ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড, নরওয়ে থেকে:-
আমাদের বাড়ী সিলেট শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে গোলাপগঞ্জের একটা গ্রামে, আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং সুন্দর যাতায়াত ব্যবস্তা থাকলেও প্রতিদিনকার যাতায়াতের ঝক্কি জামেলা থেকে বাঁচতে এবং ভালো রেজাল্ট করার খাতিরে আমাদের এলাকার অনেকেই সিলেট শহরে থেকে লেখাপড়া করতে পছন্দ করতেন। আর সে কারণেই ১৯৯৯ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করেই আমি চাচার বাসায় চলে আসি। গ্রামে থাকতে সব সময় খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম আর সব সময় ঘরের বাহিরে ঘুরাঘুরি করতাম বলে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করা হতো না। তাই ১৯৯৯ তে কলেজে পড়ালেখা করলেও দেখতে একেবারে পাট কাটির মতো ছিলাম। আমি গ্রামের ছেলে ছিলাম বিধায় শহরের ছেলেদের চেয়ে অনেক কিছুতে পিছিয়ে ছিলাম কিন্তু মোটামোটি ভালো ছাত্র হওয়ায় আস্তে আস্তে সব কিছু গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। ২০০১ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পদার্থ বিজ্ঞানের প্রশ্ন পত্র অত্যন্ত কঠিন করায় পরিচিত অনেকেই পরীক্ষায় ফেল করে কিন্তু সেই পদার্থ বিজ্ঞানেই প্রায় ৮৫% মার্কস নিয়ে আমি ওই বছর উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করি এবং সিলেট এম সি কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্সে ভর্তি হই। আগে শুধু সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললেও নিজের সামগ্রিক উন্নতির জন্য ২০০১ সালের দিকে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার সাথে সাথে খুব মনোযোগ দিয়ে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে শিখি।
কিন্তু এতো কিছুর পরও কি জানি একটা জায়গায় কমতি ছিল, শহুরে ছেলেদের মতো সুন্দর কাপড় চোপড় পরে নিজেকে গুছিয়ে উঠবার যতই চেষ্টা করছিলাম, কেনো মতেই তা পারছিলাম না। অন্য অনেকের মতো আমারও সেনাবাহিনীর অফিসার হবার খুব শখ ছিল, জীবনে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবার জন্য ২০০১ সালে বন্ধু শফিকের পরামর্শে সেনাবাহিনী এবং নৌ বাহিনীতে কমিশন অফিসার পদে বারে বারে পরীক্ষা দিয়েও ফেল করছিলাম আর তার একটাই কারণ ছিল তা হচ্ছে আমার শারীরিক গঠন , একেবারে সাদাসিধে গ্রামীণ অবয়ব এবং ইংলিশের উপর আমার অদক্ষতা।
গ্রামে কিংবা চাচার বাসায়, পরিবারের কেউই আমি যে আর্মিতে পরীক্ষা দিতাম তা জানতেন না। আমিও কারো কাছে এ ব্যাপারে কোনো পরামর্শ চাইতাম না। আর্মির কমিশন অফিসার পদে কয়েকবার পরীক্ষা দেবার পর নিজেই বুঝতে পারলাম যে আমাকে আমার শারীরিক সুসাস্থ্যের দিকে খেয়াল দিতে হবে, সাথে করে ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। যেই কথা সেই কাজ, সিলেট শহরের রায়নগরের পাড়ার এক বড় ভাইয়ের কাছে বিকেলে ইংরেজি স্পিকিং চর্চা করতে যেতাম এবং সাথে করে ভর্তি হয়ে গেলাম লোকাল একটা শরীর চর্চা কেন্দ্রে, আশ্চর্য জনকভাবে মাত্র ৬ মাসের ভেতরেই নিজের কথা বার্তা এবং শারীরিক অবয়বের মাঝে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম।
