আমাদের দেশে ধনী ও প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী মানুষের তুলনায় নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার এবং গরীবের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী। তন্মধ্যে বেশীরভাগই হতদারিদ্র এবং অসমর্থ। বিশেষ করে জীবন ও জীবিকার তাগিদে যারা প্রতিদিন কঠোর সংগ্রামে লিপ্ত থাকে, দুঃখ-দীনতাই যাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। বিশেষতঃ আর্থিক সংকটে যাদের অর্ধাহারে, কখনো বা অভূক্ত জীবনযাপন করতে হয়। যাদের মাথা গোঁজার ছাদ থাকে তো পরনের বস্ত্র থাকে না, দু’বেলা অন্ন জোটে তো বিদ্যার্জনের সামর্থ থাকে না। যাদের নিজস্ব মাটিতে মেরুদন্ড সোজা করে শক্তপায়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা থাকে না। নামমাত্রই বেঁচে থাকা। আত্মরক্ষা করে ফুটপাতে কিংবা মফঃস্বল অ লের নিকটবর্তী খাল-বিল-নালা-নর্দমার সংলগ্ন গাছের ছালবাকল অথবা ছেঁড়া বস্তা ঘেরা ছোট্ট একটা ঘুপচি ঘরে। যেখানে সামান্য বর্ষণে রাজ্যের কীট-পতঙ্গ, মশা-মাছি, পোকা-মাকড়, বিষধর সাপ, কেঁচো-ব্যাঙ গিয়ে বাসা বাঁধে। আবার কারো কারো সেটুকুও জোটে না। দীর্ঘ রজনী অতিবাহিত করে উন্মুক্ত নীল সামীয়ানার নীচে। যারা আমাদের সুশীলসমাজে আজও নিগৃহীত, নির্যাতিত, লাঞ্ছিত, অবহেলিত এবং নিপীড়িত। মূলতঃ যারা মনুষ্যকূলে জন্ম গ্রহণ করেও মানবাধিকার থেকে সম্পূর্ণ বি ত। যাদের ভাগ্যবিড়ম্বণায় পদে পদে অপদস্থ হতে হয়। যারা আমাদের দেশে অতি নগণ্য, দেশের নাগরীক হিসেবে কখনোই বিবেচিত হয় না। কিন্তু তারা কিভাবে জীবনযাপন করে, কিভাবে জীবিকা নির্বাহ করে, পেটের ক্ষিদে মেটায়, কেইবা রাখে তাদের সেখবর! যা প্রত্যক্ষ দৃষ্টিপাত না হলে গহীন অনুভূতি দিয়ে কখনো উপলদ্ধি করা যায় না। সে এমনি এক অবিস্মরণীয় ঘটনা, যা কোনদিন ভোলার নয়। আজও আমার মনঃশ্চক্ষে জলছবির মতো ভেসে ওঠে, সেদিনের এক অসহায় আশ্রয়হীন দুর্বল নারীর ত্রাণ রক্ষার সেই করুণ আবেদন, তীব্র আর্তনাদ।

অনেক বছর আগের কথা। যখন কৈশোরে মুক্ত-বিহঙ্গের মতো বন্ধনহীন, চিন্তাহীন জীবনের আনন্দময় মুহূর্তে হৃদয়ের দুকূল প্লাবিত করে খুশীর জোয়ারে ভেসে বেড়াতাম। আমার আজও স্পষ্ট মনে পড়ে, তখন আষাঢ মাস। সেদিন ছিল রথ যাত্রা। প্রতি বছরের মতো সেবারেও রথ যাত্রার মেলা বসেছিল, আমাদের নিকটবর্তী বুড়ো শিবতলা মন্দিরের সংলগ্ন একটি বিশাল চত্তরে। আমরা সকাল থেকেই মেতে উঠি মেলার অন্যতম আনন্দে। মেলা মানেই তো তালপাতার বাঁশির অপূর্ব মূর্ছণা, নাগর দোলায় চড়া, সূঁতোয় বাঁধা কাঠপুতুলের নাচন দেখা, ঝাল মুড়ি খাওয়া, আরো কত কি! কিন্তু বিধি বাম। সেদিন ঊষার প্রারম্ভেই ধূঁয়োর মতো আবছা কূয়াশায় ছেয়ে গিয়েছে চারদিক। গুমাট মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। একটু হাওয়া নেই, বাতাস নেই। বিকেল হতেই বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করে। সেই সঙ্গে এলোপাথাড়ী ঝড় -তুফান। কি শোচনীয় অবস্থা তখন আকাশের। মনে হচ্ছিল, এক্ষুণিই ঝুপ্ ঝুপ্ করে বৃষ্টি নামবে। কিন্তু গ্রাহ্য করছে কে! তা উপেক্ষা করেই আমরা দলবেঁধে হৈ-হুল্লোড় করতে করতে বেড়িয়ে পড়ি রথের মেলা দেখতে ।

