(দ্বাদশ পর্ব )
দৈনিক দিনকাল পত্রিকায় অনেক লেখা লিখেছি। দিনকাল পত্রিকায় প্রকাশিত ডিসেম্বর ১৯৯৪ সনের পূর্বের কোনো লেখাই আমার সংগ্রহে নেই, খুঁজে পাচ্ছি না। পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত লেখার কিছু পেপার কাটিং আমার সংগ্রহে আছে। এখানে তারই কয়েকটির উল্লেখ করছি।
১. ‘বিজয় দিবসের ভাবনা’, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের ওপর বিশেষ নিবন্ধ, প্রকাশকাল ১৬-১২-১৯৯৪।
২. ‘মুক্তিযুদ্ধ এবং আমি’, মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা সামাদ সিকদারের বইয়ের রিভিউ, রিভিউটি করেছেন প্রখ্যাত ছড়াকার ও কবি আ.শ.ম. বাবরআলী, প্রকাশকাল ১১ জানুয়ারি ১৯৯৫।
৩. ‘একুশের ভাবনা’, একুশে ফেব্রুয়ারির ওপর বিশেষ নিবন্ধ, প্রকাশকাল ২১-০২-১৯৯৫।
৪. ‘স্বাতন্ত্র্যধর্মী সাহিত্যিক’, সামাদ সিকদার এবং ‘সুকান্তঃ কবি ও মানুষ’ গ্রন্থের পরিচিতি, প্রকাশকাল ১৩ মার্চ ১৯৯৫ যথাক্রমে ২৫ ফাল্গুন, ১৪০১ বঙ্গাব্দ।
৫. ‘যদি দেখা হয়’, সামাদ সিকদারের কবিতার বইয়ের পরিচিতি, লিখেছেন হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী। প্রকাশকাল ০৫-০৩-১৯৯৬।
৬. ‘স্বাধীনতা দিবসের কথকতা’, স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ সংখ্যায় পৃষ্ঠাব্যাপী বিশেষ নিবন্ধ, প্রকাশকাল ২৬-০৩-১৯৯৬।
৭. ‘অথচ একদিন’, কবি আ.শ.ম. বাবর আলীর কবিতার বই, রিভিউ করেছেন সামাদ সিকদার, প্রকাশকাল ৩০ মার্চ ১৯৯৫ যথাক্রমে ২০ চৈত্র ১৪০১ বঙ্গাব্দ।
৮. ‘দীর্ঘ সময়’, সামাদ সিকদারের কবিতা, প্রকাশকাল ১৯-১২-১৯৯৬।
৯. ‘ঈদের আনন্দ’, সামাদ সিকদারের কবিতা, ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত, প্রকাশকাল ২৭-০২- ১৯৯৭।
১০. ‘ইচ্ছে ছিলো’, সামাদ সিকদারের কবিতা, প্রকাশকাল ২৭ এপ্রিল ১৯৯৭।
০১. দৈনিক দিনকাল পত্রিকায় ১৯৯৪ সনে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে একটি বিশেষ ক্রোড়পত্র বের হয়। মুশাররাফ করিম ভাইয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমি ঐ বিশেষ সংখ্যার জন্য লেখা পাঠাই। লেখার শিরোনাম ছিলো,’বিজয় দিবসের ভাবনা’। লেখাটি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে ঐ দিনের বিশেষ নিবন্ধ হিসেবে ত্রয়োদশ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হয়। লেখাটি খুব ভালো হয়েছে বলে মুশাররাফ করিম ভাই আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। সম্পাদক কাজী সিরাজ ভাই, আনোয়ার কবির বুলু ভাইসহ অনেকে এই লেখার প্রশংসা করেছেন বলেও তিনি আমাকে অবহিত করেন।
আমার লেখা ‘বিজয় দিবসের ভাবনা’ নিবন্ধটি আকারের দিক দিয়ে ছিলো দৈনিক দিনকাল পত্রিকার প্রায় অর্ধপৃষ্ঠাব্যাপী । শিরোনাম থেকেই লেখার বিষয় বস্তু আঁচ করা যায়। লেখার শুরুটা ছিলো এইরকম, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের কাছে, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে চিরস্মরণীয় একটা দিন। ওইদিন দুর্ধর্ষ পাকিস্তানি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতিসত্তাকে পরম গৌরব দান করে যে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলো, তা এই জাতির সহস্র বছরের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক প্রাপ্তি। এই অর্জনের পেছনে রয়েছে ৩০ লাখ মানুষের প্রাণদান ও অগুনিত লোকের অশ্রুর ইতিহাস। তাই এই দিনটি যুগযুগ ধরে আমাদের ভাবাবে, কাঁদাবে এবং নতুন মন্ত্রে উদ্দীপিত করবে।… স্বাধীনতা বা বিজয় একদিনের কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আমাদের জাতীয় চেতনাও বহুযুগের সাধনার ফল। সঙ্গত কারণেই ১৬ ডিসেম্বর তাই আমাদের দীক্ষা গ্রহণের মাহেন্দ্রক্ষণ। এই দীক্ষা কঠিন দীক্ষা।
কারণ, বিজয় মানে তো শুধু আনন্দের ব্যাপার নয়, দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিষয়ও বটে।…
লিবার্টি ও লাইসেন্সের সীমারেখা আমাদের জানা থাকতে হবে।
গনতন্ত্র তো অনেক কিছু! জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার জনগনের কাছে জবাবদিহি করবে , জনগণ স্বাধীনভাবে ভোটদানের অধিকার লাভ করবে। বিরোধীদল গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে সরকারকে শুধরে দেবে। সরকারের ক্রিয়াকলাপে জনগণ নাখোশ হলে পরবর্তী নির্বাচনে বিরোধী দল ক্ষমতায় আসবে। সরকার দায়িত্ব হস্তান্তর করবে শান্তিপুর্ণ পন্থায়। মাথা পেতে নেবে গনতন্ত্রের রায় — এটাইতো গনতন্ত্র। দেশে আইনের শাসন চলবে, মানুষ আইনের চোখে যথার্থই সমান হবে। সকল নাগরিক সমান সুযোগ পাবে, মৌলিক অধিকারের বাস্তব প্রয়োগ করতে সক্ষম হবে। অন্ন বস্ত্র বাসস্থান চিকিৎসা ও শিক্ষার নিশ্চয়তা থাকবে সকলের–এটাইতো আমরা চেয়েছিলাম।…