কিন্তু কেন জানি, পাড়া প্রতিবেশী বেশিরভাগ মানুষকেই দেখতাম এ ব্যাপারে কেমন জানি নাখোশ এবং টিটকারী প্রবন। উনাদের বেশির ভাগের একটাই কথা ছেলেটা দিনদিন পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে বখে যাচ্ছে। পিছনে পিছনে কথা বলা লোকজনদের কারণে ২০০৩ সালে প্রায়ই মানুষিক ভাবে বিভ্রান্ত থাকতাম, উশৃঙ্খল হয়ে উঠছিলাম। সব দিক দিয়ে যখন ঝরে পড়ছিলাম তখন একজন মানুষই অনুপ্রেরণা নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন, তিনি হচ্ছেন সিরাজ চাচা।
সিরাজ চাচা থাকতেন আমাদের বাসার সামনের গলিতে, উনি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ফুড ইন্সপেক্টর। সম্পর্কে আমার চাচতো বোন ডাক্তার হালিমা জাহানের মামা শশুর। সিরাজ চাচা উনার বাসার বারান্দা থেকে প্রতিদিন আমার আসা যাওয়া অবলোকন করতেন। উনি স্থানীয় মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন, ছিলেন রায়নগর এলাকার খুবই পাওয়ারফুল একজন ব্যক্তিত্ব, উনি আমাদের আত্মীয়, এবং আমার আব্বার এক সময়কার ছাত্র হলেও ভয়ে এবং শ্রদ্ধায় সালাম দেয়া ছাড়া সিরাজ চাচার সাথে আর কোনো কথা বলতাম না। একদিন উনি আমাকে বাসায় নিয়ে গেলেন, আমরা ছাদে বসে চা পান করলাম, উনি হয়তোবা আমার মানোষিক বিপর্যস্ততা লক্ষ্য করছিলেন তাই সরাসরি বললেন যে আমার সমস্যা কি ??
আমি বললাম যে শরীর চর্চা করি বলে অনেকেই পিছে কথা বলে,, উনি প্রাণ খুলে অনেক্ষন হাসলেন, তারপর বললেন কে কথা বলে ?? আমিতো বলিনা,, আমিতো তোমাকে বিগত ২ বছর ধরে দেখছি এবং তোমার দিনদিন উন্নতি দেখে আমি খুবই খুশি। তোমার উন্নতি হচ্ছে দেখে অনেকেই হয়তোবা ঈর্ষা করছে তাই পেছনে খারাপ কথা বলে। অন্যের কথায় নিজের ভালোটাকে কক্ষনোই ছেড়ে দিয়োনা।
সেদিন থেকে সিরাজ চাচার সাথে একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠে, উনার অনুপ্রেরণায় দিনদিন আমি আমার লক্ষ্যের দিকে এগুতে থাকি এবং দেশে যা চেয়ে ছিলাম তার অনেকগুলোই অর্জন করতে সক্ষম হই।
২০০৪-২০০৫ সালের এক ঘোর লাগা সন্ধ্যায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আকস্মিকভাবে সিরাজ চাচা মারা যান। সিলেটের মানিক পীরের টিলায় উনাকে কবর দেয়া হয়। দেশে থাকা অবস্থায় যতবার মানিক পীরের টিলার পাশ দিয়ে যেতাম, একটু থেমে সিরাজ চাচার জন্য দোয়া করে যেতাম। মানোষিক ভাবে ভেঙে পড়া অবস্থায় এই একজন মানুষই ছিলেন যিনি আলোর মশাল নিয়ে আমাকে এগিয়ে দিতে এসেছিলেন, যিনি বয়সের পার্থক্য ভুলে আমার বন্ধু হয়ে ছিলেন, যিনি ভালোবেসে সময়ে অসময়ে না চাইলেও আমার পকেটে ৫০০ টাকার নোট গুঁজে দিতেন আর বলতেন ভেঙে পড়োনা শরীফ, তুমি পারবে, তোমার ভবিষৎ অনেক সুন্দর। সিরাজ চাচা এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি এক ঝলকে আমার আত্মশক্তিকে জাগ্রত করে তুলেছিলেন এবং অনুপ্রেরণা হয়ে এখনো আমার জীবনে বেঁচে আছেন।
মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মে, আমি যতদিন বেঁচে রবো, প্রিয় সিরাজ চাচা আমার জীবনে এক মহামানব হয়ে বেঁচে রইবেন, বেঁচে রইবেন আমার দোয়া, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার স্মৃতিগাঁথায়।