যাচ্ছিলাম শর্টকাট পথ ধরে, একটা ফুটবল খেলার মাঠের উপর দিয়ে। কিছুদূর যেতেই হঠাৎ শুরু হয় মুসলধারে বৃষ্টি। যেন আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি। সহসা থামার কোনো লক্ষণই ছিল না। সেই সঙ্গে গুড়–ম গুড়–ম মেঘের গর্জন, বিদ্যুতের বাঁকা ঝিলিক। গাছের ডালপালা ভেঙ্গে মুছড়ে সে একেবারে প্রলয়ঙ্করী বেগে ছুটে চলে দ্বিগি¦দিকে।
কি করি! ক্ষণিকের বিভ্রান্তিতে আমরা অস্থির হয়ে উঠি। ফিরে যাবারও কোনো উপায় ছিল না। অগত্যা, দৌড়ে গিয়ে ঢুকে পড়ি পার্শ্ববর্তী একটি প্রাইমারী স্কুলের ভিতরে। ততক্ষণে আমাদের উচ্ছাসিত আনন্দে ভাটা পড়ে যায়। শিথিল হয়ে আসে মেলায় ঘুরে বেড়াবার আগ্রহ, উৎসাহ, ইচ্ছা, অনুভূতি সব। তন্মধ্যে লোডসেডিং, কোথাও বিদ্যুৎ নেই। অচীরেই ঘনিয়ে আসে অন্ধকার। সুস্পষ্ট কিছু দেখা যাচ্ছিল না। আচমকা অনাকাক্সিক্ষত বিরূপ পরিস্থিতির কবলে পড়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় আমাদের বুক শুকিয়ে যাচ্ছিল। ইতিপূর্বে হঠাৎ কর্ণগোচর হয়, মানুষের কোন্দল, কোলাহল, চিৎকার-চেঁচামিচি।

আমরা চমকে উঠি। স্কুলের জানালা দিয়ে গলা টেনে চারিদিকে চোখ বুলাতেই হ্যাজাক্বাতির জোড়ালো আলোর রস্মি আমাদের দৃষ্টি আর্কষণ করে। মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল, যেন অথৈ জলে কিনারা খুঁজে পেলাম। দেখলাম, একটু দূরে ঐ ফুটবল খেলার মাঠের বিপরীত দিকে অবস্থিত, একটি বিশাল দালান বাড়ির প্রাঙ্গণে প্রচন্ড ভীঁড়। লোকে লোকারণ্য। খুব হৈ চৈ হচ্ছে সেখানে। কিন্তু হেতু বোঝা যাচ্ছে না। ঘাবড়ে গেলাম আমরা। বিচলিত হয়ে পড়ি। নিশ্চিতভাবে অনুমান করেছিলাম, নিশ্চয়ই কারো মাথার উপর বজ্রপাত হয়েছে।

কিন্তু না, লোকের কানাঘুষোয় অবগত হলাম, শিশু অপহরণের দায়ে একজন মহিলাকে আটক করে রেখেছে। মনে মনে ভাবলাম, এ আর নতুন কি! দিনকাল কবেই বা ভালো ছিল। অহরহই তো ঘটছে। কিন্তু এমন দুর্যোগের মধ্যেও!

