যে ছেলেটা আপনার খুব আশেপাশে সাধারনভাবে ঘুরে বেড়ায়, সে একদিন এ দেশের প্রধান হতে পারে? পারে কিন্তু । ক্লাসে কেউ যদি বলে অথবা ধরুন আড্ডায় কেউ বলে যে আমি এ দেশের রাষ্ট্রপতি হবো । হাসাহাসি পড়বে । এবং যে ছেলেটা একদিন সত্যি রাষ্ট্রপতি হবে সে বললেও সবাই এমনটিই করবে । কিন্তু এটা কি সত্যি নয় যে, আজকের ছোট ছেলে কিংবা মেয়েটা একদিন এ দেশের প্রধান হবে; অথচ স্বপ্নের কথা বললে আমরা সবাই এমন করি । কিন্তু কেনো? আমরা তো সুন্দর আর বড় স্বপ্নবাজ জাতি, অসম্ভবকে সম্ভব করা আমাদের স্বভাবজাত । তারপরও আজকের প্রজন্ম এমন ভাবার কারণ সত্যি দুঃখজনক । আজকে একজন স্বপ্নবাজের কথা বলবো, যিনি সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়েছিলেন কাজ, মেধা আর সততায় ।
তিনি ছিলেন একজন ইঞ্জিনিয়ার, রকেট বানিয়ে নিজের প্রকৌশল যোগ্যতা প্রমাণ করে হয়ে গেলেন ভারতের পারমানবিক কর্মসূচির ফিচার হিরো । রামেস্বরেমের মৎস্যজীবী পরিবারের নিম্ন-মধ্যবিত্ত্ব তরুনের পুজি ছিল তাঁর ভাইয়ের ভালবাসা এবং নিজের প্রতি অসম্ভব আস্থা আর সততার মানসিকতা। স্কুলে মধ্যম মানের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি ছিলেন তাঁর শিক্ষকদের নিকট মেধাবী ও পরিশ্রমী ছাত্র। ম্যাট্টিকুলেশন শেষ করে সেন্ট জোসেফ কলেজ থেকে ১৯৫৪ সালে ফিজিক্সে গ্রাজুয়েট শেষ করে মাদ্রাজে আসেন এবং ১৯৫৫ সালে ‘মাদ্রাজ ইন্সটিটিউট অভটেকনোলোজি’তে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হন। অল্পের জন্য যুদ্ধবিমানের পাইলট হওয়ার স্বপ্নীল সুযোগ মিস করেন তিনি। সবাই নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন, আমি এতক্ষণ যে স্বপ্নওয়ালার কথা বলছি, তিনে হলেন এপিজে আবুল কালাম । তাঁর স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলেও ভারতের ১২০ কোটি মানুষের স্বপ্নের ভার তিনি নিয়েছিলেন অত্যন্ত আনন্দের সাথে; আর সে ভার বয়ে বেড়িয়েছেন জীবনের শেষ ক্ষণ পর্যন্ত অত্যন্ত সফলতার সাথে।
তাঁর শিক্ষাজীবনের পরবর্তী ৪ দশক কেটেছে প্রধানত Defence Research and Development Organisation (DRDO) এ বং Indian Space Research Organisation (ISRO) এর বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান প্রশাসক হিসেবে। এসময়ে কালাম ভারতের বেসামরিক মহাকাশকর্মসূচী ও সামরিক মিসাইল ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রামে অন্তরঙ্গ ভাবে জড়িত ছিলেন। ব্যালস্টিক মিসাইল উন্নয়ন ও লঞ্চ ভেহিকেল প্রযুক্তির জন্য তিনি শীঘ্রই ভারতে ‘মিসাইল ম্যান’ হিসেবে পরিচিতি পান। তিনি ১৯৯৮ সালে ভারতের পোখরান-২ পারমানবিক বোমার পরীক্ষায় সাংগঠনিক, প্রযুক্তিগত ও রাজনৈতিকভাবে কেন্দ্রীয়ভূমিকা পালন করেন। কালাম ভারতের Integrated Guided Missile Development Programme (IGMDP) এর অধীনে অনেক মিসাইল তৈরীর পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেন।