বৃত্তাকার। বৃত্তের এক প্রান্ত থেকে ওপর প্রান্তের ব্যাস এক কিলোমিটারের কম নয়। লেগুনাটির চারিদিকে উঁচু পাহাড়সারি ও বনভূমি। তবে সব বিচ বা দ্বীপের থেকেই যাতায়াতের ব্যবস্থা আছে। লেগুনার পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে অসংখ্য রেস্টুরেন্ট,ক্যাফে ও স্যুভেনির শপ। এ ছাড়া আছে বোট রেন্টাল ব্যবস্থা। প্যাডেল বোটে লেগুনার সবখানে যাওয়া যায়। অনেককেই দেখ্লাম পরন্ত বিকালের হালকা রোদ গায়ে মেখে প্যাডেল বোটে লেগুনার মধ্যে ঘুরে বেড়াতে। আমরা লেগুনার একপ্রান্তে নেমে পাড়ের রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে সব কিছু দেখলাম। পূর্ব প্রান্তে পাহাড়ের উপরে সুন্দুর একটি গির্জা নির্মাণ করা হয়েছে। এ জায়গাটিকে যেনো সৃষ্টিকর্তা হাতে ধরে সুন্দর করে তৈরি করেছেন। আমার বার বার মনে হচ্ছিল ব্রাঙ্কো কেন আগেই আমাদের এখানে আনলো না ? এখানে এতো সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সেইসাথে সব কিছুর একত্র সমাবেশ দেখে আমরা মুগ্ধ ও অবিভুত। ব্রাঙ্কোকে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সে বললো,দক্ষিণাঞ্চলের দ্বীপগুলিতে এরকম আরো লেগুনা রয়েছে , তবে একদিনের ট্যুরে সব কিছু দেখানো সম্ভব নয়। আমরা বিবেচনা করে দেখলাম সে ঠিকই বলেছে। যাইহোক ,তাকে বলে আমরা এখানে অবস্থানের সময়সীমা আরো আধা ঘন্টা বাড়িয়ে নিলাম। ‘ LAGOA DA CONCEICAO ‘তে সময়সীমা শেষ হলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরবর্তী স্থান দেখার জন্য আমার গাড়িতে যেয়ে বসলাম।
সান্তা ক্যাটরিনার সব চাইতে বড় লেগুনা ‘CONCEICAO’ ফ্লোরিপা ,ব্রাজিল
ব্রাঙ্কো জানালো আমরা আমাদের ‘ডে ট্যুরের’ শেষ প্রান্তে এসে পড়েছি। তখন সময় সন্ধ্যা ছয়টা বেজে গেছে। আমরা কয়েক জায়গায় অতিরিক্ত সময় ব্যায় করতে পূর্ব নির্ধারিত বেশ কিছু বিচ এলাকায় আর যাওয়া হল না। এতদসত্ত্বেও ব্রাঙ্কো ফেরার পথে আমাদের আরো কয়েকটি বিচ ঘুরিয়ে ফ্লোরিপার মেইনল্যান্ডে আমাদের হোটেল/এপার্টমেন্টে যাবার পথ ধরলো। দ্বীপের সাথে সংযোগকারী ব্রিজ ‘HERCILIO LUZ BRIDGE’ পেরোনোর সময় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। ব্রিজের লাইটিং বা আলোকসজ্জা নিচের পানিতে রিফ্লেক্ট করে অপূর্ব সুন্দর দৃশ্যের সমন্বয় ঘটিয়েছে। ব্রিজের পাদদেশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য ব্রাঙ্কো আমাদের জন্য দশ মিনিট সময় দিল। ব্রিজ পেরিয়ে ফ্লোরিপার মেইনল্যান্ডের প্রশস্ত রাস্তায় পড়লাম রাত নয়টায় । ব্রাঙ্কো আমাদের এপার্টমেন্টের গেটের কাছে যখন নামিয়ে দিল তখন তার দশটা বেজে গেছে । আমরা যে যার রুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে লিভিং রুমে বসে সারাদিনের আনন্দময় ভ্রমণের স্মৃতিচারণ করছিলাম। দুপুরের হেভি খাবারের জন্য রাতে আর কেউ বেশি কিছু খেতে আগ্রহী ছিল না। ফ্রিজ থেকে কিছু ফলমূল ,দুধ ও জুস্ খেয়ে বিছানায় গেলাম। ঘুমানোর আগে টরোন্টোতে আমার বাসা ও বাংলাদেশে আমার গ্রামের বাড়িতে ভাইবোনদের সাথে কথা বলে একসময় ঘুমিয়ে গেলাম।
To be contd /………….