তবু স্বভাবসুলভ কারণে মহিলা চোরকে স্বচোক্ষে দেখবার ইচ্ছা আমাদের প্রবলভাবে জেগে ওঠে। কৌতূহল সম্বরণ করতে পারিনি। বৃষ্টিটা ধরে আসতেই আমরা দ্রুত ছুটে যাই সেখানে। গিয়ে দেখি, অবাক কান্ড! সে এক নতুন বিস্ময়। একেবারে গল্প, নোবেলের মতো ঘটনা। ময়লা অপরিস্কার ছেঁড়া ফাটা বস্ত্র পরিহিতা এক মহিলা একহাত ঘোমটা টেনে, কাঁথা জড়ানো একটি ছোট্ট শিশুকে বুকে নিয়ে, একহাঁটু জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। ওর আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে দেখলাম, তার দুইহাত ভর্তি রং বেরং-এর প্লাষ্টিকের চুরি। পায়ে স্যাঁতলাপড়া হাওয়াই চটি। নোংরা ভর্তি হাতে পায়ের বড় বড় নখ। পা -দুটোও ফুলে ফেটে বিন্দু বিন্দু রক্তকণায় লাল হয়ে উঠেছে। হ্যাজাকের আলোতে যেটুকু দেখা গেল, তাতে মনে হলো, বেশ কয়েকদিন জলের মধ্যে ডুবেছিল। ওর পায়ের আঙ্গুলের ফাঁকগুলিকেও জলে খেয়ে একেবারে ঘা করে ফেলেছে। কিন্তু মহিলাটিকে খুব অস্বাভাবিক লাগছিল। কিছু বলবার ব্যকুলতায় কেমন অস্থির হয়ে উঠছিল। ওর ঠোঁট কাঁপছিল। চোখদু’টোও আঁতঙ্কে ভরা।

কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই স্থানীয় মস্তান গোছের কয়েকজন যুবক ছেলে উত্তেজিত হয়ে বলছে,-‘ধর চুলের মুটি, বেটি দু-চার ঘা খেলেই মুখ দিয়ে অনায়াসে বুলি উতরে আসবে!’

কেউ বলছে,-‘কূলটা, পাপীষ্ঠা!’

আবার কেউ বলছে,-‘পালিয়ে যাচ্ছিস কোথায়? বল্ কোথা থেকে বাচ্চা চুরি করেছিস? কাদের বাচ্চা চুরি করেছিস শীগ্গিরি বল, নয়তো এক্ষুণি তোকে পুলিশে ধরিয়ে দেবো!’

পুলিশের নাম শুনেই ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে মহিলাটি থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। ভয়ে আঁতঙ্কে আড়ষ্ঠ হয়ে বাচ্চাটাকে শক্তহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু বিক্ষিপ্ত জনতার দল নাছোরবান্দা। মারধোর করবার হুমকি দেখায়। অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে। রীতিমতো প্রস্তুতি নিয়ে ছেলেরা তেড়ে আসতেই কান্না জড়িত কন্ঠে মহিলাটি আর্তনাদ করে ওঠে,-‘আমি চোর নই বাবু, চোর নই। ও আমারই বাচ্চা। কত্তকষ্টে নয়টামাস প্যাটে রাইখ্যা অড়ে আমি জনম দিছি। আমিই অর মা।’

বাচ্চাটাকে সজোরে বাহুবেষ্টনে আলিঙ্গন করে ওর কপালে একটা চুম্বন করে বলল,-‘সংসারে আমাগো কেউ নাই গো বাবু, কেউ নাই। সব বন্যার জলে ভাইস্যা গ্যাছে। আমারে দয়া করেন!’ বলতে বলতে মহিলাটি হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে। তারপর ধীরে ধীরে একটু একটু করে উন্মোচন হতে থাকে, ওর জীবনের করুন কাহিনী।

মহিলার নাম সরলা। অজ্পাড়া গাঁয়ের অতি নিম্ন বিত্ত পরিবারের কূলবধূ। জরা-জীর্ণের মতো রোগা শরীর। গায়ের রং শ্যাম বর্ণ। বয়সের তুলনায় বেশ বুড়িয়ে গ্যাছে। চোখমুখ গর্তে ঢুকে গেলেও খুটিয়ে দেখলে বেশ বোঝা যাচ্ছিল, যৌবনের প্রাক্কালে সরলা কম সুন্দরী ছিল না। ভাগ্যের নিমর্ম পরিহাসে অনাদরে অবহেলায় ময়লার আবরণে ওর লাবণ্যময় সৌন্দর্য্য একেবারে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। ঘটা করে না হলেও রীতিমতো শাস্ত্র মতেই পুরোহিত কতৃক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল ওদেরই পার্শ্ববর্তী গ্রামের একজন অশিক্ষিত অসমর্থ দুর্বল লুলা ল্যাংড়া তরুণ যুবক রঘুনাথ মন্ডলের সাথে।