এর মাঝে অগ্নি, পৃথ্বী উল্লেখযোগ্য। কালাম ১৯৯২ সালের জুন থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর প্রধান বিজ্ঞান উপদেষ্টা ও প্রতিরক্ষা গবেষনা ও উন্নয়ন সংগঠনের সচিবের হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পোখরান-২ পারমানবিক পরীক্ষা এই সময়ে সংঘটিত হয় এবং এক্ষেত্রে তিনি রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগতভাবে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেন। পারমানবিক পরীক্ষার পর্যায়ে কালাম এর ‘প্রধান সমন্বয়কে’র দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৮ সালে কালাম ও কার্ডিওলজিস্ট সোমা রাজু যৌথ ভাবে বক্ষব্যাধিরজন্য কম মূল্যের মেডিসিন আবিষ্কার করেন,যা দ্বারা প্রত্যন্ত এলাকার দরিদ্ররোগীদের চাহিদা মেটানো হচ্চে। ২০১২ সালে এটির নাম রাখা হয় ‘কালাম-রাজুট্যাবলেট’।
কালাম ২০০২ সালে ভারতের প্রধান দুই দল (ক্ষমতাসীন বিজেপি ও বিরোধী জাতীয়কংগ্রেস) এর সমর্থনে ভারতের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০০৭ সাল পর্যন্ততিনি উক্ত পদে আসীন ছিলেন। কালাম ছিলেন ভারতের ৩য় রাষ্ট্রপতি যিনি ভারতরত্ন উপাধিতে ভূষিত হয়েছিন। তবে তিনি ভারতরত্ন উপাধি লাভ করেছিলেন তাঁর প্রেসিডেন্ট হওয়ার পূর্বে। তাঁর প্রেসিডেন্সির সময়ে তিনি আত্যন্ত আবেগময়ভাবে ভারতের জনগনের নিকট ‘জনতার রাষ্ট্রপতি’ নামে পরিচিত ছিলেন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে দন্ড মওকুফের ক্ষমতা তাঁর হাতে থাকলেও তিনি কোন দন্ডমওকুফ করেন নি, আবার একটি ছাড়া কোন দন্ড মওকুফের আবেদন প্রত্যাখ্যানও করেননি। যে আবেদনটি তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তা হল ধর্ষক ধনঞ্জয় চ্যাটার্জীর দন্ড মওকুফের আবেদন। ২০০৭ সালে তাঁর প্রথমবারের মেয়াদ শেষে ২য়বার প্রেসিডেন্সির জন্য লড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও শিভ সেনা, ইউপিএ সহ বামদলগুলোর সমর্থনহীনতার কারনে সেই ইচ্ছা ত্যাগ করেন। ২০১২ সালেও বিজেপি, তৃনমূল কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি কালামকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করারব্যাপারে সমর্থন দিলেও পরবর্তীতে নানা কারনে তা হয়ে ওঠেনি। প্রেসিডেন্টে হিসেবে দায়িত্ব পালনের পরে কালাম বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভিজিটিং প্রফেসর ও ফেলো হিসেবে কাজ করেন । ২০১২ সালের মে মাসে কালাম তরুনদের জন্য দূর্নীতি বিরোধী একটি কর্মসূচী হাতে নেন যা what can I give movement নামে পরিচিত ছিল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি কাজ করে গেছেন মানুষের কল্যাণে । তাই আমরা স্বপ্ন দেখবো । স্বপ্ন দেখতে শেখাবো । স্বপ্ন দেখতে দেখতে সাধারণ থেকে সত্যি একদিন অসাধারণ হয়ে জয় করবো সবকিছু ।
লেখক – গবেষক ও অনুবাদক, ইউএনভি ।