বিজয়ের পশ্চাত-চিন্তা তো অনেক উন্নত ও মহৎই ছিল।… আশা করেছিলাম, আনবিক বোমা বিধ্বস্ত জাপানে যেমন করে তিলতিল নিষ্ঠা ও ধৈর্য ব্যয় করে বিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলেছে, আমাদেরও তাই করতে হবে। দৃঢ়সংকল্প নিয়ে বিধ্বস্ত জার্মানী যেমন আত্মপ্রতিষ্ঠায় জয়যুক্ত হয়েছে, আমাদেরও সেই আদর্শ অনুসরণ করতে হবে। সুইজারল্যান্ডের মতো অধ্যবসায়ের বিনিময়ে বাংলাদেশকে করতে হবে সমৃদ্ধ ও স্বচ্ছল।
সুদীর্ঘ নিবন্ধ ‘বিজয় দিবসের ভাবনা’-এর শেষপ্রান্তে লিখেছি,
… একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সম্পুর্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। কেননা, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয় এমন এক বিশ্বাস ও দর্শন যা অনাগত দিনেও আমাদের সাহসী হওয়ার প্রেরণা জোগাবে।… তাই যে কোনো প্রতিকূলতায় যেন আমরা আমাদের সাহসী অতীত-ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করি।
০২. মুক্তিযুদ্ধের ওপর আমার প্রথম লেখা বই ‘মুক্তিযুদ্ধ এবং আমি’। এটিকে একজন মুক্তিযুদ্ধার ডাইরি বা রোজনামচাও বলা যায়। এটি প্রকাশিত হয় ২৯ আগষ্ট ১৯৯১ সনে। প্রকাশক ছিলেন নুর-ই আকতার (স্বপ্না)। প্রচ্ছদ শিল্পী মাকসুদুর রহমান। ৪ ফর্মার বইটির মূল্য মাত্র ৪০ টাকা।
দৈনিক দিনকাল পত্রিকায় ১১ জানুয়ারি ১৯৯৫ তারিখে
‘মুক্তিযুদ্ধ এবং আমি’ বইটির একটি রিভিউ প্রকাশিত হয়। দৈনিক দিনকাল পত্রিকার প্রায় অর্ধপৃষ্ঠাব্যাপী এই রিভিউটি করেন প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক ও কবি আ. শ. ম. বাবর আলী। এখন বই সম্পর্কে তাঁর জবানিতেই শুনি,
” লেখক সামাদ সিকদারের ‘মুক্তিযুদ্ধ এবং আমি’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক একখানি গ্রন্থ। লেখক নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। প্রায় নয়মাস তিনি মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন সক্রিয়ভাবে। মুক্তিযুদ্ধের জন্য অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। যুদ্ধ করেছেন। বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেছেন। অসীম কষ্ট ও দুর্দশা ভোগ করেছেন।…
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে এ পর্যন্ত যে সমস্ত বই প্রকাশিত হয়েছে তার সংগে এই বইটির কিছুটা স্বাতন্ত্র্য আছে। এতে যে বর্ণনা আছে, তা সম্পুর্ন লেখকেরই ব্যক্তিগত কর্মক্রিয়া ও অভিজ্ঞতা। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে হাটতে হাটতে ভারতে চলে যান।… বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্রের পরিচালনা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।… প্রশিক্ষিত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে দেশের জন্য তিনি যুদ্ধ করেছেন। মৃত্যুরও সম্মুখীন হয়েছেন। … এরপর দেশ স্বাধীন হয়েছে। শত্রুমুক্ত হয়েছে। একজন বিজয়ী বীরের বেশে গর্বিত বুক নিয়ে ফিরে এসেছেন তিনি নিজের দেশে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জীবন ধন্য মনে হয়েছে তাঁর।” …
কবি আ.শ.ম. বাবর আলী বইটির রিভিউর সমাপ্তি ঘটান এই বলে,
” সামাদ সিকদারের ‘মুক্তিযুদ্ধ এবং আমি’ গ্রন্হখানি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি ঐতিহাসিক ডায়েরি। দলিলতো বটেই। বিশেষ করে একজন প্রত্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধার জবানিতে লেখা নিজের অভিজ্ঞতার
কাহিনি। সন্দেহাতীত বিশ্বাসযোগ্যতার কারণে গ্রন্থখানি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণ ইতিহাস রচনায় একটি বিশেষ সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে কাজ দেবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। তাই গ্রন্থখানি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থমালায় একটি মূল্যবান সংযোজন।
লেখকের বর্ণনা ভঙ্গি অত্যন্ত সাবলীল। ভাষা ঝরঝরে ও প্রাঞ্জল। লেখার গতি অতি সুন্দর প্রবাহমান। পড়তে একটুও কষ্ট হয় না। বরং আগ্রহের সৃষ্টি হয়। এক জায়গাতে বসে একটানা পড়ে শেষ করা যায়। লেখকের জন্য এ এক বিরল কৃতিত্ব।” (চলবে)