কথায় বলে,-‘খাঁটি সোনা বেঁকে গেলেও সেটা সোনাই। তার মূল্য কখনো কমে যায় না!’
তেমনি একজন পুরুষমানুষ শত কালো কুৎসিৎ কিংম্বা বিকলাঙ্গ হলেও তার পুরুষত্ব কখনো কমে যায় না। আর গেলেও সরলার মতো মেয়ের তাতে কিইবা এসে যায়। বরং ওর জন্য শাপে বর হয়েছিল। অন্তত বিমাতা কতৃক অমানবিকভাবে নির্যাতিত এবং লাঞ্ছিত হয়ে অর্ধাহারে জীবনযাপন করার চে’ লুলা ল্যাংড়া অক্ষম স্বামীর ঘর-সংসার করা ঢের ভালো। এ তো ওর পরম সৌভাগ্য। বিধাতারও অসীম দয়া। নইলে অজ্পাড়া গাঁয়ের আনস্মার্ট, আন্এ্যডুকেটেড্ এবং স্বল্প বস্ত্র পরিহিতা মেয়ের বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, জীবনসাথী পাওয়া, স্বামী সোহাগী হওয়া, তার হৃদয় নিঃসৃত ভালোবাসা পাওয়া, এ কি কম সৌভাগ্যের কথা! কখনো স্বপ্নেও তো ভাবতে পারেনি সরলা।

রঘুনাথ ক্র্যাচ্ ছাড়া চলতে পারতো না। চলার শক্তিও ছিল না। জীবন ও জীবিকার তাগিদে শুধুমাত্র মৌলিক চাহিদা মেটাতেই ওকে অনেক হিমশিম খেতে হতো। তবু ওর মনের শক্তি ছিল প্রকট। ছিল অসাধারণ আত্মবিশ্বাস, দৃঢ় সংকল্পপ্রবণ এবং সৃজনশীল মন মানসিকতা। শারীরিক ভারসাম্যহীনতায় কখনো ভেঙ্গে পড়ে নি। পিছুপাও হয় নি। দুঃখ-দৈনতায় ওকে কখনো ঘায়েল করতে পারে নি। বিকলাঙ্গ শরীর নিয়ে গরুর গাড়ির মতো ধিক্ ধিক্ করে একহাতেই ঠেলাগাড়ি টানতো। বাজারে ডাব বিক্রি করতো। বাড়িতে হাঁস-মুরগীর ছোট্ট পল্ট্রিও ছিল। যার দেখাশোনা করতো সরলা। তাতে যা আমদানি হতো তা দিয়ে দু’জনের পেট কোনরকমে চলে যেতো। কোন কোনদিন অর্ধাহারেও কাটাতে হতো। তবু কোনো অসন্তোষ, অভিযোগ কিচ্ছু ছিল না। ছিল সুখ, শান্তি। ছিল সরলার অনাবিল মুখের অনিন্দ্য সুন্দর হাসি। যা কখনোও ম্লান হতো না। বাস করতো, খড়-কূটোর ছাউনি দেওয়া ছোট্ট একটি মাটির ঘরে। যেখানে প্রত্যেক বছর বর্ষার জলে ধস্ নেমে গৃহহীন হয়ে পড়ে বাচ্চ-বুড়ো সহ গ্রামের শত শত অসমর্থ দুর্বল মানুষ। মারাও যায় অনেকে। আর যারা অর্ধমৃত অবস্থায় বেঁচে থাকে, তারা সর্বস্ব নিঃশ্ব হয়ে এতিমের মতো অন্ন-বস্ত্র এবং আশ্রয়ের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায় পথেঘাটে, রাজ্যের অখ্যাত কুখ্যাত পল্লীর অলি-গলিতে, শহরের জনপথে। যেখানে প্রতিনিয়ত প্রবি ত, লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত হয় গৃহহীন, আশ্রয়হীন, সম্বলহীন অগণিত অভূক্ত মানুষের জীবন।

সেবার প্রবল বর্ষণ ও ঝড়-তুফানে সরলার স্বামী, ঘর-সংসার, হাঁস-মুরগী সব জলে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অনিশ্চিত মোহনার দিকে। তারা জীবিত না মৃত, তাও সরলার জানা নেই। কথায় বলে,-‘চাচা, আপন পরাণ বাঁচা।’

বন্যার জলে ভয়ঙ্কর বিপদগ্রস্থ সরলার ভালোবাসার মাটির প্রাসাদখানি যখন টলমল অবস্থা, তখন ওর মন-মানসিকতা প্রতিবন্ধি হয়ে পড়ে। ন্যায়-অন্যায়, বিচার-বিবেচনা করার মতো কোনো শক্তিই তখন ওর ছিল না। যখন আসন্ন বিপর্যয়ের সম্মুখে পালিয়ে যাওয়াই ছিল সরলার একমাত্র বাঁচার পথ। নতুবা ওর মৃত্যু অবধারিত।
সরলা উপায়ান্তরহীন হয়ে সদ্য নবজাত শিশুকে বুকে আগলে একটি কাপড়ের পোটলা সাথে নিয়ে, স্বামী, ঘর -সংসার এবং বৈবাহিক জীবনের বিশ্বাস-ভালোবাসার সকল বন্ধন ছিন্ন করে ঘর ছেড়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে বাইরের পৃথিবীতে। যে ঘরে জন্ম নিয়েছিল সরলার প্রথম প্রেম, ভালোবাসা। কত আশা বুকে বেঁধে সাজিয়ে ছিল ওর নতুন সংসার। গড়ে তুলেছিল স্বর্গসুখ। কত না স্বপ্নীল আশা আকাক্সক্ষা গেঁথে রেখে ছিল মনের মণিকোঠায়। যা ভাগ্যবিড়ম্বণায় সলীল সমাধী হয়ে একেবারে ওর জীবন থেকেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। যেদিন জীবনের নিষ্ঠুর পরিণতির পূর্বাভাষে বোধগম্য হয়েছিল, প্রকৃতির নির্দয়, নিষ্ঠুর নিমর্মতায় বন্যার জলে ভেসে যাবে ওর আট বছরের সাজানো সংসার। ভেঙ্গে যাবে সুখের নীড়। ভেসে যাবে ওর বিকালঙ্গ স্বামী রঘুনাথ। যার সোজা হয়ে দাঁড়াবার শক্তি নেই। ছুটে পালাবার ক্ষমতা নেই। জলের স্রোতে ওকে কোথায় যে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, কোনো পাত্তাই পাওয়া যাবে না। হয়তো গাছের লতাপাতায় লেপটে থাকবে কোথাও। হয়তো বা দম আঁটকে সেখানেই মরে পড়ে থাকবে। যাকে শনাক্ত করা কিংবা জীবিত না মৃত তা অনুসন্ধান করার মতো কেউ থাকবে না। কোনদিন আর দেখা হবে না রঘুনাথের সাথে। কখনো জবাবদিহীও আর করতে হবে না। আজই ওর শেষ দেখা।

আশা ছিল, শহরে এসে কূল-কিনারা একটা নিশ্চয়ই খুঁজে পাবে। মাথা গোঁজার মতো আশ্রয় কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই জুটে যাবে। কোলের সন্তানই আজ ওর একমাত্র সম্বল। যার মুখ চেয়ে জীবনের দুঃখ যন্ত্রণা সব ভুলে যাবে। ভুলে যাবে ওর অতীত। ভুলে যাবে স্বামী রঘুনাথকেও। দুঃখই যার নিত্যসঙ্গী, প্রতিদিনকার খোরাক, লোকের বাড়ি ঝি-গিরি করে অনিশ্চিত জীবনের বাকী দিনগুলি সে অনায়সেই কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু মুখে বলা যতটা সহজ, বাস্তব ততই কঠিন।

বলতে বলতে বিকলাঙ্গ স্বামী রঘুনাথের অসহায় মুখখানা চোখের পর্দায় ভেসে উঠতেই বুকটা তীব্র বেদনায় মোচড় দিয়ে ওঠে সরলার। শোকে বিহ্বলে দুইহাতে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে হঠাৎ বিলাপ করে ওঠে,-‘আমি তারে একেলা ছাইড়্যা আইছি। আমি যে বচন দিসিলাম, সারাজীবন তার পাশে থাকুম, আপদে বিপদে তারে দেখুম, রক্ষা কুরুম। আমি পারি নাই তারে বাঁচাইতে, রক্ষা করতে। আমি বড়ই নিষ্ঠুর, স্বার্থঃপর। আমারে ক্ষমা করো প্রভু, ক্ষমা করো। আমার বাচ্চাটারে বাঁচাও। অড়ে দয়া করো। আমারে পথ দেখাও।’

কিন্তু সঠিক পথ সরলাকে দেখাবে কে? সেদিনকার মতো সাময়িক আশ্রয় পেলেও রাত পোহাতেই দিগন্তের প্রান্তরে উষার প্রথম সূর্য্যরে স্নিগ্ধ কোমল আলো ফুটে ওঠার পূর্বেই সরলাকে হতাশ হয়ে শূন্য হাতে বিদায় নিতে হয়েছিল। কোনো সাহায্য, সহানুভূতি সেদিন ওর কপালে জোটে নি। কিন্তু বিপন্ন জীবন নদীর স্রোতের টানে ওযে কোণ্ মোহনায় গিয়ে আঁটকে আছে, কিভাবে জীবিকা নির্বাহ করছে, তা কেউই জানে না। কারণ আমাদের সমাজ বড়ই কঠোর, নিষ্ঠুর। কোনপ্রকার অনুদান কিংবা আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে আমরা কুণ্ঠিতবোধ করি, পিছুপা হই। যার ফলে সরলার মতো শত শত গৃহহীণ আশ্রয়হীন সম্বলহীন অসহায় দুর্বল মানুষ আমাদের সমাজে আজও নিগৃহীত, নিপীড়িত। যারা প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে নিমর্মভাবে জীবন পাত করে চলেছে। যারা পেটের দায়ে নিজের মান-ইজ্জত বিসর্জন দিয়ে শহরের অখ্যাত কুখ্যাত পল্লীর অলি গলিতে বসে ভিক্ষে করছে। কেউ লোকের এঁঠো বাসন-পত্র ধুয়ে মেজে অন্ন যোগাচ্ছে, দু’বেলা পেট ভরছে। কেউ কূলি বিত্তি করে পাখীর ছানার মতো নিজের সন্তানের মুখে আহার তুলে দিচ্ছে। আর কেউ কেউ অর্থের বিনিময়ে নিজেকেই বেঁচে দিচ্ছে দয়া-মায়াহীন, নিষ্ঠুর অত্যাচারী পাষন্ডের হাতে। কি হবে এদের ভবিষ্যৎ? কে দেবে এদের সাহারা? কে নেবে এদের দায়িত্ব? কি হবে এদের পরিণাম? যার কোনও নিশ্চয়তা নেই।

অতঃপর, সেদিন রথের মেলায় আমাদের আর যাওয়া হয়নি। মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, এতক্ষণ আমরা ছবিঘরে বসে বসে রূপালী পর্দায় সরলার জীবন কাহিনীর সাক্ষাৎ রূপ প্রদর্শণ করছিলাম। কিন্তু ওর পরিস্থিতি এবং মানসিক যন্ত্রণা সেদিন অপরিণত বয়সে আমরা কেউই অনুভব করতে পারিনি। পারিনি তার মূল্যায়ন করতে। কিন্তু সেইরাতে দুচোখের পাতা কিছুতেই আর এক করতে পারিনি। পারিনি মন থেকে তা অপসারিত করতে। প্রত্যেক বছর রথ যাত্রা এলেই আজও আমার চোখের পর্দায় জীবন্ত হয়ে ভেসে ওঠে, অতীতে ফেলে আসা একখন্ড হৃদয়বিদারক দৃশ্যপটের এক হতভাগী জননীর সেই করুণ আবেদন, আকুতি, মিনতি। কানে বেজে ওঠে ওর আর্তনাদ, ক্রন্দন, বিলাপ। আর মাতৃত্বের হৃদয় দিয়ে গভীরভাবে অনুভন করি, দুঃখের দহনে, করুণ রোদনে সেই দিনের সেই সর্বহারা অসহায় মায়ের বুকের ভিতরে লালিত যন্ত্রণার কতখানি গভীরতা ছিল। যা আজও আমাকে পীড়া দেয়।

সমাপ্ত

যুথিকা বড়ুয়া : টরোন্ট প্রবাসী গল্পকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী।

ছবি:-সৌজন্যে Fiveprime

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন